পদ্মা সেতুতে নাশকতার পরিবেশ আছে

পদ্মা সেতুতে নাশকতার পরিবেশ আছে

ফজলুল বারী: শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’ বলে বাংলা সাহিত্যে একটি কথা আছে। বাংলাদেশের মানুষজনের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা, আয়োজন প্রস্তুতি কম ছিলোনা। কিন্তু বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র মতো কিছু ঘটনা সবকিছুতে যেন নোংরা পানি ঢেলে দিয়েছে!

জাতির স্বপ্নের এই সেতুর নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কারা? তারা কিছু বিষয়গুলো নিয়ে আগে ভাবেননি? এখন স্পিড ক্যামেরা আর সিসিটিভি লাগিয়ে মোটরবাইক চলাচলের অনুমতি দেবার চিন্তা হচ্ছে! এসব কী আগে মাথায় আসেনি? না এসব জানতে শিখতেও শিক্ষা সফরে বিদেশ যাবার দরকার ছিল?

এই সেতু বানানো হয়েছে মানুষ কত দ্রুত তার গন্তব্যে পৌঁছবে। দ্রুত গতিতে যেতেও গতিসীমার বিষয় আছে। কিন্তু যে পথে গাড়ি চলবে সে পথের থামার, হাঁটার, সেলফি তোলার, টিকটিক ভিডিও করার, বসে বিড়ি টানার, বসে-দাঁড়িয়ে হিসু করার, নামাজ পড়ার কোন সুযোগ নেই।

এরপর সেখানে কেউ পুজোয় বসলে বাধা দেবেন কী করে? না তখন বানী ছাড়বেন সংখ্যগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ! এসব মুসলমানিত্ব জাহিরের ফতোয়া একেকজন কোথায় পেয়েছেন? সৌদি আরবে গিয়ে করতে পারবেন? বেত মেরে পিটিয়ে পাছার রং লাল করে দেবেনা?

বাংলাদেশে আইনের শাসন না থাকা, আইন প্রয়োগে দুর্নীতি থাকায় অনেকের মাঝেই ‘কুচ পরোয়া নেহি’ ভাবটা বড়। মোটর বাইকতো সারা দুনিয়ার মানুষ চালায়। কিন্তু এমন ফ্রি স্টাইল চালানোর সুযোগ আছে কী? পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর আমরা মোটর বাইকের ঢল দেখলাম। মোটর বাইকের আলাদা লেন নেই।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকের মাথায় হেলমেট থাকলেও সওয়ারীর মাথায় হেলমেট নেই! সওয়ারীকে হেলমেট কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে দেখাচ্ছে চালকের মাথায় আছে! ছবিতে দেখা যাচ্ছিল একজন টুপি পরা চালক, পিছনে বোরকাপরা সওয়ারী! স্বামী-স্ত্রী সম্ভবত।

কিন্তু এই যে আইন ভঙ্গ করে কারও মাথায় হেলমেট নেই, এতে কি ধর্মরক্ষা হয়? ধর্মওতো বলে দিয়েছে রাষ্ট্রের আইন মেনে চলার কথা। বাংলাদেশের মানুষজনকে বোঝানো গেলোনা হেলমেট আইনটি করা হয়েছে বাইক চালক ও সওয়ারীর জীবনরক্ষার জন্যে।

হেলমেট আপনি দয়া করে মাথায় রাখছেন মনে করবেননা, আপনার জীবন রক্ষার জন্যে এটি জরুরি এক বর্ম। মোটরবাইক দূর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যান এর কারন বড় একটি কারন হেলমেট। দূর্ঘটনায় আপনার হাত বা পা থেতলে গেলে সেটি কেটে ফেলে আপনাকে হয়তো বাঁচানো যাবে।

এরপর সারা জীবন পঙ্গু হয়ে থাকবেন, কিন্তু মাথায় আঘাত লাগলে মাথা কেটে ফেলে আপনাকে বাঁচানো যাবেনা। ঈদের সময় এত মোটরবাইক চালক-সওয়ারীর মৃত্যু ঘটলো সড়কে। হুশ তবু ফিরলোনা!

বিদেশে ড্রাইভিং পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ। একটি পয়েন্ট খোয়া গেলে সেটি তিন বছর চার মাস পর ফেরত আসে। একজন চালকের সাকুল্যে তেরোটি পয়েন্ট চলে গেলে সেই চালক তিন বছর চার মাস গাড়ি চালাতে পারবেননা। তা আপনি বাস-ট্রাক-কার-সিএনজি-মোটরবাইক যে চালকই হোননা কেনো।

এরসঙ্গে ফাইন যেটা তা বাংলাদেশের টাকায় কুড়ি হাজার আকার কম নয়। ড্রাইভিং পয়েন্ট আর ফাইনের ব্যাপারটি এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে আপনি আইন ভঙ্গ করতে ভয় পান, এই অপরাধ দ্বিতীয়বার করার আগে যাতে চিন্তা করেন। বাংলাদেশের জরিমানার অংক যা করা আছে তা অপরাধীরা ভয় পায়না। ভাবে পুলিশকে কিছু টাকা দিয়ে পার পেয়ে যাবে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল দিয়ে সেতু পেরুবার পথে কিছু পথ হেঁটে বিমান বাহিনীর মহড়া দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী এটা ঠিক করেননি। সেতুতে না থামা, গাড়ি থেকে না নামার বিষয়ে আইন সবার ক্ষেত্রে সমান। বিদেশে এমন ছবি দেখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জরিমানার চিঠি যেতো।

খালেদা জিয়া জোড়াতালির পদ্মা সেতুতে উঠতে নিষেধ করেছিলেন। এতে অনুপ্রানীত হয়ে গাড়ির টুলস ব্যবহার করে সেতুর হাতলের অংশের নাটবল্টু খুলে একজন জেলে গেছে। সে এভাবে জাতির স্বপ্নকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে চেয়েছে। তার এখন সাজা হবে। খালেদা জিয়া কী তাকে রক্ষা করতে পারবেন? না চেষ্টা করতে পারবেন?

সেতুতে মোটরবাইক থেকে নেমে বসে-দাঁড়িয়ে যারা হিসু করেছেন, এটা নিশ্চয় তারা প্ল্যান করে করেননি। যেখানে সেখানে হিসু করাটা তাদের অভ্যাস। বিদেশে এটাকে পাব্লিক নুইসেন্স বলে জরিমানা করা হয় অন দ্য স্পট ২শ ডলার। বাংলাদেশে যদি আইনের কড়াকড়ি থাকতো তাহলে এমন পাব্লিক নুইসেন্সে জড়িয়ে ২শ ডলার জরিমানা দেবার ঝুঁকি কেউ নিতোনা। হিসু বাড়িতে গিয়েই করতো।

প্রথমে সেতুর ওপর একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের নামাজের সেজদার ছবি আসে অনলাইনে। অনেকে তাতে আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ মন্তব্য লিখছিলেন। এরপর রীতিমতো জায়নামাজ বিছিয়ে জামাতে নামাজ, তাদের ছবি তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করা হয়।

এটিতো নামাজ ছিলোনা, পরিকল্পিত উস্কানি ছিল। কিছু লোক বাংলাদেশে এমন সবকিছুতে ধর্মীয় উস্কানি-সুড়সুড়ি দিতে ভালোবাসে। কিন্তু এই লোকগুলো বাংলাদেশের বিমান বন্দর ক্রস করে পৃথিবীর কোন একটি মুসলিম দেশে গিয়ে এসব করবেনা বা করতে পারবেনা। কারন আইনভঙ্গের কারনে তারা পাছার কী রঙ সৃষ্টি করে তা আগে উল্লেখ করেছি।

মোটকথা এমন কিছু অসুন্দর ছবি দেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী সৌন্দর্য্যকে নস্যাত করেছে। পদ্মা সেতু সহ দেশের সব বড় স্থাপনার নিরাপত্তা যে কেউ যে কোন সময় যে হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে, এ ঘটনাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

এই অভিজ্ঞতা যেনো কাজে লাগানো হয়। আগামীতে যে কোন মেগা প্রকল্পের উদ্বোধনের আগে যেন নিরাপত্তা সহ যাবতীয় খুঁটিনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের আগে প্রধানমন্ত্রী বললেন নাশকতার চেষ্টা হতে পারে। উদ্বোধনের পর দেখা গেলো নাশকতার পরিবেশ রয়েছে।

এমন যে কেউ যদি আত্মঘাতী কিছু করার চেষ্টা করতো তাহলে ইনারা কী করতেন? ছবি দেখেও জরিমানার বিধান করুন। জরিমানার অংকটা যেন সবাই ভয় পায়। যাতে এমন অপরাধ দ্বিতীয়বার করার চেষ্টা না করে। আমাদের জন্মভূমিটা নিরাপদ থাকুক।