অনলাইন ডেস্কঃ ০৩ অক্টোবর ২০১৫
গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মো. মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের ছোড়া গুলিতে শুক্রবার ভোরে সৌরভ মিয়া (৯) নামে এক শিশু গুরুতর আহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আশঙ্কাজনক অবস্থায় সৌরভকে প্রথমে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সৌরভ ওই উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়নের গোপালচরণ গ্রামের সাজু মিয়ার ছেলে। সে হুড়াভায়া খাঁ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র।
এদিকে এই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে সুন্দরগঞ্জ। মিছিল সমাবেশ করে এলাকার লোকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শিশুটি শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টায় তার এক নিকট আত্মীয়সহ রাস্তায় ব্যায়াম ও হাটাহাটি করছিল। এ সময় সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার ব্র্যাক মোড় গোপালচরণ এলাকায় সে গুলিবিদ্ধ হয়।
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ ও পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এসময় শিশুটির গুলিবিদ্ধ হওয়ার সত্যতা স্বীকার করলেও তারা বলেন, তদন্ত শেষে বলা যাবে কে গুলি করেছে। তারা আরও বলেন, ঘটনার সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শুক্রবার বিকেলে পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, রংপুরে চিকিৎসাধীন শিশুটিকে তিনি দেখেছেন। তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়া হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুন্দরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জিন্নাত আলী গুলিতে শিশু আহতের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও কিভাবে বা কে গুলি করেছে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। তিনি জানান, খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে যান। পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল হাই মিলটন জানান, শিশুটিকে বহনকারী গাড়ি আটক করার কথা শুনে তিনি ঘটনাস্থলে যান। তবে কিভাবে শিশুর পায়ে গুলি লেগেছে এ বিষয়ে তিনিও নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের রেজিস্ট্রার ডা.মাহফুজুল ইসলাম জানান, অপারেশন করে শিশুটির দুই পায়ের গুলি বের করতে হবে।
এমপির গুলিতে শিশু আহত, উত্তাল সুন্দরগঞ্জ এ ব্যপারে সংসদ সদস্য মো. মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিবারের অভিযোগে জানা গেছে, সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ভোরে তার নিজস্ব গাড়িতে করে বামনডাঙ্গা থেকে সুন্দরগঞ্জ যাচ্ছিলেন। এসময় তিনি বামনডাঙ্গা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ব্র্যাক মোড়ের পশ্চিম পাশে গোপালচরণ এলাকায় পৌঁছে সাজা মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে তার গাড়িতে উঠতে জোরাজুরি শুরু করেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি তার অকথ্য গালিগালাজ ও আচরণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তার গাড়িতে না উঠে দৌড়ে পালায়। এতে ক্ষীপ্ত হয়ে সংসদ সদস্য লিটন তাকে লক্ষ্য করে রিভলবার দিয়ে এলোপাতাড়ি পরপর ৫ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এর মধ্যে ২টি গুলি রাস্তার ধারে ব্যায়ামরত সৌরভের দুই পায়ে গিয়ে লাগে এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাজুল ইসলাম নামে অপর এক ব্যক্তির পরিধেয় কাপড় ভেদ করে একটি গুলি বেরিয়ে যায়। সৌরভ এসময় চিৎকার করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। গুলির শব্দে ও সৌরভের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছুটে এলে সংসদ সদস্য গাড়ি নিয়ে দ্রুত সরে পড়েন। এলাকাবাসী প্রথমে তাকে উদ্ধার করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। তার শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে তাকে সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু সার্জারী বিভাগে ১৮নং বেডে ভর্তি করা হয়।
এর আগে আহত শিশুটিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রংপুর নিয়ে যাওয়ায় পথে সংসদ সদস্যের নিজ এলাকা বামনডাঙ্গায় তার লোকজন অ্যাম্বুলেন্সটি জোর করে আটকে ড্রাইভারকে নামিয়ে দিয়ে চাবি কেড়ে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আটক করে রাখে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচার হতে শুরু হলে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গিয়ে শিশুটিকে রংপুর পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
বাবা সাজু মিয়া বলেন, প্রতিদিনের মত ভোরে সৌরভ রাস্তায় হাঁটতে এবং ব্যায়াম করতে বেরিয়েছিল। এমপি কেন তাকে গুলি করলো তা তার বোধগম্য নয়। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন। মোবাইল ফোনে শিশু সৌরভ জানায়, ‘কোন দোষ না করিয়াও এমপি মোক গুলি করিল ক্যান। তা মুই বুজনু না। মোর সাতে কিসের শত্রুতা ওমার।’
এমপির গুলিতে শিশু আহত, উত্তাল সুন্দরগঞ্জ এদিকে পুলিশ ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী শিউলি বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে গেছেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেকোন ধরণের সহিংসতা এড়াতে পুলিশ সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি জলকামান নিয়ে গেছে।
এদিকে দুপুরের পর গোটা উপজেলায় খবরটি ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষুব্ধ লোকজন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে নাগরিক কমিটির ব্যানারে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ব্র্যাক মোড়ে এক সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা বাবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গোলাম কবির মুকুল, আনিছুর রহমান চঞ্চল, মাসুদুর রহমান মাসুদ, বেলকা ইউপি চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম, দহবন্দ ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান মন্ডল, গোলাম মুর্তুজা হাসান টুকু, সাইফুল ইসলাম টুকু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বক্তারা বলেন, শিশু সৌরভ এমপির ছোড়া গুলিতে আহত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। একজন এমপির কাছে একজন শিশু যদি নিরাপত্তা না পায় তবে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? সুন্দরগঞ্জ পৌর মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, সুন্দরগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন এর আগেও একাধিকবার মদ্যপ অবস্থায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অপকর্ম করেছেন। যা দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে।
এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, গত শীত মৌসুমে বামনডাঙ্গা আব্দুল হক ডিগ্রী কলেজ মাঠে যাত্রা, হাউজি এবং অশ্লীল নৃত্যের মাধ্যমে এলাকায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা বন্ধ করতে যান। এসময় এমপি লিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেজবাহুল হোসেন ও শরীফ আহম্মেদকে লাঞ্ছিত করেন। এ নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে দীর্ঘদিন তার টানাপড়েন চলে। ঈদের দু’দিন আগে ২৩ সেপ্টেম্বর শেষ রাতে সংসদ সদস্য লিটন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেটে ফাঁকা গুলি করে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এসময় মাহমুদুল ইসলাম মামুন নামে এক ওয়ার্ডবয়ের বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দিলে মামুন দৌড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বিষ্ণু রাম রায় জানান, সংসদ সদস্য লিটন এর আগেও উপজেলার বামনডাঙ্গার চৌরাস্তা মোড়, রেল স্টেশন, শিববাড়ী মোড়, কানার মোড়, পাইটকাপাড়া মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় রাত-বিরেতে গুলি ছুড়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেন।
উপজেলা বাসদ (মার্কসবাদী) আহ্বায়ক বীরেন চন্দ্র শীল বলেন, একজন সংসদ সদস্য যিনি মানুষের নিরাপত্তা প্রদান করবেন, তার কাছে এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত। অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। ( সুত্রঃ মানবকণ্ঠ)