পরবাসী জীবন একান্ত অনুভব ২

পরবাসী জীবন একান্ত অনুভব ২

পরবাসী জীবন একান্ত অনুভব (ছবিঃ সংগৃহিত )

সিডনী বাঙালী ডট কমে আমার প্রথম লেখাটা যারা পড়েছেন এবং আন্তরিক মতামত জানিয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা নিয়েই আবার এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি!!!

খুব সহজ করেই হয়তো বলছিলাম, এই পরবাস জীবনে একজন মিঃ কূল ভাই এবং ফুল আপার মত (ছদ্ম নামের) এক দম্পতির কথা। এই বিষয়েই আরো কিছু কথা শেয়ার করতেই দ্বিতীয় লেখাটা।

প্রবাস জীবনে এসে প্রথম দেখেছি একজন ভাই তার ওয়াইফকে অনেক বেশী হেল্প করেন ঘরের কাজে, যেটা দেখে আমি সদ্য বাংলাদেশ ছেড়ে আসা একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম। কারণ কাছের মানুষদের মাঝে অল্প বিস্তর তেমনটি দেখলেও, এটা আমাদের বাংলাদেশের মোটা দাগের চিত্র নয়। ইনফ্যাক্ট, আমাদের পুরুষ সদস্যদের কাউকে রান্না ঘরে দেখলেও, আমাদের মুরুব্বীদের কেউ কেউ বলে উঠেন, ‘’বেটা ছেলে কেন রান্না ঘরে ঘুরঘুর করবে’! এ কী অকাণ্ড!!!

আমাদের প্রবাস জীবনের একটা সাধারণ চিত্র কেমন হয়… সিঙ্গেল বা পরিবার নিয়ে বসবাসে আছে ভিন্নতা। তারপরও, ঘরে বাইরে কাজের মাঝে অনেকটা সাদৃশ্যও যে আছে বলা যেতেই পারে।

নিজেদের, তিন বেলা খাবার ভাবনা বা আয়োজন, গ্রোসারী, গাড়ী বাড়ী ক্লিনিং, বিলিং এবং বাইরে কাজ থাকলে সেটা। এটা একটা স্বাভাবিক জীবন ধারা। স্টুডেন্ট লাইফে বাংলাদেশ থেকে এসে অনেককেই দেখা যায় শুরুতেই বিশাল একটা ধাক্কা খায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে তো উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের গ্লাসে ঢেলে পানিও খেতে হয়না অনেকের। তারউপর মেয়েদের কেউ কেউ ঘরের একটু আধটু কাজ করলেও, আমাদের ছেলেদের, না এটা খুবই ব্যাতিক্রম ধারা।

তাই স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশে যে ছেলেটি কোনদিন ভাত কেমন করে ফুটে, বা গ্লাসে পানি ঢেলে খেতে গেলে আগে পিছে কী করতে হয় বা প্রয়োজন হলে নিজের বিছানার মশারীটাও হয়তো মা বা বোনই যত্ন করে টানিয়ে দিয়েছে তার জন্যে হঠাৎই জীবন খুব সঙ্গীন হয়ে উঠে বৈকী। তারপর প্রয়োজন ঠিক শিখিয়ে নেয়… শিখে নিতেই হয়!!!

যেসব নুতন দম্পতি আসে প্রবাস জীবনে তাদের অনেকের মাঝেই দেখা যায়, সম্পর্কও অনেক বন্ধুত্বপুর্ন এবং সঙ্গী হিসেবে তারা একে অপরের কাছে খুবই হেল্পফুল। কিন্তু কিছু সময় আগের বা গড়পরতা চিত্র একদমই আলাদা।

আপনাদের মাঝে অনেকের হয়তো জানা নেই, কোন দাওয়াতে গেলে কিছু ভদ্রমহিলা একসাথে হলে ঠিক কী কথা বলেন… না মানে অনেককিছু নিয়ে বললেও, আজ আমি নিজে একজন ভদ্রমহিলার প্রতিনিধি হয়ে একটা গোপন টপিক (নিজেদের বৃহত্তর স্বার্থে) শেয়ার করেই ফেলি। সেটা হচ্ছে, কেউ না কেউ একজন হয়তো বললো, বাসায় আমাকে আমার হাজবেন্ড বা বাচ্চারা একদম হেল্প করেনা, এতো কাজ হাঁপিয়ে উঠি। সাথে সাথে একটা দীর্ঘশ্বাসের রোল উঠে যায়… ‘’ হায় হায় আপা কী বলেন আপনার স্বামী তাও কিছু না কিছু করে’’ জানেন আমার হাজবেন্ডকে তো বিয়ের ১০ বছরেও এটাই শিখাইতে পারিনি, চা কফি খেয়ে যে মগটা না ধুইলেও সিংকে নিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়’’।

ইস আপনি আছেন চা কফির মগ নিয়ে, ‘আমার হাজবেন্ড আর টিন এজ দুইটা ছেলে জানেন আপা ওরা এটাই জানেনা যে আমাকে ওদের টয়লেট যে প্রায় প্রতিদিন ক্লিন করতে হয়’’

আপনি একথা বলছেন, আমি যে রান্না করি, ঘর ক্লিন করি, বাজার সদাই করি, মেহমানদারী করি, আমার হাবি একটা ফুল টাইম জব করে এতোই টায়ার্ড আর বিজি থাকে যে সে এইসব তো জানেইনা। সপ্তাহে একদিন যে ময়লার বিনগুলো রাস্তায় দিতে হয়, এই হেল্পটুকুও আমি ভুলে গেলে তার কাছ থেকে পাইনা। আমি ভুলে গেলাম তো একটা সপ্তাহ গেল মিস হয়ে… বুঝেন অবস্থা।

অন্য আপা ‘’শোন তোমরা যা বলছো তা তো খুবই বেদনার, কিন্তু, কেমন লাগে বল, ধর আমি যে এগুলো করি, এটা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। কারণ আমি সপ্তাহে দুই মাত্র কাজ করি, আমার সময় আছে ঘরের সব কাজ করার। আমি শুধু চাই, সে কাজের বাইরের সময়টুকু আমাকে, মানে বাসায় খুব ভালো মুডে থাকবে এবং আমি যা করছি তা ফিল করবে। কেমন লাগে সেই মানুষ যদি হঠাৎ কাছের বন্ধু বেড়াতে এলে কথা প্রসঙ্গে বলে উঠে, ‘কী রান্না নিয়ে প্যাচাল পারছো, প্রতিদিন তো আর রান্না করোনা’’। মানে সে মাঝে মাঝে ফ্রিজের তরকারী গরম করে খায় বলে এমন এক কথা বলে বসলো, তখন কী আমার মন খারাপ হতে পারে, না পারেনা তুমিই বল’’!!!

হুম ভাবি, আপা, দিদিদের সবার সব কথা শুনে আসলে কেউ কেউ মনে করতে পারেন আমরা আমাদের লাইফ পার্টনারদের ভিলেন হিসেবে প্রতিপন্ন করছি। আসলে কী তাই… আমি আসলে বিষয়টা দুইভাবে দেখি…

১। বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের পুর্বপুরুষ থেকে আজকের ভাই, বেরাদর এবং স্বামীকূল। যে লাইফ স্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে বেড়ে উঠেছেন, হুট করে দুই চারজন বদলে গেলেও সবাই রাতারাতি বদলে যাবেনা বা এটা আশা করে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

২। আজকাল এগুলো নিয়ে আমরা বলতে শুরু করেছি। কারণ একটাই, আমাদের এই প্রবাস জীবনে যতবেশী সুপার ওম্যান চোখে পড়ে বিশেষ করে বাংলাদেশী মেয়েদের মাঝে তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের ভাইদের ঘরে বাইরে সমান কর্মকান্ড চোখে ওভাবে পড়েনা কিন্তু। বিষয়টা চেপে যেয়ে যে যার মত ভালো থাকার চেষ্টা হয়তো করছে কিন্তু একটা হতাশা ঠিক বুকের মাঝে জন্ম নিচ্ছে, সেটা ডালা পালা হয়ে যেকোন সময় মহীরুহ হয়েই যেতে পারে।

এইটুকুন পড়েই কেউ আবার ভেবে বসবেননা সেইরকম জ্ঞান ফলাচ্ছি, ‘তুমি কে হে বাপু’। আসলে আমি চেষ্টা করছি রীতিমত ভিক্টিম যারা তাদেরকে ফিল করেই এই বিষয়টি তুলে আনতে। কেউ একজনও যদি নেড়ে চেড়ে বসে একটু ভাবেন আমি ঠিক কী বলতে চাইছি, তাতেই ধন্য হবো।

এবং এর সাথে যা এড না করলেই নয়, এখানে লাইফ পার্টনারকে জেন্ডারের বাইরে এনেও বলতে চাই। যদিও ব্যাতিক্রম উদাহরণ হয়না… তারপরও অনেক সময় দেখা যায় কিছু ভদ্রমহিলা সংসার করছেন ঠিকই কিন্তু ঘরের খুঁটিনাটি কিচ্ছুতে তার কোন ভুমিকা নেই। আমি এই বিদেশে এমন অল্প কজন ভাইকে দেখেছি বাসায় কিছু অতিথি আপ্যায়ন করতে গেলে, তাদের ওয়াইফ নামক মানুষটির কোন ভুমিকা থাকেনা। ভাইদেরকে রান্না থেকে শুরু করে সব একা হাতে করতে হয়… এবং কোন কোন ভাই এতোই সুপার কূল যে, এই নিয়ে কোন অশান্তিতো করেনই না, স্ত্রীকে ঘিরে বরং এমন লেভেলের একটা শ্রদ্ধা যা দেখে আপনি নিজের অজান্তেই বলে উঠবেন, এখানে ‘জীবন সুন্দর’’!!!

শেষ করি, পুরো লেখায় যা বলতে চেয়েছি তা দুই কথায় প্রকাশ করে…

১। আমি মনে করি, এটা এখন সময়ের দাবী, একটা পরিবারে বসবাস করলে সেই পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের উচিত ঘরে এবং বাইরের কাজের লোডগুলো একটু ভাগ করে নেয়া। কারো বাইরে কাজের ধরণ যদি একটু বেশীই অন্যরকম হয়, মানে ঘরের কোন কাজে হেল্প করার সময়ই নেই প্রতিদিন, তবে তার উচিত এই বিষয়টা অন্যভাবে মেইনটেইন করা। সপ্তাহে বা মাসে কিছু এফোর্ট দিন, ঘরের অন্যরা যা কাজ করছে তার এপ্রিসিয়েশন করতে শিখুন। সমালোচনা, এবং তা বাইরের মানুষের সামনে ‘না’ বলুন। জী এর আগে যদি ভুলে সেটা করেও থাকেন, আজ থেকে বদলে যান, বদলে দিন আপনার যাপিত জীবন এবং সংসার…

২। কারো উপর সবটুকু নির্ভরতা একদমই কোন কাজের কথা না। যে আপা ভালোবেসে বলেন, আমার স্বামী সন্তান আমার রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা, এটা খুব ভালো কথা না। আপনার রান্না একটু ভালোবেসে উপভোগ করুক কিন্তু তার বাইরেও খেতে হবে এবং সেটাও উপভোগ করা শিখতে হবে, তাদের নিজেদের জন্যে এবং আপনার জন্যেও।

সবাই সবার কাজ করলে, পরিবারের এক দুইজনেরই শুধু সব সময় সবকিছু নিয়ে ভাবনা বা হতাশাটার জন্মই হবেনা। কেউ একজন অনেক বেশী কাজ করলে, বাকিদের তেমন কোন কাজ না করলে যে অনেকবেশী কাজ করছে তার জীবন যাত্রা একটু না একটূ ব্যাহত হয়। মেজাজ একটু না একটু খিটখিটে হয়। এমনও হতে পারে, তাকে অনেকসময় তাঁর মত করেই পরিবারের অন্যরা আর পায়না।

ক্রিস্টাল ক্লিয়ার করে বলি, আসুন যে যার জীবন যাপন করা, উদযাপন করা শিখি এবং পরিবারে থাকা সবাইকে সেটা শিখতে সাহায্য করি। এটা খুব বেশীই দরকার, যে যেখানে আছি, প্রবাসে তো বটেই।

যে আপনি সময় নিয়ে পড়লেন ধন্যবাদ এবং শুভকামনা অশেষ।

নাদিরা সুলতানা নদী
সংস্কৃতি কর্মী/ফ্রীল্যান্স লেখক/উপস্থাপক, রেডিও বাংলা মেলবোর্ন
সহযোগী সম্পাদক, প্রশান্তিকা
মেলবোর্ন প্রবাসী