১৯৯৯ সালের কথা। আমার জাপানে আসার এক বছরও হয়নি। মাঝে মাঝেই দেশে সবার সঙ্গে বিশেষ করে মার সঙ্গে কথা বলতে ভীষণ মন চাইত। এখনকার মতো তখন মোবাইল ফোনের এত প্রাচুর্য ছিল না। ল্যান্ডফোনগুলোও শহরকেন্দ্রিক। হারিকেন, কুপি (আমাদের গ্রামে নেম্পো বলে) দিয়ে পড়াশোনা করে বড় হওয়া আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ তখনো যায়নি। আর ল্যান্ডফোন তো দূরের কথা। মার সাথে কথা বলা মানে সে এক বিরাট ব্যাপার।
মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা আর স্পেস স্যাটেলের উৎক্ষেপণের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পেতাম না। উৎক্ষেপণের দিন, মানে কথা বলার দিনক্ষণ ঠিক করা। দিনটা কথা বলার জন্য ঠিক কি না তার একটা খসড়া পরখ দরকার। না, স্পেস স্যাটেলের মতো আবহাওয়া আমার প্রতিপক্ষ না। আমার প্রতিপক্ষ টেলিফোনের মালিক ও তাদের মর্জি। গাইবান্ধার টেলিফোন মালিকদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে সময়টা ঠিক করা। দিনক্ষণটা যেন আমার মার কাছে ঠিকমতো পৌঁছে সেটার ব্যবস্থা করা। সেটার ফিডব্যাক, মানে মা জেনেছেন কি না? সেটা আমার ব্যস্ত মস্তিষ্কে ইনপুট করা। এরপর অপেক্ষার পালা। নভোচারীরা জিরো গ্রাভিটিতে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করে আর আমি ক্যালেন্ডারের পাতার ডেটগুলোকে মাল্টিকালারে ভরিয়ে তুলি। কাউন্টডাউন শুরু হওয়া পর্যন্ত একেকটা দিনকে এক যুগ মনে হতো।
শারীরিক অসুবিধা না থাকলে মা অবশ্যই আসবেন। কথা বলার দিন শুধু ঘড়ি দেখার পালা। অপেক্ষার পালা শেষ হলে নম্বরে ডায়ালের সময় কম্পমান হাতে একেকটা নম্বর ডায়াল করা। মনে হতো আমার হাত দিয়ে কোনো বিধ্বংসী বোমাকে ডিফিউজ করতে তারগুলোকে একটা একটা করে কাটছি। পয়সা বাঁচাতে কার্ড ফোনের আশ্রয় নেওয়ায় একস্ট্রা নম্বরে ডায়াল করতে হতো অনেক। বাঘের ভয়ে রাত নামার মতো আমি সিরিয়াস থাকলেও ভুল আমাকে ছাড়তো না। একটা ডিজিটের মিস মানে, কেঁচে গন্ডুশ বাগধারার দ্বিতীয়বার রিভিশন। আবার ডায়ালে সাকসেসফুল হলেও লাইনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসত বেরসিক শব্দ—দুঃখিত! এই মুহূর্তে…। হাজারো বাধা অতিক্রম করে লাইন পেলেই কেমন আছিস বাবা…। তারপরেই কান্নার শব্দ পেতাম। নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেও পারতাম না। নায়াগ্রার রিজার্ভের চেয়ে আমার চোখে মনে হয় পানির রিজার্ভ বেশি থাকত।
মাঝে মাঝে মা অপেক্ষা করতেন টেলিফোনের পাশে। এদিকে আমি লাইন পাচ্ছি না। মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা আমি। টেলিফোনের বাটন চাপতে চাপতে আঙুলে ব্যথা হয়ে যেত। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হতো না। একরাশ কষ্ট নিয়ে কাটিয়ে দিতাম দিনের বাকি সময়গুলো। সহধর্মিণীর সান্ত্বনাও আমার কষ্টটাকে দূর করতে পারত না।প্রতীকী ছবি
এ ভাবে কয়েক বছর কাটিয়েছি। এরপর ওপরওয়ালার মনে হয় মুখ তুলে চাওয়ার সময় হলো। আমাদের গ্রামেও মুঠো ফোন ব্যবহার হতে লাগল। নাতি নাতনিদের মোবাইলের ব্যবহার দেখে মাও দাবি করল তার একটা ওই রকম কথা বলার যন্ত্র চাই। অন্যের মোবাইলে কথা বলতে তার প্রাইভেসি থাকে না। আমিও কিনে দিলাম কথা বলার যন্ত্র। তারপর থেকে আর আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়নি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল যন্ত্রটাকে হ্যান্ডেল করা নিয়ে। নাতি নাতনিরা হাসাহাসি করলেও মা দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতেন সবাইকে। ফোন করলেই শুনতাম কোনো নাতিকে ধমক দিয়ে বলছেন, এই সাউন্ডটা একটু বাড়ায়ে দে! কথা শুরু হলে আর থামত না। আমি শুধু শুনেই যেতাম। বিবিসির খবরের মতোই আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের সব খবরই পেয়ে যেতাম মার কাছ থেকে। তবে শুরুটা করত এই বলে, কি দিয়া ভাত খালু বাবা (কি দিয়ে ভাত খেয়েছ)? আমাদের ডিজিটাল কথোপকথন চলছিল পুরোদমে। হঠাৎ কথা বলার যন্ত্রটা রিটায়ার্ড করে বসল। চাইনিজ জিনিস তাই একটু আরলি রিটায়ারমেন্টে গেল। কিনে দিলাম নতুন আর একটি। আমাদের মা ছেলের কথোপকথন মনে হয় বেরসিক চোরের ভালো লাগেনি। এক রাতে চুরি করে নিল আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমটিকে। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিনে দিলাম আর একটি। এবার বাঁধ সাধল বয়স। আমি এখন চিৎকার করে কথা বললেও মার কানে সেগুলো আর যায় না। বয়সের কারণে মার শ্রবণশক্তি কমতে লাগল। এখন শুধু ওয়ান সাইডেড কথোপকথন চলে।
গত বছর মাকে দেখলাম। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ১০ জনকে পৃথিবীর আলো বাতাস দেখানো মা আজ নিঃস্ব। চোখে মুখে একরাশ আক্ষেপ। চোখের চাহনি দেখেই বোঝা যায় হাজারো অভিযোগ জমা হয়ে আছে আমার কাছে দাখিলের জন্য। হুংকার দিয়ে ভাবিদের দমিয়ে রাখা মার কথা আজ শুধুই আকুতি। বধিরদের মতো শুধু শুনতে হবে অভিযোগগুলো। আমি আলাদীনের চেরাগের দৌত্য নই যে এক চুটকিতেই মার সব আশা পূরণ করে দেব। আমি পালিয়ে বেড়ানো এক যাযাবর। নিজের ভালো খুঁজতে উদ্দেশ্যহীন ক্যারাভানের সওয়ারি আমি। মার অভিযোগের সমাধান দেওয়ার সামর্থ্য ও সময় কোনোটাই যে নেই আমার।
(মো. মাহবুবর রহমান, তোত্তরি (জাপান) ,লেখক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)