অনলাইন ডেস্কঃ ৩০ জুলাই ২০১৫
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদন্ডাদেশ আপিল বিভাগ বহাল রাখায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিজনেরা।
তবে রায় দ্রুত কার্যকর না হলে তাদের সেই ‘সন্তুষ্টি’ স্বস্তিতে রূপান্তর হবে না বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
সাকার রায় ঘোষণার পর গ্লিটজের সঙ্গে কথা হয় অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ, শমী কায়সার, শামীমা তুষ্টি, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী আপেল মাহমুদ, শান্তনু বিশ্বাস, নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের। ১৯৭১ সালে তারা কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ ভাই, কেউ প্রিয় স্বজনকে, কেউ লড়েছেন রণাঙ্গণে।
সাকা যেন এক মূর্তিমান দানব: রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব(শহিদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর বোন ফেরদৌসী মজুমদারের স্বামী)
সাকার মৃত্যুদন্ড উচ্চ আদালতেও বহাল রয়েছে, এটা খুব খুশির খবর। যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী কখনও কাউকে পরোয়া করত না। সাকা তার প্রতিটি কথায় বাঙালি জাতিকে, আমাদের জাতিস্বত্তাকে অপমান করেছে। বাঙালির প্রতি তার অবজ্ঞার শেষ নাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো বটেই, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সে চট্টগ্রামবাসীর কাছে ছিল মূর্তিমান দানব। তার মতো নৃশংস, ঘৃণ্য অপরাধীর শাস্তি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
আরেকটি কথা, সাকাকে বিচারের মুখোমুখি করতে এই যে এত বছর সময় লেগে গেল, তার দায়ভার কিন্তু অনেকাংশেই আমাদের। আমরা যারা সাধারণ ভোটার, তারাই তো বারবার সাকাকে ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার সুযোগ দিয়েছি। দ্রুতই এই ঘৃণ্য বর্বরের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হোক।
আমি দেখতে পাচ্ছি, সাকা ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে: শিমুল ইউসুফ(শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদের শ্যালিকা)
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে সাকাকে অবশেষে বিচারের মুখোমুখি করা গেল। কী যে আনন্দ লাগছে! মঙ্গলবারের রাতটি আমার নির্ঘুম কেটেছে। আমি আর বাচ্চু (নাসিরউদ্দিন ইউসুফ) সারারাত একাত্তর ও তার পরে সাকার দৌরাত্ম্য নিয়ে কথা বলছিলাম। লোকটি এত বিশ্রীভাবে কথা বলত, এত অশ্রাব্য ভাষায় বাঙালিকে অপমান করেছে যা বলার ভাষা নেই। তার নির্যাতনের ধরন ছিল একেবারেই আলাদা।
একদিন সাকার গাড়িতে আমাদের জাতীয় পতাকা উড়েছিল। সেদিন অপমানে, ঘৃণায় আমি চিৎকার করেছিলাম। জাতির জীবনে সেই কলঙ্কটাকে যত দ্রুত ফাঁসি দেওয়া হবে, ততই মঙ্গল।
রায় কার্যকরের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘আমি ফেলনা নই: রায় শুনে সাকা’ শিরোনামের খবরটি পড়েছি আমি। সাকার প্রতিক্রিয়া দেখলাম। সে এখনো কত দাম্ভিক! তবে যতই হম্বিতম্বি করুক, সাকাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতেই হবে। আমি দেখতে পাচ্ছি, সাকা ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে। সে দিনটির অপেক্ষায় আমি।
ফাঁসির রায়কে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগ পাবে সাকা, রাষ্ট্রপতির কাছেও প্রাণভিক্ষার সুযোগ আছে তার। সাকাও আইনের ফাঁকফোকড় গলাতে চেষ্টা করবে। তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী অনেক হম্বিতম্বি করবে। তবে শেষ পর্যন্ত সাকা ফাঁসিতেই ঝুলবে।
রায় দ্রুত কার্যযকর করা হোক: শমী কায়সার(শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে)
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত সাকা চৌধুরীর কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই। একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মও জানে সাকার নৃশংসতার কথা। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কথা দেশবাসী জানে। তারপরও তার বিচার নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু সাকার বিরুদ্ধে সত্যি অভিযোগগুলো প্রমাণিত হল। সরকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, আমি চাইবো এবার দ্রুত রায় কার্যকর করা হোক।
সাকা যতদিন বেঁচে থাকবে, স্বস্তি পাবো না: শিবলী মহম্মদ(শহীদ মহম্মদ সলিমউল্লাহর ছেলে)
সাকার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আমি আনন্দিত, কিন্তু আমি স্বস্তিতে নেই। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আমরা অপেক্ষা করছি, এরা কবে বিচারের আওতায় আসবে। সাকার মতো বর্বর, ঘৃণ্য অপরাধী পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সাকা যতদিন বেঁচে থাকবে, স্বস্তি পাবো না আমি। সাকা মারাত্মক চালাক, মহা ধুরন্দর। সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে তার দহরম-মহরম। সে আইনের ফাঁকফোকড় গলে বেরুতে চাইবেই। তাই তাকে যত দ্রুত ফাঁসি দেওয়া হবে, ততই মঙ্গল। সাকা যদি একবার বের হতে পারে, তবে গোটা জাতির জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। আবারও সে নারকীয় কোনো কাণ্ড বাধিয়ে বসবে।
সাকা বলেছিল, এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্ম্য যায়নি: আপেল মাহমুদ(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও তিন নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা)
মুক্তিযুদ্ধের সময়ই সাকার বর্বরতার কথা আমি শুনেছি। আমি ভাবতাম, আমি যদি সাকার মুখোমুখি হতাম, তবে সাকা কি এতদিন বেঁচে থাকত! সাকা বেঁচে গেছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর সাকা ঠিকই ফাঁসিকাষ্ঠের সামনে। সাকার একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। বিটিভিতে তখন মহাপরিচালক ছিলেন ফেরদৌস আরা বেগম। তার একটি অনুষ্ঠানে এসে আমাদের দেখতে পেয়ে বলে বসলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্ম্য দেখছি কমছে না’। সেদিনের কথা ভুলিনি আমি।
সাকার রায়ের আগে বেশ কজন রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। এদের বিচার দ্রুত কার্যকর করা না হলে, দেরি করলেই বিপদ। আমাদের সত্যি ভাবনা হয়, এরা আবার ছাড়া পেয়ে যাবে না তো!
গুডহিলে এখনো যেন মৃত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়: শান্তনু বিশ্বাস(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, শহীদ অতনু বিশ্বাসের ভাই)
মুক্তিযুদ্ধে সাকাবাহিনী মেরে ফেলেছিল আমার ভাই অতনু বিশ্বাসকে। আমার বাবা শিলরঞ্জন বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিলো। সেদিনের সেই ক্ষত নিয়ে বেড়াচ্ছেন আমার বাবা। চট্টগ্রাম শহরের গুডহিল আমাদের কাছে ছিল একটা নরক। সাকার নির্যাতনের ধরন ছিলো সবার চেয়ে আলাদা। সে চাইনিজ স্টাইলে মানুষ জবাই করত। একটু একটু করে মাংস কেটে নিত। যন্ত্রনায় আর্তচিৎকার করতে করতে মারা যেত অসহায় মানুষগুলো। গুডহিলে কান পাতলে এখনও শোনা যায় মৃত আত্মাদের হাহাকার। তাদের অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় গুডহিলের চারপাশে।
স্বাধীনতার পরেও সাকা ছিলেন চট্টগ্রামের ত্রাস। নির্বাচনী মৌসুমে রাঙ্গুনিয়া, রাউজানের সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট করা ছিল তার নিত্যকর্ম।
সাকার শাস্তি ফাঁসি, এতো কমই হয়ে গেল। তার শাস্তি হওয়া উচিত নৃশংস উপায়ে। তবে আইন তাকে সর্বোচ্চ শাস্তিই দিচ্ছে, এটা সত্যি আনন্দের। তবে তা দ্রুত কার্যকর না হলে কিন্তু স্বস্তি নেই আমাদের।
বাবা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেখে যেতে পারছেন: শামীমা তুষ্টি( স্বাধীনতার প্রথম পতাকা বহনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিবুল ইসলামের কন্যা)
আমার বাবাই সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন, লড়েছিলেন রণাঙ্গনে। বাবার ওড়ানো সে পতাকা যখন যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে উড়ছিল, বাবার কষ্ট কত তীব্র হয়েছিল তা আমি জানি। বাবা বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন, অনেক আশা নিয়ে বুক বেধেছিলেন। আজ সেই খুশির দিন। একজন একজন করে যুদ্ধাপরাধী ফাঁসিতে ঝুলছে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাবা যেমন আনন্দিত, আমিও আনন্দিত। বাবার স্বপ্ন যে সত্যি হল। ( সুত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ জুলাই ২০১৫)