আর্তনাদ

আর্তনাদ

প্রতীকি ছবি

আমি খুব আন্তরিকভাবে সোশ্যাল ওয়ার্কারদের স্মরণ করি।
কথা বলছিলাম একজন সিনিয়র সোশ্যাল ওয়ার্কার রুথের সাথে।
– জানো তোমাদের কারনে আমি খুব উপকৃত হয়েছিলাম নতুন মা হিসাবে।
– তাই বুঝি?
– আমার হাসপাতালের সোশ্যাল ওয়ার্কার আমার ফাইলে রিকোয়েস্ট লিখে রাখার কারনে আমাদের যখনই দরকার পড়েছে সময় মত নার্স প্রতিবার বাসায় এসে দেখে যেত। আমাকে যেতে হয়নি।
এই একা জীবনে এটা অনেক বড় সাহায্য ছিল। চিরদিন মনে থাকবে।
– হ্যা এখন অনেক সুযোগ সুবিধার রিকুয়েস্ট করা যায় যা আগে যেতো না। আমি কাজ শুরু করি যখন সত্তুরের দশকে এখনকার মত অবস্হা ছিলোনা অথচ খুব বেশিদিন আগের কথা না।
জানতো সোশ্যাল ওয়ার্কারদের ‘’ব্লিডিং হার্ট’’ বলা হতো।
– তাই বুঝি?
– এখন যেমন কর্মস্থলে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া, তখন অল্প কিছু লোকের হাতেই সব ক্ষমতা থাকতো।
এমনকি সাধারণ মানুষও এখনকার মত নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন ছিলোনা।
– এখন হয়তো অনেক আইন কানুন পালটেছে, তাইনা?
– হ্যা অনেক পাল্টেছে শুধু কিছু আর্তনাদ চিরদিনই চাপা থেকে যাবে।
– এই কথা কেন বলছো?
– তাহলে একটা গল্প বলতে হয়। শুনবে?
– হ্যা অবশ্যই।
লুসির হাসপাতালের রেকর্ড অনেক পুরানো। ধুল জমা বেশ অনেকদিনের অনেকগুলো ফাইল ওর। বেশ কিছুদিন ব্যস্ততার কারনে লুসির ফাইল আর দেখার সুযোগ হলোনা। কি মনে করে একদিন ঠিক করলাম লুসির সব ফাইল খুঁজে বের করব। লুসির সাথে অল্পই কথা হয়েছে তাই আবার কথা বলতে চাচ্ছিলাম যে দেখি যদি ওর কিছু বলার থাকে।
আমার সাথে লুসির দেখা হয় যখন ওর বেশিক্ষন কথা বলার দম থাকতোনা। তবুও আস্তে আস্তে একটু একটু করে কথা বলতে চাইতো।
আমার সবসময় কি মনে হয় জানো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো একজন সঙ্গী থাকা যার সাথে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়।
ওর মনে হতো সবাই চিৎকার করছে। চিৎকার বন্ধ করো বলে কাঁদতে থাকতো। কে যেন এসে ওকে বলতো তুমি দেখে নিয়ো, ‘না খেয়ে মরবে’। ‘কেউ সাহায্য করতে আসবেনা’। ‘‘সেই কেউ’’ টা ওকে অস্থির করে তুলতো।
এই জীবন সায়ান্যেও লুসির জীবনে একটাই আতংক ছিল। যদি বাড়িতে কোন খাওয়া না থাকে, দিনের পর দিন যদি না খেয়ে থাকতে হয়?
এমন ঘটনা তার জীবনে সত্যি ঘটেছিলো। লুসির বাবা একদিন যে গেলো ওদের ছেড়ে আর ফিরলোনা। ওর মা তখন নয় মাসের গর্ভবতী। ওরা দুটি বোন ছোট ছোট। একজনের ছয় বছর আর লুসির কেবল পাঁচ হলো। রাতের বেলা চিৎকারে ঘুম ভেঙে ওরা দেখল প্রতিবেশীরা ঘরে এসে মাকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করছে আর মা শুধু চিৎকার করেই যাচ্ছে। ভয়ে ওরা শুধু এক কোনায় দাঁড়িয়ে রইল। ওদের পাশের বাসার মিসেস ক্লেয়ার ওদের সেই রাত থেকে রাখলেন।
এক সময় মা একাই হাসপাতাল থেকে ফিরে আসলো। বাচ্চাটা কেন ফিরলোনা তাকি জিজ্ঞেস করেছিলো কিনা মনে পড়েনা। তবে দুই বোন আর মা নিয়ে আবার ওদের সংসার শুরু হল। মা এখন একা একা ঘরে চুপ করে বসে থাকে, ডুকরে কেঁদে উঠে। কাছে যেতেও ভয় লাগে।
এমন একদিন আসলো মিসেস ক্লেয়ারের দেয়া কিছু পরিজ আর শুকনা রুটি শেষ শেষ হয়ে গেলো, ঘরে আর কোন খাবার ছিলোনা। খিদায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলোনা লুসি কিন্তু ভয়ে বলতেও পারছিলোনা।
কিভাবে খেয়ে না খেয়ে সেই দিনগুলো পার হয়েছে এখন আর আগের মত স্পষ্ট স্মৃতি নেই তবু আবছা মনে পড়ে একদিন ওদের খালা এসে ওদের নিয়ে গিয়েছিলো। ওর মা কে আর কোনদিন দেখেনি লুসি বা ওর বোন। শুধু শুনেছিলো মা আত্মহত্যা করেছিলো।
এরপর আবার হঠাৎ একদিন ওকে বলা হলো খালা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, লুসিকে ওর দূর সম্পর্কের আত্মীয় সন্তানহীন মার্থা আর রিচার্ডের কাছে দিয়ে দেয়া হলো। ওর বোনকে খালা নিয়ে গেছেন সাথে। ওদের সাথে শুধু চিঠিতে যোগাযোগ ছিলো, হয়তো শুধু বছরে একবার কি দুইবার চিঠি, কার্ড আদান প্রদান হয়।
সম্পর্ক বলতে এটুকুই।
নতুন জীবনে মানিয়ে নেয়া খুব অসুবিধাজনক ছিলোনা, মার্থা আর রিচার্ড চেষ্টা করেছে ওকে স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে। ওর বয়স পনেরোতে পড়ার সময় মার্থা মারা গেলো। রিচার্ড কেমন একা হয়ে গেলো। প্রায় রাতেই মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে, সাথে বান্ধবীরা আসে যায়।
এই বয়সী একটা মেয়ের প্রতিটা কাজে বাবা জাতীয় কারো কাছে হাত পাততে খুব অসুবিধা হয়। আর যেখানে সম্পর্কটা দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছিলো। লুসি বাড়ির পাশের ফিশ এন্ড চিপ্সের দোকানে একটা কাজ নিলো। এই গরম চুলার পাশে সপ্তাহে তিন দিন কাজ করা পাশা পাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া খুব কষ্ট হচ্ছিলো। স্কুল শেষে এক সময় আর পড়া হলোনা, লোকাল কাউন্সিলের অফিসে রিসেপশনে একটা কাজ পেয়ে গেলো ফুল টাইম।
ততদিনে আর লুসি রিচার্ডের বাড়ি থাকেনা, এক বান্ধবির সাথে একটা এপার্টমেন্ট শেয়ার করে থাকে। রিচার্ড ওর বাড়ি বিক্রি করে ওর মায়ের গ্রামের বাড়িতে চলে গেলো যাতে শান্তিতে মরতে পারে। যাবার আগে লুসিকে কিছু টাকা দিয়ে গেলো, দুঃখ করে বললো তোমাকে কিছুই দিতে পারলামনা। লুসি এটুকু আশা করে ছিলোনা তবে ও বাচ্চাদের চ্যারিটিতে টাকাগুলো দান করে দিলো, এই প্রথম কাউকে কিছু দিতে পেরে ওর মনে হয়েছিল ওর আরো থাকলে আরো দিতো। কত বাচ্চারা খেতে পায়না অথচ আমরা ব্যাংকে টাকা জমিয়ে ফেলে রাখি।
ছোট চাকরি, বেতন কম তবুও লুসির জন্য সম্মানজনক জীবন ছিল। ও ছুটির দিনে বাচ্চাদের চ্যারিটিতে ভলান্টারি কাজ করতো। নিজেকে নিয়ে আলাদা করে ভাবনা যেন ওর আসতোইনা। তিন বেলা খেতে পারা আর মাথার উপর একটা ছাদ থাকলে যথেষ্ট, এরপর অন্যের তরে সাহায্যের হাত বাড়ানোটাই ওর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো।
ওর বোনের কাছে একবার চিঠি লিখলো পারলে বেড়াতে এসো। ওর বোন এসেছিলো কিন্তু আসার পর লুসির মনে হলো ওরা দুজন দু প্রান্তের মানুষ। যেমন ছিল ওর মা আর খালা। ওর বোন খুব কর্তৃত্ব পরায়ণ, সারাক্ষন টাকা পয়সা নিয়ে হিসাব, বড়লোক বয়ফ্রেন্ড ও দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানোটাই ওর জীবন। লুসির এই সাদা মাটা জীবন ওর কাছে তুচ্ছ। খুব তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলো সে লুসির বর্তমান জীবনকে। লুসি অবাক হয়ে শুধু ভাবলো জীবনতো পড়েই আছে উন্নতি করার জন্য, এতো তাড়া কিসের!
এখন এই অবস্থায় মাঝে মাঝে নাকি ওর মনে হয় তাহলে কি ওর মা আর ও বেশি ইমোশনাল ছিল আর ওর খালা আর ওর বোনই ঠিক ছিল?
জীবন কখন শেষ হয়ে যায় কে জানে, বেঁচে থাকতে নিজেকে একটু ভালবাসা প্রয়োজন।
ওর জীবনে দুজন পুরুষ মানুষ এসেছিলো। ও দুজনকেই মন দিয়ে ভালবেসেছিল। একজন দেশ ছেড়ে চলে গেলো। ও না করেছিল। ওর ইচ্ছা ছিল দুজনে সংসার পাতবে। কথা কাটাকাটি হলে সম্পর্কই ভেঙে গেলো।
দ্বিতীয়জনের সাথে সম্পর্কের এক মাসের মাথায় বিয়ে।
এ পর্যায় আসলে লুসি আর কিছু বলতে পারলোনা। ও বেশ অনেকদিন কথা বলার অবস্থায় ছিলোনা।
আমি প্রতিদিন ওর বেডের কাছে এসে দেখে যেতাম, দুদিন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ছিল।
যেদিন জ্ঞান ফিরলো আমাকে খুঁজলো। নার্সের কাছে শুনে দেখতে গেলাম, ও শুধু একটা কথাই বলছিল আমার বাচ্চাদের একটু দেখতে চাই।
নার্স বলল এযাবৎকালে লুসিকে দেখতে কেউ আসেনি, ওর বয়স পঞ্চাশের উপর। বাচ্চা থাকলে এতদিনে বড় হয়ে যাবার কথা।
এরপর যে কদিন লুসি বেঁচে ছিল আর একটি কথাও বলতোনা, শুধু বলতো আমার বাচ্চাদের একবার দেখতে দাও। প্লিজ। বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো, ডাকতো যে শুনে যাও, একটু শুনে যাও, কিন্তু ওই চোখের দিকে তাকানো যেতোনা।
আমরা সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে যে যার কাজে চলে যেতাম।
মানুষের অসহায় রূপ চেয়ে চেয়ে দেখা যায়না।
কন্সাল্ট্যান্টকে ধরলাম সুযোগ বুঝে যে লুসি যখন বলছে ওর বাচ্চাদের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থ্যা করি। নইলে অমানবিক ব্যাপার হবে, ওর বাচ্চারা পরে আমাদের ধরবে।
ব্যস্ত কন্সাল্ট্যান্ট দ্রুত বলে গেলো, ও সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে ভর্তি কেন শরীরে এতো কঠিন রোগ থাকা সত্বেও? আমি বললাম ও সিজোফ্রেনিক তাই! তিনি বললেন ওর স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে ও এতটাই ভয়াবহ অসুস্থ্য ছিল, ওর কোনো বাচ্চা নেই, ও হ্যালুসিনেট করে। আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি চলে গেলেন।
লুসির ফাইল দেখবো বলে ভেবেছিলাম, কেন যেন মন বলছিলো ওর কাউকে খুঁজে পেলে যোগাযোগ করে ওর খবর জানাতাম। অনেকগুলো ফাইল। লুসি অনেক বছর ধরে অসুস্থ্য। একের পর এক ফাইল প্রতিদিন দেখার সুযোগ পেলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতাম। কিন্তু ফাইলগুলো শেষ করার আগে আগে তথ্য পেলাম লুসি ওর দ্বিতীয় বাচ্চার জন্মের পর পোস্ট নেটাল ডিপ্রেশনে প্রথম মানুষিক হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিল। ওর বাচ্চাদের ফস্টার কেয়ারে দিয়ে দেয়া হয়েছিল আর লুসির কোন আত্মীয় কোনদিন লুসির সাথে দেখা করতে আসেনি।
আমি দ্রুত এজেন্সির মাধ্যমে বাচ্চাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। লুসিকে খবরটা দেয়ার আগে জানলাম ও আবার ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে কথা বলার অবস্থায় নেই।
কেন যেন মনে হলো লুসির আর ওর বাচ্চাদের সাথে দেখা হবেনা।
লুসির ওলটপালট পৃথিবী, তবু মা তো মা-ই মরতে মরতেও বাচ্চাদের কথা ভুলেনি। ওর এই হ্যালুসিনেশনের জীবনে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা তা ও নিজেও বুঝতোনা তবুও ওর বাচ্চাদের অস্তিত্যের কথাটা ঠিকই ছিল।
ওই সময়ে আমরা এখনকারমত সচেতন হলে ওর বাচ্চাগুলোকে দেখে যেতে পারতো।
এটুকু ওর পাওনা ছিল পৃথিবীর কাছে।
এপর্যায়ে রুথ নিজেই চুপ হয়ে গেলো, ওর গলা ধরে এসেছিলো।
আমি আস্তে করে বললাম এরপর কি হলো বলা যাবে?
রুথ বললো এরপর নিজেকে বোঝালাম প্রফেশনের বাইরে আমিওতো একজন মা।
বাচ্চাদের সাথে একসময় যোগাযোগ করতে পারলাম, খবরটা দিতে পারলাম।
চিঠি পাঠিয়েছিলাম, কিছু অসুখের বিবরণ আর সত্যিটা লিখলাম যে তোমাদের জন্মদাত্রী মা মারা গেছে।
এটুকু না করলেতো নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারবোনা।
ঐ যে বলেছিনা , সোশ্যাল ওয়ার্কারদের ব্লিডিং হার্ট!

 

শারমিন সারা