বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সব ধর্মের মধ্যে যে সম্প্রীতি তা কি আজ ফিকে হয়ে আসছে? আমরা কি আবারো পারি না ভালোবাসা দিয়ে একে অপরকে সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধতে!
\মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম, হিন্দু মুসলমান – আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গানটি আশির দশকে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সব সময়ই গাইতো৷ উদীচীর হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়ে এই গানটা প্রায়ই গাওয়া হতো৷
ঠিক এই গানটি যেন দিনাজপুরের তৎকালীন চিত্রটা ফুটিয়ে তুলতো৷ দিনাজপুরের মতো অসাম্প্রদায়িক এলাকা বাংলাদেশে হয়ত খুব কমই আছে৷ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে ঘুরতে গিয়ে আমার বন্ধুদেরও একই অনুভূতি৷ দিনাজপুরে মায়ার বাঁধনে হিন্দু মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে যেন মিলে মিশে একাকার৷ সারা বছরই শহরটায় উৎসব লেগে থাকতো৷ বছরে দু’টো ঈদ, শবে বরাত, কালী পূজা, দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজায় যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল হিন্দু-মুসলমান সবার মাঝে, তাতে বোঝা কঠিন ছিল, কোনটা কার উৎসব৷
রোজার ঈদে চাঁদ রাতে বাবার বন্ধুরা দাওয়াত দিতে আসতেন আমাদের বাসায়৷ ঈদের দিন ঘুম ভাঙতেই মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানু, আমাদের তানু কাকা হাজির হতেন মোটরসাইকেল নিয়ে৷ আমরা দুই বোন তাতে সওয়ার হয়ে রওনা দিতাম তাঁর বাসায়৷ দুপুর পর্যন্ত ওখানেই কেটে যেতো আমাদের৷ কাকিমার হাতের দারুণ সব রান্নার স্বাদ যেন এখনো জিভে লেগে আছে৷ বাবা সেখানে আসতেন দুপুর বেলায়৷ মা মাংস খেতেন না বলে কাকিমা মায়ের জন্য সেমাই দিয়ে দিতেন বাক্সে ভরে৷ কেবল ঈদের দিন না, পরের দু’দিনও বন্ধু বান্ধবদের বাসায় ঘোরাঘুরি৷ আইসক্রিম খাওয়া, আরও কত কি! ঈদ যে আমাদের কোনো উৎসব না, এটা কখনোই মনে হয়নি, বরং রোজা শুরুর অপেক্ষায় থাকতাম আমরা৷
৮০’র দশকে রোজা হতো গ্রীষ্মকালে৷ রোজার সময় রাস্তায় বরফ বিক্রি হতো৷ বসতো আতরের দোকান৷ রাস্তায় রাস্তায় লাচ্ছা বানানো দেখতাম অবাক হয়ে৷ কীভাবে হাতের জাদুতে নিমেষে সুন্দর লাচ্ছা তৈরি হয়৷ আর কখন ইফতারের দোকান বসবে সেই অপেক্ষায় রাস্তায় তাকিয়ে থাকতাম৷ মায়ের কাছে টাকা নিয়ে ছুটতাম ঘুগনি, জিলাপি, চপ এসব কিনতে৷ পাশের বাড়ি থেকে ইফতারের সময় প্রায়ই কিছু না কিছু খাবার আমাদের বাড়িতে আসতো৷ এটা যে শুধু আমাদের বাড়িতে হতো এমন না৷ আমাদের অনেক পরিচিত বাড়িতে গিয়েও শুনতে পাবেন একই গল্প৷ দিনাজপুরে ঈদ যেন সার্বজনীন উৎসব৷ কোরবানি ঈদে আমাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল৷ বাবার বন্ধুরা গরুর পাশাপাশি খাসি কোরবানি দিতেন, যাতে তার হিন্দু বন্ধুরাও কোরবানিতে শামিল হতে পারে৷ এমনকি কোরবানির মাংস আমাদের বাসাতেও পাঠাতেন তাঁরা৷
একই ধরনের ঘটনা ঘটতো পূজার সময়৷ দুর্গা পূজা বাঙালিহিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব৷ বিশ্বকর্মা পূজার পর প্রতিমা গড়া শুরু হতো৷ আমি ও আমার অনেক মুসলমান বন্ধুরা স্কুল থেকে ফেরার সময় পূজা মণ্ডপে শিল্পীর হাতের অপূর্ব কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হতাম৷ পুরো মাস ধরে ধীরে ধীরে কীভাবে প্রতিমা গড়ার কাজ সম্পন্ন হয়, দেখতাম অবাক হয়ে৷ অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন, সেসব প্রশ্নের সব উত্তর ছিল রাখাল কাকার কাছে, যিনি প্রতিমা গড়তেন৷ দিনাজপুরে এক আমাদের এলাকাতেই যে কত পূজা হতো৷ পূজার দিন সকাল থেকেই ঢাক বাজতে শুরু করত৷ সাথে ভেসে আসতো পুরানো দিনের গান৷ নিমতলার পরিবেশটাই ছিল অন্যরকম৷ আজানের সময়গুলোতে ঢাক এবং সাউন্ড বক্স বন্ধ থাকতো৷
সপ্তমীতে সকালে উঠে স্নান করে নতুন জামা পড়ে আমাদের কাজ ছিল বাবার বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে নাড়ু মুড়ি দিয়ে আসা৷ তাদের জন্য আলাদা করে বেশি করে তৈরি করে দিতেন মা৷ এছাড়া আমার বাবার গদিতে তার বন্ধুদের আড্ডায় তো পূজার নানা রকম খাওয়া দাওয়া চলতে থাকতো৷ এরপর আমার বান্ধবীরা এবং দিদির বান্ধবীরা, যাদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান আমাদের বাড়িতে বা আমার এক বান্ধবী রুম্পার বাড়িতে জড়ো হতাম৷ সেখান থেকে শুরু হতো আমাদের পূজা পরিক্রমা৷ অর্থাৎ চড়কিতে ঘোরা, কদবেল, বারো ভাজা খাওয়া৷ নবমী পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই দিনেরবেলায় বের হতাম আমরা৷ সন্ধ্যায় যখন ঠাকুর দেখতে বের হতাম, তখন হিন্দুরাই কেবল নন, মুসলমানদেরও নতুন পোশাক পরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরতে দেখতাম৷ শুধু তাই না, অনেক এলাকায় পূজা মণ্ডপের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন মুসলমানরা৷ এমন ভ্রাতৃত্ব আর সম্প্রীতি উদাহরণ আজকাল খুব কমই দেখা যায়৷
এমনকি ভাসানের সময় সবাই একসাথে বিদায় জানাতে যেতেন মা দুর্গাকে৷ দশমীর দিন আমাদের বাড়িতে বাবার সব বন্ধু এবং তাদের পরিবারের নেমতন্ন থাকতো৷ দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে ছাদে উঠে সবাই ভাসানো দেখতে দাঁড়াতাম৷ সেই দিনগুলোর কথা আজও চোখে ভাসে৷ আমার বাবার মৃত্যুর পর প্রতিবার পূজায় আমাদের নতুন জামা বাদ যায়নি, সেটা কোনো রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় আমাদের হাতে তুলে দেননি, দিয়েছিলেন বাবার বন্ধু তানু কাকা, কখনো আসাদ কাকা৷
ঢাকায় এসে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ দেখেছি সরস্বতী পূজার সময়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে প্রতি বছর সরস্বতীর কৃপা লাভের জন্য হিন্দু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মুসলিম শিক্ষার্থীরাও যোগ দিতেন৷ পূজা মণ্ডপ সাজানো থেকে প্রসাদ বিতরণ পর্যন্ত অনেক কাজেই অংশ নেন তারা৷ ছোটবেলা থেকে এমন পরিবেশে বড় হওয়ায় বরাবর চাইতাম, এমন কি হতে পারে না আমি যদি ঈদ আর পূজা দু’টোর আনন্দই সারাজীবন নিতে পারি? বিধাতা হয়ত তখন মুচকি হেসেছিলেন৷ তাই আমি বিয়ে করলাম একজন মুসলমানকে৷ সাংবাদিকতা যারা করেন, তারা সবাই জানেন, দুই ঈদে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কর্মীরা কখনোই ছুটি পান না৷ আমিও বিয়ের আগে কখনোই পাইনি৷ কিন্তু বিয়ের পর রোজার ঈদে আমাকে ছুটি দেয়া হলো, রোজার ঈদ শ্বশুরবাড়িতে আর পূজার ছুটিতে বাপের বাড়ি৷ আহা কী আনন্দ আমার!
আমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও শুনেছি তাদের ছোটবেলার কথা৷ দিনাজপুরের মতো তাদের বাড়িতেও পূজার সময় নাড়ু, মুড়ি, মুড়কি দিয়ে যেতেন প্রতিবেশী হিন্দুরা৷ পূজার সময় প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতেন তারা৷
গ্রামের নওজাওয়ান হিন্দু-মুসলমান মিলিয়া বাংলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম….আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম৷
সত্যিই দিন দিন বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং উপজাতিরা যেভাবে হামলার শিকার হচ্ছে, তাতে এই গানটিই সবার আগে মনে পড়ে৷ পূজা এলেই কোথাও না কোথাও প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়৷ এখনও কিছু কিছু এলাকায় পূজার সময় মুসলমানরা মণ্ডপ পাহারা দেন৷ কিন্তু আগের সেই আনন্দ যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে যেন একটা ফাটল ধরেছে৷ হিন্দুদের উপর হামলার কারণে অনেকেই আজ দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিচ্ছে৷ কিন্তু নিজের দেশের ভিটেমাটি ছেড়ে ওখানে গিয়ে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন যে কী কষ্টের, তা তারাই জানেন৷ একটা দেশ তখনই বেশি সুন্দর, যখন তাতে বৈচিত্র বেশি৷ এই প্রজন্মের কাছে আমার আবেদন, তারা যেন ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলে, স্থাপন করে সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ (সূত্র: অমৃতা পারভেজ, ডয়চে ভেলে)