জাপানে প্রথম রাত্রিযাপন, তাও আবার একা একা । সারারাত্রি বাসার লাইটকে সঙ্গী বানিয়ে আধা ঘুম আধা জেগে কাটালাম রাত্রি। আজানেও না, পাখির কিচির মিচিরেও না, ঘুম ভাঙ্গলো পাশের বাসার গাড়ীর স্টার্টিংয়ের শব্দে । শুরু হল জাপানে আমার কর্মদিবসের প্রথম দিন!
অর্থনৈতিক কারণেই হোক আর জমির অভাবেই হউক, জাপানের ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল হাউজগুলো (ডর্মেটরি) বেশ দুরেই থাকে । কিছু ব্যাতিক্রম আছে তবে তোকোশিমা সেই ব্যাতিক্রমে পরে নাই । আমাকেও তাই প্রতিদিন ১০ কিমি পাড়ি দিতে হতো দ্বিচক্রযানে । সুবিধা বলতে এখানকার ফুটপাথগুলো দখলদারবাহিনী কতৃক দখলে থাকে না । গাড়ী চলার রাস্তায় জ্যাম থাকলেও ফুটপাথগুলো হাহাকার করতো মানুষের জন্য । প্রথম প্রথম কিছুদিন আমি ও ভায়রা ভাই পুরো ফুটপাথকে নিজেদের বানিয়ে যাতায়াত করতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে । পরে অবশ্য যে যার মত যাতায়াত করেছি । প্রথম দিন অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন উনি। সবচেয়ে বেশী যেটা বললেন সেটা হল সিগন্যালের লাল বাতির কথা । রাস্তায় গাড়ী না থাকলেও যেন ভুলেও ভায়োলেট না করি সিগন্যাল । রাস্তায় গাড়ী নাই কিন্তু বাত্তি লাল, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই । সময়ভেদে অপেক্ষার পালাটা আবার উঠানামা করতো । অফিস আওয়ারে সিগনালগুলোর লাল হয়ে থাকার সময় দীর্ঘ। অফিসে যাবার সময়টা মানে সকাল ৮-১০ টা অপেক্ষার পালা হতো একটু লম্বা। মনে মনে ভাবতাম গাড়ী নাই রাস্তায়, পার হলে কি হবে? আবার এটাও ভাবি মামুরা ধরলে কি বলব ।জাপানী ভাষার জ ও যে জানি না ।
সাইকেল চালানোয় নিজেকে আহামরি কিছু ভাবতাম । দুইদিন চালিয়েই বুঝলাম শখের সাইকেল চালানো আর কাজের জন্য সাইকেল চালানোয় পার্থক্য আছে । রাতে হাটুর ব্যাথাগুলো ভালই জ্বালাতন করত!
জাপান পাহাড়ের দেশ । ৮০ ভাগের ও বেশী পাহাড় । রাস্তাগুলো পাহাড়ের পাদদেশ ঘেষে না হয় সমুদ্রের পাশ দিয়ে । হাইওয়েগুলো পাহাড়কে ছিদ্র করে মানে টানেল বানিয়ে রাস্তার দুরত্ব কমিয়েছে। শহরের রাস্তাগুলো উচুনিচু কম হলেও নদীর উপরের ব্রিজগুলো জাপানীরা অযথা উচু বানিয়েছে । জাপানীরা অযথা কিছুই করে না পারতপক্ষে, কারন অবশ্যই আছে । ওরা ওদের চিন্তা ধারা প্রয়োগ করেছে ঠিকই, বারোটা বেজেছে আমাদের মত সাইকেল ওয়ালাদের ।ব্রিজে ওঠার সময় হাটুর ভিতরকার মবিল হাড়ের ঘর্ষণকে থামাতে পারছে না কিছুতেই । ব্রিজে উঠার আগেই তাই সারেন্ডার । সাইকেল আমাকে কি বহন করবে, আমাকেই সাইকেলকে বহন করতে হত ব্রিজগুলোতে আরোহনের সময় । ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাটিয়া চলিলোর উদাহরন দেবার পারফেক্ট সময় । পাশ দিয়ে চাচির বয়সি জাপানীজ মহিলাদের ওভারটেককে, মাথা নিচু করে বাইবাই দেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকত না ।
গলধঘর্ম হয়ে ল্যাবে ঢুকলাম । একজন প্রফেসর, একজন সহকারী প্রফেসর, একজন লেকচারার ও কয়েকজন জাপানী ছাত্র নিয়েই রিসার্চগ্রুপ । সবাইকে ডেকেই ইন্ট্রোডিইস করে দিলেন গাইড । নিজের পরিচয় দিতে যেয়ে এবার আর নিজেকে মিঃ বানালাম না । আমার আসন দেখিয়ে প্রফেসর চলে গেলেন নিজের কামরায় । আসনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে কম্পিউটার। কম্পিউটারে চোখ দেবার আগেই নাকটাকে ব্যস্ত হতে দেখলাম। ল্যাবে ক্যামিকেলের গন্ধকে ছাড়িয়ে একটা তীব্র গন্ধ নাসারন্ধ্রকে বড়ই জ্বালাতন করছিল । একটু পরেই দেখলাম একজন কাপে কি যেন ঢালছেন । গন্ধটার উৎস উৎঘাটনে বেশী সময় লাগেনী । শুধু নাককেই বিরক্ত করে নাই একটু পরে মুখও নিয়েছে ওটার স্বাদ । চিনি দুধের সংমিশ্রনে যে সরবত হয়, সেটা খেয়েছি ঢাকার অফিসে । কফির গন্ধটা চিনি ও কনডেন্স মিল্কের কাছে হারিয়েছিল, আজ আসল কফির গন্ধ পাচ্ছি । আসল না নকল বলতে পারব না, তবে গন্ধটা খুবই কড়া । টক তেতুল খেলে যেমন গায়ে কাটা দেয়, তেমনি তিতা কফির চুমুকে, শুধু লোমের গোড়াই ফোলে যেয়ে ক্ষান্ত হয়নি, মাথার চুলগুলোকেও খাড়া করেছিল । খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন কাপটাকে খালি করতে ।
জাপানীরা কাগজের একটু মিস ইউজ বেশীই করে। ইনফরমেশন জানার জন্য এক পাতাই যথেষ্ট যেখানে সেখানে লাগাবে ১০ পাতা । গাইড অনেকগুলো কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন এগুলো পুরন করতে হবে । তার আগে আমার নামের জাপানী স্পেলিং ঠিক করলেন । রাহমান হয়ে গলে রাফুমান । মোঃ হয়ে গেল মোহামাদো আর মাহবুবর হয়ে গেল মাহাবুবারু । আব্বা যদি বেচে থাকতেন তবে আমার নামের এই বেহাল অবস্থা দেখে কষ্ট পেতেন হয়তোবা । আমি যে কষ্ট পাইনি তা নয় তবে অন্যদের সাথে তুলনা করলে আমার জাপানীজ নামটা ছিল চলনসই । এখানে এসে আসলাম হয়ে যায় আছুরামু জব্বার হয় জাবারু ।মাসুদা কিংবা মারুফা মেয়েদের বা মহিলাদের নামগুলোকে উচ্চারণ করতে কষ্ট হত না জাপানীদের। জোড়া সংখ্যার উচ্চারনের নামগুলোর তাও চলনসই জাপানিজ নামের স্পেলিং মিলত, বেজোড় হলেই নামের বারোটা বাজত…
জাপানিজ নাম ঠিক হবার সাথে সাথেই, রাফুমান লেখা একটা চুম্বকের নেমপ্লট দেখলাম লটকানো ছোট বোর্ডে। অন্য নামগুলোর থেকে আমারটাকে একটু আলাদা দেখাচ্ছিল, কেননা বিদেশিদের নাম একধরনে স্পেশাল বর্ণমালা দিয়ে লিখতে হয় । সেই বর্ণমালাগুলোকে কাতাকানা বলে। শুধু বাঙ্গালী নামই না সব বিদেশিদের নামের বারোটা বাজত। বোর্ডের নামগুলোই বলে দিল বিদেশি শুধু আমি একাই এই ল্যাবটাতে।
একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বোর্ডটা কিসের জন্য ? কষ্ট হয়েছিল বোঝাতে তবে ভাল লেগেছিল জেনে । বোর্ডে চোখ বোলালেই নামগুলোর অবস্থানই বলে দিবে, ল্যাবের কে কোথায় আছে । ” অমুক কোথায় ? ” বলে শব্দ দুষণ করে অন্যদের মনোযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটানোর মানে হয় না । কিংবা “সরফরাজ সাহেব একটু পান খেতে বের হলাম, স্যার আসলে সামাল দিয়েন” বলে কলিগের মাথার একটা সেলকে ব্যস্ত রাখার দরকার হয়না । বোর্ডে লিখা ছিল ল্যাব, লাঞ্চ, বাসায় , ব্যাক্তিগত কাজে ইত্যাদি । আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হল নাম লেখা চুম্বকখানাকে কখন কোথায় রাখতে হবে । মানি না মানি পরের কথা, সিস্টেম একটা রেডি । “ফাকি দেবার জো নাইরে মন” বলে মনকে শাসিয়েছিলাম ।
রাফুমান সান বলেই সবাই সম্বোধন করতে লাগল শুধু প্রফেসর ছাড়া । উনি আমাকে রাফুমান কুন বলেই ডাকা শুরু করলেন । তখন বুঝিনি সান আর কুন এর পার্থক্য । সোজা ভাষায় বললে সান হল আপনি গোছের আর কুন হল তুমি । কাছের কিংবা ঘনিষ্ঠদের ক্ষেত্রে কুনটাই ব্যবহার করে ।ভালই লেগেছিল প্রফেসরের এই ঘনিষ্ঠ হবার টেকনিকটাকে।
গাইডের ইন্সট্রাকশনে ফরম ভরাচ্ছি । জাপানীতে লিখার জায়গাগুলো উনি পেন্সিল দিয়ে লিখে দিলেন আমি কলম দিয়ে হাত ঘুরালাম । এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন সিল আছে কিনা । নাই জেনে একটু মাথা চুলকালেন । এখানে ওখানে ফোন করলেন । ফোন শেষে মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিল সীল ছাড়া হবে না । জাপানীরা সিলকে হাংকো (ハンコ) বলে, শুদ্ধ ভাষায় হল ইনকান (印鑑)। সবকিছুই আস্তে আস্তে জেনেছি। জাপানিজ সিল নিয়ে পরের সিরিজে লিখব আজ এটুকুই।
প্রফেসর আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন সীল সংগ্রহে। নিয়ে গিয়েছিলেন সিল বানানোর দোকানে । ২০০০ ইয়েন লাগবে শুনে একটু বেশীই আশ্চর্য হয়েছিলাম । খারাপ লাগছিল আমার নিজস্ব সাইনটার জন্য । কতই না কসরত করেছি সাইনটাকে পাকাপোক্ত করতে । কত দিস্তা কাগজই না নষ্ট করে সাইন প্রাকটিস করেছিলাম । শুন্যেও আঙ্গুল ঘুড়িয়েছি বহুবার । আব্বার সাইন দেখেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম নিজের সাইন সৃষ্টিতে । কলমটা ধরেই আব্বা একটা টান দিতেন, কাগজে যেটা খোদাই হত, সেটাকে আমার কাছে মনে হত বড় কোন শিল্পীর মহৎ সৃষ্টি । সযত্নে লালিত আমার সেই সাইনটা ব্যবহার করতে পারব না দেখে মনটা বেশ খারাপ হয়েছিল । সিল বানানোর চার্জটা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত কাজ করেছিল ।