জাপানের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি ফুজিইয়ামা’র নাম পড়েছিলাম ভূগোলে । হিরোশিমা নাগাসাকির লোমহর্ষক বর্ণনা পড়তে হয়েছিল বাংলা বইয়ে। ভূমিকম্পের দেশ বিধায় বাড়িঘর কাগজ দিয়ে বানানো এমন কথাও কানে ঢুকেছিল । ওসাকা , কিয়োটো, টোকিয়োর নাম জানা থাকলেও আরো যে ৪৪ টা প্রিফেকচার আছে সেটা জানা ছিল না । জাপানী আলফাবেটে ট নাই তাই জাপানীরা ট এর কাজ ত দিয়ে চালিয়ে নেই। ভুল বললাম, জাপানি বর্ণমালা ট বা টি এর পরিপূরক নাই ।টোকিয়কে জাপানীরা তোকিয় আর কিয়োটোকে কিয়োতো বলে । ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রিগুলোর ত না থাকায় তোকিওকে টোকিও বলে । প্রথম প্রথম আমিও তাই করতাম । আমি যে প্রিফেকচারটায় যাব সেটার নাম টোকুশিমা (徳島、Tokushima)। ইংলিশ টু বাংলা উচ্চারন করলে টোকুশিমাই হয় । স্থানীয়রা তোকোশিমা বা তোকুশিমাই বলে ।নতুন বাঙ্গালিরা প্রথম প্রথম ফরেনারদের মত টোকুশিমা দিয়ে চালিয়ে নেয়। সিনিয়রদের(আগে এসেছে) হাসাহাসিতে ভুলটা ভাঙ্গে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে টোকুশিমা বের না হয়ে তোকোশিমাই বের হয়। বাঙ্গালিরা আসলেই একটা লাকি জাতি। আমাদের বর্ণমালা এতই রিচ যে জাপানের এমন কোন শব্দ নাই যেটা উচ্চারণ করতে আমাদের অসুবিধা হবে (tsu つটা বাদ দিলে) । জাপানিদের মত আমাদের উচ্চারনে টোকিয়কে হয়ত তউকিওউ এর মত শোনায় না । কিন্তু ওদের বুঝতে অসুবিধা হয় না ।
বিসিএস এর প্রিপারেশনের জন্য হারাকিরি (পেট কাটা ) ও রেড আর্মির কথা জানতে হয়েছিল । সারিন গ্যাস দুর্ঘটনার কথা তখনো তরতাজা । কোবে ভুমিকম্পর খবর ছিল সবচেয়ে লেটেস্ট । জাপান সমন্ধে জ্ঞান এতটুকুই । খতরনাক রেড আর্মিদের সিনেমায় দেখেছি । কেমন হবে সাধারন মানুষগুলো ? প্রফেসর কেমন হবে ? প্রশ্নগুলো হাওয়াই জাহাজে উঠার আগে একবারও মাথায় আসেনি । জাপানের আকাশসীমায় ঢুকেই প্রশ্নগুলো বড় বেশী তাড়া করছে । বিমানের জানালা দিয়ে ঠিকরে পরা লাল আলোগুলো কি ভালো কিছু নিয়ে আসবে আমার জন্য, নাকি খারাপ কিছু । প্রশ্নযুদ্ধে মস্তিষ্ক ভাবাচ্যাকা খেয়ে কোন সমাধান দিতে পারল না।
ইমিগ্রেশনের ঝক্কিঝামেলা শেষে যখন বেরুলাম তখুনি খেলাম বড় ধাক্কাটা! গনিতের কঠিন কঠিন অংক অনায়াসেই সলভ করলেও, উত্তর দক্ষিন পুর্ব পশ্চিম সমন্ধে বেশ অজ্ঞই ছিলাম । নিজের জেলা গাইবান্ধা যে বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তরে সেটা উত্তর বঙ্গ থেকেই মনে করতাম । একটু দুরে পাখিদের ডানা ঝাপটানোর সাথে বিমানগুলো উড়ার চেষ্ঠা করছে। মাথার উপরের রাস্তা দিয়ে বাস চলছে দ্রুত গতিতে ,পায়ের নিচ দিয়ে ট্রেন চলছে । উত্তর, দক্ষিন ,পূর্ব পশ্চিম খোঁজা বাদ দিয়ে আকাশ ও পাতালের অবস্থান খুজতে লাগলাম । অত্যাধুনিক টেকনোলজীর কারুকাজ দেখে মাথা যখন হ্যাং হবার উপক্রম ঠিক তখনি দেখলাম আমার নাম লেখা প্লাকার্ড হাতে আমার চেয়েও দুই তিন ইঞ্চি লম্বা একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে । জাপানীরা যে বেটে জাতি নয়, ওদেরও আছে লম্বা মানুষ, মস্তিকের রক্ষিত ডেটাবেজটাকে আপডেট করতে হলো ।
ভায়রা ভাই থাকেন একই শহরে যে শহরে আমি পড়তে যাচ্ছি । আমাকে জাপানে আনার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছেন । আমাকে রিসিভ করতে নিজে আসবেন না হয় অন্যকে পাঠাবেন, এরকম শুনেছিলাম জার্নি শুরুর আগে । জাপানী মহিলাকে ( মেয়ে? ,জাপানী মেয়ে জাতীদের বয়স বোঝা সত্যিই মুস্কিল) আমার নাম বহন করতে দেখে বুঝলাম গড়বড় হয়েছে কোথাও । আগের দিনের টাইফুন জাপানকে লন্ডভন্ড করেছে কিনা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমার আগমনের স্ক্যাজুয়েলের যে বারটা বাজিয়েছে সেটা বুঝতে দেরি হল না ।
জাপানী জাতিটা আ্মেরিকান বোমা খেয়ে কোমর ভাঙ্গলেও আমেরিকান কালচারের ভক্ত এরা । তাই ইংরেজির উচ্চারনে ওরা আমেরিকাকে ফলো করে । ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া ইংলিশ শিখেছি আমরা তাই আমাদের উচ্চারনে আমেরিকান ইনটোনেশন আসার প্রশ্নই আসে না । আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করে আসা আমাদের এক স্যারের সিডিউল এর উচ্চরন স্ক্যাজুয়েল নিয়ে বন্ধুরা মুচকি মুচকি হেসেছিলাম পিছনের বেঞ্চ থেকে । এতদিন জাপানীদের কাছ থেকে স্ক্যাজুয়েল শুনতে শুনতে ভুলেই গিয়েছিলাম কোনটা আমেরিকানদের মুখ থেকে উচ্চরিত হয় আর কোনটা ব্রিটিশদের মুখ থেকে । জাপানী ভাষার জ্ঞান ” ওহাইয়ো গোজাইমাস ( শুভ সকাল ) ” এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । সহধর্মীনীর জোড়াজুড়িতে কয়েকদিন গিয়েছিলাম ভাষা ইনস্টিটিউট এর ক্লাসে । বাংলা একাডেমির কতৃক প্রকাশিত জাপানী ভাষার বইখানা লাগেজের ভিতরে মাল সামানের চাপে পরে ওর আলো বিকশিত করতে পারছে না । তাই জাপানী ও বাঙ্গালীর কথোপকথন শুরু হল আমেরিকান ও ব্রিটিশদের ইনটোনেশন দিয়ে । চোয়ালের মুভমেন্টের চেয়ে হাতের মুভমেন্ট বেশী হয়েছিল যতদুর মনে পরে । কথোপকথনের সারমর্ম ছিল যে, আমাকে রিসিভ করার জন্য ওনাকে পাঠানো হয়েছে । সে যে দু’নম্বর না সেটা প্রমান করার জন্য আমাকে আমার ভায়রা ভাইয়ের সাথে টেলিফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করলেন। আমাকে সে গন্তব্যস্থল পর্যন্ত সঙ্গ দেবে না, গন্তব্যস্থলমুখী যানে উঠিয়ে দিবেন । বিদেশে এটুকুই বা কম কোথায় ? মাথার চিন্তার লিস্টে থেকে একটা চিন্তা মুছে গেল ।
অক্টোবরে মাঝামাঝি ছিল সময়টা । জাপানীদের পোশাক দেখে মনে হল শীতের ট্রায়েল দেবার মত পোশাক পরেছে। আমার মনে হল আমাকে সাইবেরিয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে । সাইবেরিয়ায় যাইনি সিনেমায় কিংবা ডকুমেনট্রির পাত্র পাত্রীদের কাপাকাপি দেখেই অনুমান করেছি । শরীরের কাপুনিকে দাতে কামর দিয়ে দমিয়ে রেখে গন্তব্যে যাবার ইন্সট্রাকশন শুনে নিলাম । বাসগুলো মনে হয় টাইফুনকে একটু বেশীই ভয় পেয়েছে । যাবে কি যাবে না এই নিয়ে দোনোমোনো করছে । জাহাজ নাকি ছাড়ার সম্ভাবনা আছে । জাহাজঘাটে যাবার বাসে ঢুকিয়ে দিয়ে মহিলা বিদায় নিলেন । জাপানে জীবন শুরুর আন্দাজ করছি…
লাগেজের চাকা তো ঢাকা এয়ারপোর্টেই বিকলাঙ্গ হয়েছিল । ওটাকে টানতে টানতে মনে হচ্ছিল সব কিছু ফেলে দিয়ে ঝাড়া হাত পা নিয়ে যাই । জাপান উন্নত দেশ হওয়ায় ট্রলির ব্যবস্থা ছিল কিছু কিছু বাস স্টপেজে, তাই কিছুটা রক্ষা । জাহাজঘাটে পৌছেই জানতে পারলাম অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই জাহাজ ছেড়ে যাবে । তড়িঘড়ি করে উঠে পরলাম জাহাজে । জাপানীরা যে নাম দিয়েছে এই জাহাজখানার, তার বাংলা হবে দ্রুতগতির জাহাজ । সম্ভুক গতির ভেলাতে চড়েছি, ফুলছড়ি ঘাটের বাসিন্দা হওয়ায় বড় বড় জাহাজে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা থাকলেও সেগুলো দৌড়াতো নদীতে না হয় খালে । সমুদ্র দেখেছি তবে সমুদ্রে ভাসমান জলযানে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নাই । তাই আলাদা একটা অনুভুতি লাগছে মনটায় । দ্রুতগতির এই জাহাজখানা নাকি প্রশান্ত মহাসাগড়ের বুক চিড়ে দৌড়াবে । জাহাজ চলতে শুরু করাতেই বুঝলাম কেন এরা স্পিডি নাম দিয়েছে জাহাজখানার । রেলে যেমন ওদের বুলেট ট্রেন পানিতে তেমনি বুলেট ট্রেনের ছোট ভাই । যাত্রী সংখ্যা জাহাজ চালানোর লোকবলের চেয়েও কম । দৌড়াচ্ছে না উড়ছে বাহিরের দৃশ্য না দেখে বোঝার উপায় নেই । নিমিষেই ছেড়ে আসা পোর্টটিকে সীমান্তে দেখাচ্ছিল। সমুদ্রের নীল পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে কখন যে স্বপ্নের জগতে গিয়েছিলাম টের পাইনি । গন্তব্যস্থলের পোর্টে পৌছেই দেখলাম অপেক্ষামান ভায়রা ভাই, আমার প্রফেসর ও একজন জাপানীজ । শুরু হল আমার সত্যিকারের জাপানী জীবন!
আরো পড়ুন :