ফজলুল বারী:স্বপন কুমার বিশ্বাসের ঘটনা প্রথম দেখি আমার কয়েক হিন্দু বন্ধুর ফেসবুক পোষ্টে। পুলিশের উপস্থিতিতে একজন কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা পরানোর ঘটনা নিয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। পুরো ঘটনার খবর পড়ে চমকে যাই। সেখানকার পুলিশ সুপারও যে একজন হিন্দু এ তথ্যটি আমার বন্ধুদের কেউ কেউ চেপে গেছেন!
নড়াইলে খোঁজ নিতে গিয়ে আরও চমকে যেতে হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে স্বপন কুমারের গলায় জুতোর মালা পরানো হয়েছে পুলিশের বুদ্ধিতে! পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় এই বুদ্ধির সঙ্গে জড়িত। পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার স্বপন কুমার বিশ্বাসকে যা যা করতে বলেছেন তিনি তাই করেছেন। হাতজোড় করা অবস্থায় স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে মব তথা বিক্ষুদ্ধ জনতার সামনে আনা হয়। জুতোর মালা পরানো হয় তার গলায়!
এভাবে ডিসি-এসপি মবকে বোঝান, স্বপন কুমার দোষী! ধর্মদ্রোহী! আমরা তাকে শাস্তি দিচ্ছি! এভাবে সেখান থেকে ‘ইসলাম ও নবী বিদ্বেষী (!)স্বপন কুমারকে পুলিশের গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তিনি এক রকম পালিয়ে বেড়াচ্ছেন!
অথচ স্বপন কুমার বিশ্বাস কোনভাবে দোষী নন। কলেজের একজন হিন্দু ছাত্র বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মার প্রশংসা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। রটনা করা হয় স্বপন কুমার ওই ছাত্রকে সমর্থন দিচ্ছেন। তাকে রক্ষা করা চেষ্টা করছেন। যা পুরোপুরি অসত্য।
ঘটনাটা ঘটলো-ঘটছে শিল্পী এস এম সুলতানের জেলা নড়াইলে। মাশরাফির জেলা নড়াইলে। যে এলাকাটি এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতিও একজন হিন্দু। কিন্তু এরা সবাই স্বার্থবাজ। এসপির মতো তারা সবাই এখন ঢাহা নিথ্যা বলছেন।
তারা নাকি স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতোর মালা দেখেননি! কে জুতোর মালা পরিয়েছে তা তারা জানেননা! এমনকি অনলাইনে যে জুতোর মালা পরানোর ভাইরাল ছবি-ভিডিও ভাসছে এসবও তারা দেখেননি! এই মিথ্যাবাদীদের কাছে কে কি আশা করেন?
এরাতো তদন্ত কমিটি করেছে সত্য ধামাচাপা দেবার জন্যে। কারন সত্য জীবিত থাকলেতো আইনের কাছে দোষী তারাই হবেন। এভাবে ধামাচাপা দেবার কারনে দেশজুড়ে এমন একেকজন হিন্দু শিক্ষককে অপদস্ত করার ঘটনা থামছেইনা। বেছে বেছে হিন্দু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ আনা হচ্ছে!
নারায়নগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করান এমপি সেলিম ওসমান। সেই ঘটনা পরে ধামাচাপা দেয়া হয়। হেনস্থা করা হয় মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলকে। উভয় ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। সে ঘটনাগুলোও ছিল স্কুলের কর্তৃ্ত্বের দ্বন্দ্ব। উভয় ঘটনায় ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে।
নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে ধর্মকে শুধু ব্যবহার নয়, তাকে জুতো মালা পরিয়ে অতঃপর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবার প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে! অথচ ওই কলেজে তিরিশ বছর ধরে তিনি শিক্ষকতা করছিলেন!
তিরিশ বছরে কত যে ছাত্র পড়েয়েছেন স্বপন কুমার। কিন্তু তাদের কাছেও তিনি হিন্দু শিক্ষকই রয়ে গেলেন! তাঁর নিশ্চয় প্রবীর কুমার রায়ের মতো অনেক হিন্দু ছাত্রও ছিল। তাদের অনেকে হয়তো ফেসবুকেও বিশেষ সক্রিয়। এসপি প্রবীর কুমার রায়ের মতো অন্যরা চাকরি বাঁচাতে ব্যস্ত!
প্রবীর কুমারদের আড়ালে রেখে অনেকে আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার পরীক্ষা নিচ্ছেন! এদের উদ্দেশে আমি নির্মল সেনের সেই কথাটিই ব্যবহার করি। আমাদের সবার ভিতরে একজন ধর্মীয় মানুষ বাস করেন। কোন না কোনভাবে সেই ধর্মীয় মানুষটি প্রকাশ হয়ে পড়ে! কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু।
এখন ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম আসায় আমাদের স্ট্যাটাস সহ নানাকিছুতে এটি প্রকাশ পায় বেশি। এটির ফেসবুকীয় সংজ্ঞা-ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড। এটা শুধু জামায়াত-শিবিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ভারতে বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ক্ষমতায় থাকার বিপদ আমরা টের পাচ্ছি।
এর বাতাস বাংলাদেশ পর্যন্ত চলে আসছে। নিউটনের থার্ড ল’, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। বিজেপি যেহেতু ধর্মকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় গেছে, ক্ষমতায় আছে, আমাদের আওয়ামী লীগও মুখে অসাম্প্রদায়িক দাবি করলেও আদতে এখন আর তা নয়।
বিএনপি-জামায়াত কি জিনিস তা আমরা জানি। আওয়ামী লীগও আর ধার্মিকদের দল নয় এমন অপবাদ শুনতে নারাজ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রেডিও-টিভিতে কয়েকদিন ধরে হামদ ও নাত প্রচার করা হয়েছে আর বলার চেষ্টা হয়েছে রক্ষা পেয়েছে আল্লাহ-রসুলের ধর্ম ইসলাম।
এরপর একটি অনৈসলামিক দলের তকমা মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগকে একুশ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। আবার ক্ষমতায় ফিরতে আওয়ামী লীগকে সাজতে হয়েছে ইসলাম পছন্দ দল। শেখ হাসিনার অবশ্য দৈনন্দিন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ হলো ধর্ম চর্চা। বিএনপি-জামায়াত এক্ষেত্রে কোন সুবিধাই করতে পারছেনা।
এরজন্যে পদ্মা সেতুর নাটবল্টু হাতে টিকটিকারকে গ্রেফতার করা হলেও নামাজের প্রদর্শনী করা লোকগুলোকে গ্রেফতার করা হবেনা। অথচ সেতুর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলার জন্যে তারাও দায়ী। সেতু করা হয়েছে দ্রুতগতির যানবাহন চলার জন্যে। নামাজের জন্য মসজিদ আছে।
এক সময় আমাদের এ অঞ্চলের শিক্ষকদের সিংহভাগ ছিলেন হিন্দু। তারা মেধাবী ছিলেন। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করতো। এখন শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নেমেছে। অবশিষ্ট হিন্দু শিক্ষকদের বিদায় করার কাজ চলছে। কেউ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেননা। স্বপন কুমার বিশ্বাসও এখন ঝরে পড়ার তালিকায়!
ক্ষমা করবেন স্যার। এই বাংলাদেশ আর আপনার না। আপনাদের না। পালিয়ে যাবেন স্বপন কুমার বিশ্বাস! একদিন হয়তো শোনা যাবে তিনিও নেই। দেশান্তরী হয়েছেন। জমি জিরাত যা ছিল অল্পদামে তাদের কাছে বিক্রি করে গেছেন যারা তাকে কলেজ থেকে বিদায় করতে গলায় জুতোর মালা দিয়েছে!
মাঝে মাঝে সীমান্তে আসবেন। জন্মভূমি দেশের সীমান্তে। বিশ্বাসঘাতক দেশ! সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল! জন্মভূমির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে চোখ মুছতে মুছতে চলে যাবেন নয়া দেশান্তরী স্বপন কুমার বিশ্বাস।