অনলাইন ডেস্ক: মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামের নিজ বাড়িতে রাত ৩.৩০ মিনিটে মীর কাসেম আলীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এসময় তার পরিবারের ৪০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে রাত ১২.৩২ মিনিটে কাসিমপুর কারাগার থেকে মীর কাসেমের লাশ নিয়ে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সসহ ১৭টি গাড়ির বহর রাত ২.৪৫ মিনিটে চালা গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। এসময় মীর কাসেমের স্বজনদের কেউ কেউ লাশের কাছে যেতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে লাশের কাছে যেতে দেননি। জানাজার পর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যকে লাশ দেখানো হয়। এরপর জানাজা পড়ান স্থানীয় বাহমাদিয়া সুলতানিয়া সামশুল উলুম হাফেজিয়া ও এতিম খানা মাদ্রাসার হুজুর হাফেজ মাওলানা আব্দুল কাদের। মীর কাসেম আলীর পরিবারের সদস্যরা জানাজায় অংশ গ্রহণ করেন। এরপর লাশ দাফন করা হয়। সেখানে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
শনিবার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়।
হরিরামপুর উপজেলার চালা ইউনিয়নের চালা গ্রামে প্রায় ২০ বছর আগে মীর কাসেম প্রায় ৭০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। নিজের অর্থে নির্মাণ করেন একটি দোতলা মসজিদ। মসজিদের আঙিনার উত্তর পাশে লেবু আর কলা বাগান। পাশেই বাঁশ ঝাড়। তার কাছেই সমাহিত করা হয় মীর কাসেম আলীকে। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে চালার পাশ্ববর্তী সাকুচিয়া গ্রামের সত্তর বছর বয়স্ক সামেজ উদ্দিন বিশ্বাসের নেতৃত্বে পাঁচ জন লোক কবর তৈরি করেন। এর আগেও সামেজ উদ্দিন একাধিক কবর খুড়েছেন। তবে একবরটি তার জন্য এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার। সামেজ উদ্দিন এই প্রতিবেদকে জানান, ‘যাকে এই কবরে দাফন করা হবে, তার কোনও নিকটতম আত্মীয় স্বজন কবরের পাশে দেখছেন না। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন ছাড়া ওই গ্রামের কোনও মানুষও আসেনি।’
চালা গ্রামে সুনসান নীরবতা:
মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় শনিবার কার্যকর হতে যাচ্ছে চালা গ্রামবাসী তা জানতো। তাদের মধ্যে মীর কাসেম আলীকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। সরকার দলীয় কয়েকজন নেতাকর্মী বিকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চালা গ্রামের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করলেও পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ তারা ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে চলে যেতে বাধ্য হন। এসময় চালা গ্রামে বিরাজ করছিল সুনসান নীরবতা। রাত এগারোটার পরে মানিকগঞ্জ থেকে হরিরামপুর সড়কে প্রায় সব ধরনের যানচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চালা গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি সাংবাদিকদের:
মানিকগঞ্জে কর্মরত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ,ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইনের কোনও সাংবাদিককে চালা গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
মানিকগঞ্জ পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান বিপিএম সাংবাদিকদের জানান, ‘হাই কমান্ড থেকে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে।’ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে কলতা বাজার এলাকায় সাংবাদিকদের বহনকারী মাইক্রোবাস ও হোন্ডা আটকে দেওয়া হয়।
আটকে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি দৈনিক জনকন্ঠ ও চ্যানেল আইয়ের প্রতিনিধি গোলাম ছারোয়ার ছানু জানান, ‘পুলিশ সুপার তাদের জানিয়েছেন, হাই কমান্ড থেকে সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহে অনুমতি না থাকায় তাদের আটকে দেওয়া হয়েছে।’
পরিবারের ৪০ সদস্যের উপস্থিতি:
কেন্দ্রীয় কারাগারে জীবিত মীর কাসেম আলীর সাথে শেষ দেখা করে স্ত্রী, দুই মেয়ে, দুই পুত্রবধূসহ পরিবারের নিকটতম ৪০ সদস্য মীর কাসেমকে দাফন করতে সরাসরি আসেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চালা গ্রামে। মীর কাসেমের স্ত্রী খন্দকার আয়েশা, ছেলে, দুই মেয়ে,দুই পুত্রবধূসহ হরিামপুরের চালা গ্রামের উদ্দেশ্যে আসেন পাঁচটি মাইক্রোবাসে করে। কিন্তু পথিমধ্যে হরিরামপুরের কলতা বাজার এলাকায় তাদের বহরের গাড়িগুলো আটকে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, হাই কমান্ড থেকে তিনটি গাড়ি ঘটনাস্থলে ঢোকার অনুমতি তাদের কাছে রয়েছে। পরে মীর কাসেম আলীর স্ত্রী আয়েশা খাতুনের অনুরোধে একটি গাড়ি বাদে চারটি গাড়িতে ওই চল্লিশ জন সদস্য রাত এগারোটার দিকে চালা গ্রামে পৌঁছান।
পুলিশের একজন সাব ইন্সপেক্টর ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘মীর কাসেমের নিকটতম আত্মীয়রা চালা গ্রামে এসে পৌঁছেছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন নারী ও ত্রিশ জন পুরুষ সদস্য রয়েছেন।’
নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা:
সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। মানিকগঞ্জের গোলড়া, মানিকগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড এলাকা, তরা ব্রিজসহ হরিরামপুরে প্রবেশ পথের প্রতিটি পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটিলিয়ানসহ প্রায় তিন শ’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়।
হরিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম জানান, ‘মীর কাসেম আলীর লাশ দাফনে যাতে কোনও প্রতিবন্ধকতা না হয়, সে জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
যেকারণে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ আটজনকে হত্যার দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তখনকার আলবদর কমান্ডার মীর কাসেমকে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল।
মীর কাসেমের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে ভবনটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হতো, সেই ডালিম হোটেলকে রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বলা হয়। রায়ে বলা হয়, ‘আলবদর সদস্য ফাঁসি কার্যকরপাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসতো আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই। এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদর সদস্যদের পরিচালনা ও নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজে।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ এনেছিল প্রসিকিউশন। এর মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে আপিলেও মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এ অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর তার এবং আরও পাঁচজনের লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার মনে হয় এ রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে একাত্তরের শীর্ষস্থানীয় অপরাধী বলয়ের বিচার সম্পন্ন হলো। তার মানে এই নয় যে, কাজ শেষ হয়েছে। বিচার অব্যাহত রাখতে হবে। এই অপরাধীরা যে ভাবাদর্শে অপরাধ করেছে তারও বিচার করতে হবে।’ (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)