সুভাষ সিংহ রায়: বিএনপির পাকিস্তান প্রীতির অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে। গত ১ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৪৫ বছর আগে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ‘DAWN’ পত্রিকায় ‘Return to the PAK Era’ শিরোনামের সংবাদ বিবরণীর কথা উল্লেখ করেছেন। সে সংবাদ বিবরণীতে জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ছবি পাঠকদের জন্য লেখার সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। পাঠক লক্ষ করে দেখুন, পাকিস্তানি পত্রিকার সেই ছবিতে জিয়াউর রহমানের পাশে রয়েছেন তার ক্যাবিনেটের সিনিয়র মিনিস্টার মশিউর রহমান যাদু মিয়া। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সময়ে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কত ধরনের রহস্যময় ভূমিকা ছিল, তা পাঠকদের অনেকে জেনে থাকবেন। সেই মশিউর রহমান যাদু মিয়ার আপন বড় ভাই মোখলেসুর রহমান সিঁধু মিয়া (আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের বাবা) জীবিত থাকাবস্থায় এক বড় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রয়াত সরদার ফজলুল করিম ও প্রয়াত অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমান সম্পাদিত ত্রয়মাসিক পত্রিকা ‘প্রতিচিন্তা’য় ২০১৪ সালে অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। পাঠকদের আগ্রহ থাকলে অনলাইনে দেখে নিতে পারেন। সেই সাক্ষাৎকারে এক জায়গায় (পত্রিকার ১১৮ নম্বর পৃষ্ঠায়) এভাবে :
“… জিয়াউর রহমান কিন্তু বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। তিনি শেষের দিকে যা কিছুতে সই করতেন, সেটা করতেন শুধু বাংলায় ‘জিয়া’ লিখে। আপনারা যদি তাঁর স্বাক্ষর করা ফাইল ইত্যাদি দেখেন, তাহলে এই ব্যাপারটা লক্ষ করবেন। করাচিতে তিনি লেখাপড়া শিখেছেন। যৎসামান্য বাংলা বলতে পারতেন। বাংলা লেখাপড়া কিছু জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। লিখে তারপর তা-ই দেখে দেখে ভাষণ দিতেন…।”
জিয়াউর রহমানের শাসনামল নিয়ে যে অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি সেটি হচ্ছে, যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক বিরোধিতা করেছিল কিংবা পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুগত ছিল, তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শাহ আজিজুর রহমান। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদ নেতা নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক সরকার জাতিসংঘে যে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল, সেটির অন্যতম সদস্য ছিলেন শাহ আজিজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর দালাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয় শাহ আজিজুর রহমানকে। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ১৯৭৩ সালে মুক্তিলাভ করেন শাহ আজিজুর রহমান।
পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করেছেন। আসলে জিয়াউর রহমানের বিএনপি কীভাবে গঠিত হয়েছিল, তা ইতিহাসের পাঠকরা খুব ভালো করেই জানেন। জিয়াউর রহমান এক চিমটি মুক্তিযোদ্ধা, একমুঠ রাজাকার-আলবদর-আলশামস, এক জগ সমাজের নানা উচ্ছিষ্ট অংশ ঘোঁটা দিয়ে বানিয়েছিলেন বিএনপি।
১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল মহান জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাজাকারদের বিচারের দাবিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার কিছুটা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো :
“মাননীয় স্পিকার,
এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, এতদিন পর আমাদের প্রমাণ করতে হচ্ছে, গোলাম আযম রাজাকারপ্রধান ছিলেন কি না? গোলাম আযম যে একজন হত্যাকারী ছিলেন, তার একটি প্রমাণ আমি এখানে দিচ্ছি। হোমনা থানার প্রতিনিধি নিশ্চয়ই এখানে আছেন। কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সিরু মিয়া দারোগা ও তার কিশোর পুত্র আনোয়ার কামালকে গোলাম আযমের লিখিত পত্রের নির্দেশে হত্যা করা হয়। সিরু মিয়া দারোগা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ট্রেনিং ও অপারেশন চালাতেন। ’৭১-এর ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা এবং তার একমাত্র কিশোর পুত্র আনোয়ার কামাল মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার সময় অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। সিরু মিয়া দারোগা মুক্তিযুদ্ধে অনেক দুঃসাহসিক কাজ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কাজ তিনি করেছিলেন যে, তিনি আমাদের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী বেগম তাজউদ্দীনকে সপরিবারে কুমিল্লা সীমান্ত পার করে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সেই সিরু মিয়াকেও গোলাম আযমের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল। তার নজির ও প্রমাণ (একখানা কাগজ দেখিয়ে) এই কাগজে রয়েছে। আপনি চাইলে এই কাগজও আমি আপনার কাছে দিতে পারি।
মাননীয় স্পিকার,
আজকে আমরা আইন হাতড়ে বেড়াচ্ছি যে কোন আইনে তাকে বিচার করা যায়। এখানে বিএনপির ব্যারিস্টার সাহেবরা অনেক কথাই বলেছেন। আজকে আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমরা Act XIX of 1973 (আন্তর্জাতিক ক্রাইম অ্যাক্ট) উল্লেখ করেছি। এই অ্যাক্টের ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই বিষয়ে বিচার করা যেতে পারে বলে আমাদের সদস্যরা যে প্রস্তাব রেখেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে নানা রকম অজুহাত দেখাচ্ছেন। গোলাম আযম একজন নরঘাতক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে যারা বিশ্বাস করে তাদের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমরা জানি, অন্তত এ বিষয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই।
মাননীয় স্পিকার,
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৩৭ হাজার দালাল বন্দি হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১১ হাজার দালাল তখনো বন্দি ছিল এবং তাদের বিচারকাজ চলছিল। এর মধ্যে অনেক বন্দি সাজাপ্রাপ্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি এই সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য তো বঙ্গবন্ধু অ্যাক্ট করে রেখেছিলেন, সেটা হলো Act XIX of 1973 (আন্তর্জাতিক ক্রাইম অ্যাক্ট) এবং সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, এদের বিচার করা যাবে। যারা যুদ্ধাপরাধী, বিশেষ করে যারা গণহত্যা চালিয়েছে, যারা লুটতরাজ করেছে, যারা নারী ধর্ষণ করেছে, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের বিচারের জন্য—
* ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করা হয়। P.O. No. VIII of 1972.
* ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নিজ নিজ জেলা কোর্টে অধ্যাপক গোলাম আযম গংদের হাজির হওয়ার নির্দেশ জারি হয়েছিল।
* ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি করা হয়। P.O. No. 149 of 1972.
* ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
* ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত করা হয়।
* ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়।
* ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের আমি আগেই বলেছি, যারা গণহত্যা করেছে, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ করেছে সেই অপরাধীদের ক্ষমা করা হয়নি। এই আইনগুলো বঙ্গবন্ধু করেছিলেন।
মাননীয় স্পিকার,
তবে যেহেতু সময়ের অভাব, আমি বেশি সময় নেব না। এখানে একটি বই পাবলিশ করা হয়েছিল ‘WAR CRIMES AND GENOCIDE : The trial of Pakistan war criminal’ এই বইটির ভেতর আপনি পাবেন কীভাবে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীরা তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল। এর মাধ্যমে সারা দেশ এবং বিশ্বে এটা প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ‘WAR CRIME AND BANGLADESH : The details of humanity and justice’ এগুলোতে যারা ওয়ার ক্রাইম করেছিল তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ব্যাপক হারে প্রচার করে, তাদের চরিত্র তুলে ধরার ব্যবস্থা তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকার করেছিল। আরও একটি বই রয়েছে ‘THOUSAND MY LAIS’ বিভিন্ন সময়ে এই যুদ্ধাপরাধীদের চিত্র তুলে ধরেছিল, আওয়ামী লীগ বিচারের ব্যবস্থা নিয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যবস্থা রহিত করা হলো কখন? মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে।
মাননীয় স্পিকার,
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘দালাল আইন’ বাতিল করা হয় Ordinance No. 63 of 1975.
* এরপরে ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Second Proclamation Order No. 3 of 1975 প্রথম তপশিল থেকে বাংলাদেশ দালাল আইনের যে সেফগার্ড ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়।
* এরপর ১৯৭৬ সালে Second Proclamation Order No. 3 of 1976 জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেওয়া হয়।
* Second Proclamation (ঘোষণা) জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।
* Proclamation Order No. 1 of 1977 জারি করে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেওয়া হয়।
* ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয়। এবং
* Proclamation Order No. 1 of 1977 দ্বারা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হয়।
এখানে আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, মাননীয় স্পিকার, এসব কিছুই করা হয়েছিল কোনো সংসদের মাধ্যমে নয়; বরং মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে।”
জাতির পোড়া কপাল যে, সেই পাকিস্তানি ভাবধারার জন্মসূত্রে পাওয়া বিধ্বংসী রাজনীতি থেকে বিএনপি এক মুহূর্তের জন্য ত্যাগ করেনি। ক’বছর আগেও খালেদা জিয়া দেশবাসীকে অবাক করে বলেছিলেন, ‘৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা বোকা ছিল, তাই তারা মৃত্যুবরণ করেছেন।’ এক বছর আগেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিল।’ সেই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আছেন কেন? পাকিস্তানে চলে যান।’ সে সময়কার খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র আরিফ রহমান ২০১৮ সালে একটা বই লেখেন। সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত সেই বইয়ের নাম ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ/বাহুল্য না বাস্তবতা’। সেই বই থেকে ক’টি লাইন লেখার এই অংশে যুক্ত করলাম :
“প্রিয় পাঠক খুব কি কষ্ট হচ্ছে দেখতে যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মৃত্যুহার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। গল্পটা এখানেই শেষ হয় না, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ওপর জাতিসংঘের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯৫০-৫৫ সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৬, ১৯৫৫-৬০ সালে ১৫.৩, ১৯৬০-৬৫ সালে ১৫.৩, ১৯৭০-৭৫ সালে হঠাৎ এটা হয়ে যায় ৫.৫, আবার ১৯৭৫-৮০ সালে ১৪.২, ১৯৮০-৮৫ সালে ১৪.৫ এভাবে চলছে।”
২০-২২ বছরের এক যুবক প্রতিবাদ করে যখন বই লেখেন, তাতে খুবই আশাবাদী হওয়া যায়। আজকের নতুন প্রজন্ম বিএনপির এই পাকিস্তান-প্রেম কখনোই মেনে নেবে না।
সুভাষ সিংহ রায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষক