কাজী সুলতানা শিমিঃ কহিব তারে আমার প্রিয়ারে আমারও অধিক ভালবাসিয়ো”- নার্গিসের উদ্দেশ্য গানটা লিখেছিলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুল। প্রেম যে শুধু মিলনে পরিপূর্ণতা পায় তা কিন্তু নয়। বরঞ্চ অনেক সময় ত্যাগ ও দূরত্ব সম্পর্ককে মহীয়ান করতে পারে। নজরুলের জিবনের এই বিরহী প্রেমের কারণেও বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে কালজয়ী আবহমানতায়। তার জিবন ও বিভিন্ন রচনা থেকে জানা যায় নার্গিস ছিল তার প্রথম প্রেম। নার্গিস পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের বিধবা বোনের মেয়ে। নার্গিসের আসল নাম ছিল সৈয়দা খাতুন। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে ইরানী ফুলের নামে নজরুলই তার নাম দেন নার্গিস আসার খানম। ১৯২১ সালে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কুমিল্লার দৌলতপুরে নার্গিসের সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয়।
বিয়েপর্ব শেষ হবার পর এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হয়ে নার্গিস তার সাথে পরিচিত হতে আসেন। এরপর একদিন নজরুলের এই বাঁশি বাজানো সর্ম্পকে কথা বলা প্রসঙ্গে কবির সঙ্গে তিনি আলাপ করেন। এই আলাপ-পরিচয়ের পরই নজরুল নার্গিসের প্রেমে পড়ে যান। আলী আকবর খানও ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। মূলত নজরুলকে কুমিল্লা আনবার পিছনেও তার উদ্দেশ্য ছিল নিজ পরিবারের কারো সাথে নজরুলের বিয়ে দিয়ে তাঁকে আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করা। নার্গিসের প্রেমে পাগল কবি তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আলী আকবর নজরুলকে খুব পছন্দ করতেন। মুলত তিনিই নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও আকদ সম্পন্ন করেন। কিন্তু কাবিননামা’র সময় কবিকে ঘর-জামাই হয়ে থাকতে হবে, এমন একটি শর্ত দেয়া হয়। এতে ক্ষেপে গিয়ে কবি বিয়ের রাতেই নার্গিসকে ছেড়ে চলে যান। নার্গিসকে ছেড়ে চলে আসার পর আলী আকবর খান কবিকে ফেরানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু নজরুল আর ফিরেননি। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের কোন যোগাযোগ ছিলোনা। ১৯৩৭ সালে নার্গিস, নজরুলকে একটা চিঠি লেখেন। নজরুল একটি গান লিখে সে চিঠির উত্তর দেন-
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর নিশীথ অন্ধকারে….।’
দু’মাসের অনির্বাণ প্রেমের পর নার্গিসের সাথে পরিণয়ের রাতেই এক অভিমানে কবি তাকে ছেড়ে চলে যান। তবে কবির অন্তরে সুপ্ত ছিলেন তিনি দীর্ঘকাল। বিবাহ বিচ্ছেদের পরও ১৯৩৭ সালে কলকাতার চিৎপুর থেকে নার্গিসকে কবি লিখেছিলেন, ‘তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা– এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি—তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না—আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দীরের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে’।
১৭ বছর পর ১৯৩৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় নার্গিস খানমের। বিয়ের সংবাদ শুনে নজরুল ‘পথ চলিতে যদি চকিতে কভু দেখা হয় পরানপ্রিয়’ গানটি লিখে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল একটি চিরকুট, তাতে লেখা ছিল–‘জীবনে তোমাকে পেয়ে হারালাম, তাই মরণে পাব এই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব।’ নার্গিস মারা যান ১৯৮৫ সালে, তাকে সমাহিত করাহয় ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। প্রথম প্রেম নার্গিস কবির হৃদয়ে ভীষণ রকম দাগ কেটেছিল। তাকে ছেড়ে যাবার পরেও কবির মনে অপার দুঃখবোধ ছিল। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। এছাড়াও লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’। মাত্র দু’মাসের প্রেমের সময়কালে তিনি নার্গিসকে নিয়ে লিখেছিলেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা।
তার বিভিন্ন রচনায় আমরা পেয়েছি বাথা-বঞ্চনা ও দুঃখ শোক প্রকাশ করার এক অনবদ্য উপাদান। বিরহ ও দুঃখ জীবনেরই অংশ। তাই বলে তার জীবন থেমে থাকেনি। বাক ও বোধ শক্তি হারিয়েও তিনি বেঁচে ছিলেন দীর্ঘ ৩৪ বছর। ৭৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে চীর বিদায় নেন। কিন্তু তার রচনা হয়ে আছে বাংলা সাহিত্য এক কালজয়ী উপাখ্যান।
দ্রোহ ও সাম্যের কবি বলার পাশাপাশি নজরুলকে একই সাথে প্রেমের কবিও বলা হয়। পথে পথে ঘুরে বেড়ানো এই অগোছালো মানুষটি একই সাথে ছিলেন বিদ্রোহী ও প্রেমিকপুরুষ। মনন ও মানসিকতায় দুর্দম, দুর্দান্ত হলেও তার সাহিত্য রচনায় প্রেম ছিল এক আমূল প্রেরণা। তার জীবনে প্রেম এসেছিলো অনেকবার। কিন্তু বেশীর ভাগই ছিল বিরহী ও বেদনার। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বিশেষ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন-
আমি নেতা হতে আসিনি, আমি কবি হতে আসিনি
আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম-
সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে
নীরব অভিমানে চিরদীনের জন্য বিদায় নিলাম”…
মানুষ, মানবতা, দেশ ও সমাজকে ভালোবাসার পাশাপাশি বাক্তিগত জীবনে নজরুল ভালবেসেছিলেন প্রেমময়ী নারীকে ও। তার জীবনে প্রেম এসেছিলো কখনো আলোড়নে কখনো নীরবে। সাহিত্য ও সংগীতে তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন অনন্য সৌন্দযের মহিমায়। ১৯২২ সালে ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থ টির উৎসর্গ পত্রে নজরুল লিখেছিলেন-“মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়চিত্ত করলুম”। তিনি কাকে এই কথা বলেছিলেন কিংবা কে তার প্রথম মানসী ছিল সেকথা অজানা রয়ে গেছে আজো। তবে ধারণা করা হয়, আসানসোল থানার দারোগার মেয়ে স্বর্নলতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি একথা বলেছিলেন। যদি তাই হয় স্বর্নলতা’ই হয়তো ছিল তার প্রথম প্রেম। অবশ্য সেকথা তিনি নিজে বলেননি কখনো।