ক্যাথরিন জুসের গ্লাসটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো চীজ আর পাউরুটি দিয়ে কি একটা খাবার বানানোর জন্য। ক্যাথরিনকে দেখে আমার দাদী-শাশুড়ির কথা মনে পড়ে। অবিকল তার প্রতিচ্ছবি। দেশে গেলে যখনি তাকে দেখতে গ্রামে যেতাম উনি ঠিক এমনি করেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন কি করবেন আমাদের জন্য তাই নিয়ে। ক্যাথরিন আমার প্রতিবেশী। মাল্টা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসে স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য। প্রায় পঞ্চাশ বছরের ও বেশি সময় ধরে সিডনীতেই। তখন এতোটা জনবসতি গড়ে উঠেনি। এখন তার বয়স ৮০। এ বয়সেও ঘরের সব কিছু সে নিজে নিজেই করে। অবশ্য তার বড় ছেলে স্টিব ও তার দেবর রবার্ট তাকে খুব সাহায্য করে। ক্যাথরিনের তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে স্টিব তার সাথে থাকে। মেঝ ছেলে ব্রিসবেন থেকে বছরে দুবার তার মাকে দেখতে আসে। মেয়েটি থাকে সিডনীর অদূরে শহরতলী এন্ট্রনসে। ছোট ছেলেটি রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে বেশ কয়েক বছর আগে। স্টিব বিয়ে করেনি। বয়স এখন ষাটের উপর কিন্তু মায়ের সাথেই থাকে। রবার্ট তার ছোট দেবর। তার কোন ফ্যামিলি নেই। বড় ভাই মারা যাবার পর ভাবীর দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়। সেই সুবাদে ক্যাথরিনের সাথেই থাকে, ব্যক-ইয়ার্ডে ছোট্ট চিলে কোঠার ঘরটাতে। প্রতিবেশীদের সাথে নিত্য আসা যাওয়া আমার। আমি এমন পরিবার কখনো দেখিনি।
ক্যাথরিন, স্টিব ও রবার্ট এই তিনজন মিলে এক পরিবার। পিছনের বিশাল জায়গা, প্রচুর শাক-শব্জি বুনে স্টিব আর রবার্ট দুজনে মিলে। আজ পনের বছর হোল ক্যাথরিনের স্বামী মারা গেছে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবার মৃত্যু দিবসে সবাই একসাথে তার মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। ছেলেমেয়েদের বেড়ে উঠা, জীবন সংগ্রামে নিয়ত মানিয়ে নেয়া- এভবেই কেটে গেলো এতগুলো বছর। আজ ক্যাথরিনের বাড়ির সামনে একটি সাদা গাড়ি। সম্ভবত তার মেঝ ছেলে তাকে দেখতে এসেছে। সাদা গাড়িটি মানে মেঝ ছেলের আগমন। তাহলে সম্ভবত তাদের বাবার মৃত্যু বার্ষিকী আজ। কেননা ডিসেম্বরে খৃস্টমাস ছাড়া আর তো সবাই একসাথে হয়না। এসময়ে সবাই একসাথে হয়েছে তার মানে বিশেষ একটা কিছু তো বটেই। মেঝ ছেলে স্টিফেন যখনি তার মাকে দেখতে আসে তার মায়ের ঘড়-দোর সব নতুন করে পরিষ্কার করতে নামে। আজো তাই করছে।
মানুষের প্রতি আমার সীমাহীন আগ্রহ। বিশেষ করে ভিন্ন দেশী মানুষ। আমার’চে বয়স্বী হলে বরঞ্চ আরও বেশী জানতে ইচ্ছে হয়। অভিজ্ঞতা আর জীবনের দৃষ্টিভঙ্গীর বিচিত্রতার জন্য তাদের প্রতি আমার নিরন্তর কৌতুহল। সমবয়সীদের চিন্তা-চেতনা তো একই হয়, সে আর জানার কি আছে। এ কারনেই আমি সময় করে প্রায়ই ক্যাথরিনের কাছে যাই। দেখে আসি, জীবনের গল্প শুনি। আজকাল মানুষে মানুষে আড্ডা আর কথা বলা যেন এক দুর্লভ বাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু ওয়েব আর ফেসবুকের অলি-গলি মুখস্ত করাই যেন স্মার্টনেস আর হাল ফ্যাশন। শুধু সময় দিয়ে সময় কেনা আর লাভ লোকসানের হিসেব কষা। এ কেমন জীবন! চারিদিকে কেবল মেকী নীতিকথা আর আত্ন-প্রচারের উন্মত্ততা। কি আশ্চর্য। মানুষে মানুষে কথা বিনিময় আজ এক হিসেবের হালখাতা। আমাকে দেখে ক্যাথরিনের চোখে মুখে ফুটে এক নিসর্গ আনন্দের ঝিলিক। এজন্যেই ব্যস্ত হয়ে উঠে নানা আপ্যায়নে। আমার মায়া হয়। মানুষ মানুষকে একটু সময় দেয়া কি এতই কঠিন! কল্পনায় আমি দাদী-শাশুড়ির মুখটা দেখি। আমি আমার দাদীকে দেখিনি। খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম কিন্তু তার চেহারা আমার মনে পড়েনা। আজ ক্যাথরিন যেন একই সাথে আমার দাদী এবং দাদী শাশুড়ি।
গল্প করার সময় প্রায়ই ক্যাথরিনের হাতে একটি ছোট্ট চাবি দেখি। চাবিটি প্রায়ই তার হাতে থাকে। হয়তো আগেও ছিল খেয়াল করিনি। আমার কৌতুহল হয়। আমি দেখি সে চাবিটি নিয়ে খুব যত্নের সাথে নাড়াচাড়া করে। যেন মণি রত্ন ভরা কোন সিন্দুকের চাবি। ব্যাপারটা কি! একদিন জিজ্ঞেসই করে ফেললাম। ক্যাথরিন বলল এটা তার আসল ঘরের চাবি, চিরন্তর ঠিকানার। আমার কৌতুহল বেড়ে যায়। বললাম, আমি তো তোমার কোন ঘরে কোনই তালা দেখিনা। আসল ঘর আর চিরন্তর ঠিকানা আবার কি! এরা তো আবার কথায় কথায় শুধু রহস্য করে। মনে হোল হয়তো বলতে চাচ্ছেনা। আমি আর জোড় করলাম না।
এক বিকেলে আমি তাকে দেখতে গেলাম। সে কেবল বাইরে থেকে এসেছে। আমি তার বারান্দায় বসলাম। তার মুখটা বিষণ্ণ। জানতে চাইলাম কি হয়েছে। সে বলল এইমাত্র তার হাসব্যন্ডকে দেখে এসেছে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্ঠিতে তাকিয়ে রইলাম। তার হাসব্যন্ড মারা গেছে বহু বছর হয়েছে। আজ কিভাবে দেখে আসে। ক্যাথরিন তার হাতের চাবিটি দেখিয়ে বলল এটা সেই ঘড়ের চাবি যেখানে তার হাসব্যন্ড ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট একটি ঘড়ে পরপর দুটো সেলফ। একটি সেলফে তার হাসব্যন্ডকে সমাহিত করা। বাকি সেলফটা তার জন্য রাখা। কোন কোন বিকেল যখন খুব নিঃসঙ্গ লাগে তখন সে তার হাসব্যন্ডকে দেখে আসে। আর অপেক্ষা করে কবে তার সময় হবে। আমি এমন অপেক্ষার কথা কক্ষনো শুনিনি।
মরে গেলে একই ঘড়ে দুটো সেলফ এ সমাহিত করার রীতি জানতাম না। আসলে অগাধ রহস্যে বসবাস আমাদের। আমি ক্যাথরিনের অনুভূতিটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম। তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস আমাকে ও ভারি করে তুলল। আমি তাকে কিছুটা হাল্কা করার জন্য বললাম চলো একটু হেটে আসি। বাড়ির সামনে সিগ্ধ সবুজ লনে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কিছুক্ষণ গল্প করলাম। সে আপন ভুবনে ফিরে এলো। আমার বেশ ভালো লাগলো। একটু সময় মানুষকে এতোটা আনন্দ দিতে পারে, সত্যি আশ্চর্য হলাম। আমি ঠিক করলাম সময় করে ক্যাথরিনকে নিয়ে মাঝে মাঝে শপিং কিংবা ধারে কাছে কোথাও ঘুরে আসবো। সেই থেকে তার পেনশনের টাকা তোলার সময় হলে কিংবা শপিং দরকার হলে আমাকে জানায়। আমিও সানন্দে সাথে করে নিয়ে যাই।
একদিন ক্যাথরিন রাস্তা ক্রস করছে। হাতে একটা বড় প্লেট। স্টিব ও আসছে তার সাথে। আমি ভাবলাম জরুরী কিছু কিনা। এগিয়ে গেলাম। দেখি সে আমার জন্য রান্না করে নিয়ে এসেছে। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম এসব কেন করেছ। সে বলল এই যে তোমার ব্যস্ত সময়ে ও আমাকে সময় দিচ্ছ তার বিনিময়ে আমার তো কিছুই দেবার নেই। মাঝে মাঝে তোমাকে ভেবে কিছু বিশেষ ডিশ রান্না করি। তাই নিয়ে আসি। আমার ভেতরে অদ্ভুত ভালোলাগা দোলা দিলো। আহারে, মানুষের ভেতরটা কতো শূন্য। শুধু একটু সময় মানুষ মানুষকে কতোটা আপন করে দেয়! ভিন দেশী মানুষ অথচ মায়া তার একই। মায়া আর স্নেহের কাছে আসলে সব কিছু পরাজিত। বর্ণ, গোত্র, ভাষা সব কিছু তুচ্ছ। আমি তাকে ঘড়ে নিয়ে এলাম। আয়েশ করে সোফাতে পা তুলে বসতে বললাম। স্টিবকে চলে যেতে বলে সে বসল যেন আপন ঘর। আমি বললাম তুমি কথা বলতে থাকো আমি হাতের কাজ সেরে ফেলি। মহা উৎসাহে নিজের জীবন কাহিনী বলা শুরু করলো। আমি শুনছি। এ যেন আমার দাদী অথবা দাদী শাশুড়ি। আমার মনে হোল মানুষে মানুষে আসলে কোনই তফাৎ নেই। তাহলে কেন এতো বিভাজন, এতো বৈরিতা। বিভেদের দেয়াল গড়ি-দেয়াল ভাঙ্গি’ এ সাজানো দেয়াল ভাঙবে কবে! আমি তার উচ্ছ্বাসিত গল্প শুনে নিজের জীবনের নষ্টালজিয়ায় ভেসে যাই। আপ্লুত হই স্নেহের বাঁধনে। যেন যন্ত্র নয় আমি মানুষ হবো-মায়ার নদীতে অবগাহন করবো, স্তিমিত হবো আবেগের কাছে। আমি ক্যাথরিনকে বললাম তোমার যখনি কথা বলতে ইচ্ছে করবে চলে এসো আমার ঘড়ে। আমি শুনবো তোমার যতো কথা। সেই থেকে চলে আসতো প্রায়ই। সাথে নিয়ে আসতো পুরানো সব ছবি আর তার যতো স্মৃতি কথা। কিন্তু হাতে থাকতো তার সেই চাবি। অপেক্ষার চাবি।
কেটে গেলো আট বছর। গল্পে গল্পে ক্যাথরিন এখন আমার খুব কাছের মানুষ। অনেক সময় রক্তের চেয়ে প্রানের-টান বড় বেশী তীব্র হয়ে যায়। পরিবারের কেউ না হয়েও হয়ে যায় একান্ত পারিবারিক। ক্যাথরিন সেরকমই একজন। আমি বড়ো দুর্বল মায়ার প্রতি হয়তো কিছুটা সেকেলে বলেই। মায়া, মানুষ ও মানবতা এর কোন সীমারেখা নেই। সেজন্যই হয়তো এই ভিন দেশী মানুষটার প্রতি আমার এতো দুর্বলতা, শ্রদ্ধা। বয়সের ভারে ক্যাথরিন এখন অনেকটা ন্যুব্জ আগের’চে ভীষণ দুর্বল। বেশীর ভাগ সময় বারান্দায় বসে থাকে। রাস্তা পার হয়ে আর আমার কাছে আসতে পারেনা। অথচ কত গল্প জমা ছিল আমার জন্য।
এখন আমি যাই তাকে দেখতে। অনেক সময় দূর থেকেই হাত নাড়াই। কিন্তু প্রায়ই সে আমাকে চিনতে পারেনা। চোখেও দেখেনা ভালো করে। তবু পাশে বসলে আনমনে বলে তুমি কি রাস্তার ওপাড়ের তিন’নাম্বার বাড়ির মেয়ে? তোমার বাচ্চারা কেমন আছে? তারপর নীরবতা, দীর্ঘ নিঃশ্বাস। শুধু বিড়বিড় করে বলতে থাকে আমি অপেক্ষা করছি, অপেক্ষা করছি যাওয়ার জন্য। হাতে চাবি নিয়ে সে অপেক্ষা করছে অন্য ভুবনের গন্তব্যের জন্য। এই গন্তব্যহীন গন্তব্য আসলে কোথায়! আমি তার হাতে হাত রাখি। তার চোখে পানি টলমল। টুপটুপ ঝরছে আমার হাতে। আমি ফিরতে পারিনা, ফেরাতে পারিনা মনের মায়া!!