বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকথাঃ সেইসব স্বপ্নের দিন

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকথাঃ সেইসব স্বপ্নের দিন

১৮ই জুন বৃহ্সপতিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম ক্লাস। জীবনের নতুন দিন, নতুন স্বপ্ন। প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস শেষ করে সকাল ১১ টায় খ ইউনিট এর ডীন অফিসের সামনে থেকে রিকশা নিয়েছি পাবলিক লাইব্রারির উদ্দেশ্য। রিকশায় শর্মি আমার সাথে। মধুর ক্যান্টিনের সামনে রিকশা, ঠিক তখনই গুলির শব্দ, ককটেলের শব্দ, ধোঁয়া চারিদিকে আতংকগ্রস্ত ছাত্রছাত্রীর ছুটাছুটি ভয়ানক অবস্থা ক্যাম্পাসের চারপাশে। শর্মি তো রীতিমতো ভয়ে নীল হয়ে গেছে, রিক্সায় বসে তামাশা দেখবে নাকি নেমে দৌড়াবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। কূলকিনারা না পেয়ে রিক্সাওয়ালাকে দোষারোপ করছে, কেন সে মধুর ক্যান্টিনের সামনে এলো। এই ছিল আমাদের ক্যাম্পাসের প্রথম অভিজ্ঞতা। আসলে এটা কোন গোলাগুলী ছিলনা, ছিল নবীন বরনের আতশবাজি আর আনন্দ মিছিল। কলেজ পেড়িয়ে কেবল বিশাল ক্যাম্পাসে এসেছি তখন, এ জাতীয় কোন আগমনী আয়োজনের ধারণাই ছিলনা আমাদের।

একটা সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আসা। কলা বা মানবিক এবং বাণিজ্য বিভাগ থেকে ইন্টারমিডিইয়েট পাস করা প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর প্রথম ইচ্ছা-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীর বুয়েট, মেডিক্যাল বা অন্য কোথাও ভর্তির সুযোগ থাকায় মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের একটাই স্বপ্ন থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস মুখরিত করা। ভর্তি পরীক্ষায় লিখিত পরীক্ষার পর যখন মৌখিক পরীক্ষা দিতে গেলাম বোর্ডের টিচাররা আমাকে পছন্দের সাবজেক্ট কি জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, ফিলসফি’। কেন বলেছিলাম জানিনা, উত্তরটা শুনে সাথে সাথে আমাকে ফিলসফি সাবজেক্ট এ বরাদ্দ দিয়ে দেয়া হোল। এই মেয়ে ইচ্ছে করে ফিলসফি পড়তে চায় তাই শুনে ওদের দৃষ্টিতে অবাক প্রশ্ন ছিল তা আমার আজও মনে পরে। পরে অন্য বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ থাকা ও পারিবারিক চাপাচাপি সত্ত্বেও আমি শেষ পর্যন্ত ফিলসফি পড়াটাই আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছিলাম। সেই থেকে এখনো জগৎ ও জীবনের জটিলতা ও রহস্য নিয়ে চিন্তা করতে ভালো লাগে।

 

SeemeDU1

আবাসিক ছাত্রী হিসাবে রোকেয়া হল বরাদ্দ পেলাম। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হোল, কেননা  বেগম রোকেয়া সেই সময়ে এক আদর্শ ছিল আমার। তাছাড়া কলা ভবন থেকে একেবারেই কাছে,  রাস্তা ক্রস করলেই ক্লাসে যাওয়া যায়। রিক্সা ভাড়া লাগেনা, শামসুন্নাহার বা কুয়েত মৈত্রী হল হলে যখন তখন ক্যাম্পাসে আসা মুশকিল। প্রথমে শেয়ার করা হলেও অল্প কদিন পর নিজস্ব সিট পেলাম। আমাদের সময়ে ছাত্রদের হল গুলোর চেয়ে ছাত্রী হলগুলোতে সীট সমস্যা কম ছিল। রাজনৈতিক দখলদারিত্ব তেমন ছিলনা। সব দল থেকেই সদস্য হবার আমন্ত্রণ জানানো হতো জোরজবরদস্তি একেবারেই নেই। ভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সমর্থকেরা ছাত্রী হল গুলোতে পরস্পর সহঅবস্থান করলেও বিদ্বেষ বা হিংসাত্বক কর্মকাণ্ড একেবারেই ছিলনা। আমাদের সময়ে হলের গেট বন্ধ হতো শীতকালে সন্ধ্যা ৬টায় এবং গ্রীষ্মকালে ৭টায়। গেট বন্ধ হবার ৫ মিনিট আগে ঘণ্টা পেটানো হতো, বিষয়টা ছিল খুবই আপত্তিকর। সন্ধ্যায় ঘণ্টা বাজানো হলে ছেলেরা ঠাট্টা করে বলতো ঘোড়ার পাল গোয়ালে যাও তোমাদের ঘণ্টা পেটানো হচ্ছে। এই অপমানজনক অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার জন্য পরবর্তীতে সকল সাধারণ ছাত্রীরা ঐক্যজোট হয়ে সন্ধ্যা ৭টার পরিবর্তে ৯টা পর্যন্ত গেট খোলা রাখার দাবী আদায় করলো এবং ঘণ্টা পেটানো ও বন্ধ হল। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মেনে নিয়েছিলো এজন্য যে সেন্ট্রাল লাইব্রেরী খোলা থাকতো রাত ৯টা পর্যন্ত। ছেলেরা যদি ৯টা পর্যন্ত লাইব্রেরীতে থাকতে পারে তাহলে মেয়েরা থাকতে পারবে না কেন! এই যুক্তিতে দাবী আদায় সহজ হয়েছিল। আমার জন্য বিষয়টি অপরিসীম আনন্দের কেননা আমার বেশির ভাগ সময় কেটেছে লাইব্রেরীতেই, আমার বন্ধুরা জানতো নিশিচত একটি জায়গায় আমাকে পাওয়া যাবে সেটা হল লাইব্রেরী। সোহেল, এমদাদ, ফারুক, চয়ন, শিলা, আদিতি আরো কতো কতো দুষ্ট ও মিষ্টি বন্ধুদের অমিয় সহচর্যে কেটেছে অনেক সোনালী বিকেল।

নতুন আশা নতুন উদ্দীপনা আর গর্বিত উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রতিটি ক্লাস করে গেছি। এমন কি সাবসিডিয়ারি ক্লাস পর্যন্ত নিয়মিত করতাম। ফাস্ট ইয়ারে কম ক্লাস ছিল বলে খুব আফসোস হতো। কলা ভবন, অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন, রোকেয়া হল, টিএসসি, ডাকসু- স্বপ্নের জায়গা গুলোতে আজ আমার নিজস্ব ঠিকানা, অগুনতি পদচারনা, নিরন্তর স্বপ্নবোনা এ এক অনির্বচনীয় অনুভব। তুলনামূলক ভাবে আবাসিক ছাত্রীরা ক্যাম্পাস জীবনের যতোটা গভীর আমেজ পায়, স্বাধীনতা পায় অনাবাসিক ছাত্রীরা ততোটা পায়না বলে আমার মনে হয়। কেননা ওরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিদৃষ্ট সময়ে আসে আবার ক্লাস শেষে বাসের সময় ধরে চলে যেতে হয়। আমরা যারা ক্যাম্পাসেই থেকেছি বিশেষ করে রোকেয়া হলে- পুরো ক্যাম্পাসটাই যেন আমাদের নিজস্ব বাসভূমি। আমি সেই সৌভাগ্যবতীদের একজন, জীবনের অনেক গুলো বছর একান্ত ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষন, প্রতিটি ঘটনা কাছ থেকে দেখেছি, নিজের করে অনুভব করেছি। এ যেন রন্ধে রন্ধে বয়ে যাওয়া এক অভাবনীয় শিহরণ! ভালোলাগা, ভালোবাসার অকল্পনীয় তৃপ্তি- যার কোন বিকল্প নেই কোনদিন হবেও না!

পড়াশোনার পাশাপাশি ডাকসু সাংস্কৃতিক দলে নাটক বিভাগে সদস্য ছিলাম। সেই কারণে নিজের ডিপার্টমেন্ট ছাড়াও অন্যান্যদের সাথেও আমার বেশ বন্ধুত্ব ছিল। বাবুলভাই, কায়সার, শিমাব, কিরণ, নদী, সাগরিকা, রুনা আপা-প্রিয় প্রিয় মুখ গুলো ছিল আমার ভালোলাগার বন্ধন। যারা আমাকে কাছ থেকে দেখেছে একজন অতি নিশচুপ’ আর সবচে শান্ত’ এক সুবোধ বালিকা রূপে।   ডাকসু থেকে রেডিওতে যুব-তরঙ্গ’ অনুষ্ঠানটি নিয়মিত পরিচালনা করা হতো, সেই সুবাদে রেডিওতে ও কণ্ঠ দিয়েছি। পরবর্তীতে ডাকসু থেকে মঞ্চ নাটক ও করেছিলাম, সাথে আবৃতি তো ছিলই। সংস্কৃতির প্রতি সেই অনুরাগ থেকে একদিন নাট্যদল এশিয়ান থিয়েটারের” নিয়মিত সদস্য হয়ে গেলাম। কি যে মোহময়ী আনন্দে ভরা ছিল সেইসব দিন সে বলে শেষ করার নয়। তৃপ্তি ও অতৃপ্তির দোলাচলে কেটেছে কতো অগুনতি প্রহর- দুর্লভ সুখ জাগানিয়া সেই সব স্মৃতি শত বাস্ততায়ও আজ অমলিন, সচ্ছ আর কতো নিরেট। এতোসব অনর্গল আনন্দে ও ভালো রেজাল্ট করাটা ছিল আমার সহজাত প্রচেষ্টা। কথাটা না বলে পারছিনা, সব কিছুর পর ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিটি পরীক্ষায় প্লেইস’রেখে, স্কলারশীপ পেয়ে ক্যাম্পাস জীবনের সোনালী সমাপ্তি টেনেছিলাম।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আমার জীবনে সবচে আনন্দময় এবং সবচে সাফল্যময় স্মৃতি-যে  স্মৃতিচারণের কোন শেষ নেই এ যেন, এ সুখের নেই কোন সীমানা—

seeme

 

 

 

 

 

(কাজী সুলতানা শিমি)