ভোলা কান্ড

ভোলা কান্ড

ফজলুল বারী:ভোলার ঘটনা দেশের মানুষকে হতবাক করেছে। রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে শুভ চিন্তার মানুষদের। ভোলার প্রতি আমার নিজস্ব একটি ভালোবাসা আছে। পিতার চাকরি সূত্রে শৈশবের কিছু সময় কেটেছে ভোলায়। কালীনাথ রায়ের বাজারের মোল্লা বাড়ি আর তালুকদার বাড়ির মাঝখানের নাগরিক আলীর বাড়িতে আমরা থাকতাম। চারপাশে ছিল অনেক পুকুর-খাল। বাজারে-লঞ্চঘাটে গেলেই ভেসে আসতো ইলিশের গন্ধ। পিটিআই’র প্রাইমারী শাখায় আমি পড়তাম। নদী ভাঙ্গনে পিটিআই ভবন তলিয়ে গেলে সরকারি হাইস্কুল ভবনে মর্নিং শিফটে আমাদের ক্লাস হতো। মোল্লা বাড়ি, তালুকদার বাড়িতে আমার শৈশবের অনেক বন্ধুবান্ধব। বড় হয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় ভোলায় গিয়ে শৈশবের স্মৃতির ভোলাকে খুঁজেছি। অনেক কিছুই পাইনি। খালগুলোর বেশিরভাগ হয় ভরাট অথবা দখল হয়ে গেছে। ভালোবাসা থেকে ভোলার ভালমন্দ খবর পেলেই পড়ি-শুনি। ভালো খবর মন খুশি করে। বিষন্ন করে খারাপ খবর। বোরহানউদ্দিনের ঘটনাটা আমাকে ভারাক্রান্ত করেছে।

এবার বোরহানউদ্দিনের ঘটনাটা দেশের মানুষকে হতবাক করার কারন ঘটনাটি অনেকের মোটামুটি অনেকের জানা।  এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাকের পর প্রথম তার কাছে আইডি ফেরতের জন্যে কুড়ি হাজার টাকা দাবি করা হয়। হ্যাকড ফেসবুক আইডি কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে উদ্ধার করা বাংলাদেশের সিংহভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে অকল্পনীয়। এরপর সংখ্যালঘু যুবকটির আইডি ব্যবহার করে শুরু হয় বাংলাদেশের এক শ্রেনীর লোকের মুখস্ত শয়তানি। এমনিতে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সামাজিকভাবে যথেষ্ট চাপের মধ্যে থাকেন। কিন্তু এই হিন্দু যুবকদের আইডি থেকে এমন কিছু অকল্পনীয় কিছু কথাবার্তা লিখে সেগুলোর স্ক্রিনশট ছড়ানো হয় যা বাংলাদেশের কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একজন হিন্দু যুবকের পক্ষেতো নয়ই। শুধু বাংলাদেশ কেনো ভারতে বসেও কোন সুস্থ মস্তিষ্কের হিন্দু ধর্মাবলম্বীর পক্ষে এমন কিছু করা অসম্ভব। কারন সবারই কাজকর্ম আছে। সবাইকেই কাজ করে খেতে হয়।

যে কোন ধর্মপ্রাণ মানুষজনের স্বাভাবিক একটি বিশ্বাস এবং প্রতাশা হলো তার ধর্মীয় নেতারা অন্তত সত্য কথা বলবেন। ধর্মীয় নেতারা মিথ্যা বলতে পারেন বা অনৈতিক কিছু করতে পারেন এটা আমজনতার কাছে অকল্পনীয়। কিন্তু বাংলাদেশে বারবার নানা ঘটনায় দেখা যাচ্ছে এখানে ধর্মীয় নেতারাও ডাহা মিথ্যা কথা বলেন। দেশের একটি অংশ যখন বাংলা ভাই’র সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত তখনও জামায়াতে ইসলামীর নেতা মতিউর রহমান নিজামী সদম্ভে বলেছিলেন বাংলা ভাই বলে কিছু নেই। এটি মিডিয়ার সৃষ্টি। যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদিকে চাঁদে দেখা গেছে এমন একটি ডাহা মিথ্যা ছড়িয়ে বাংলাদেশে পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালিয়েছে। বোরহাউদ্দিনের হ্যাক করা আইডির মাধ্যমে পরিকল্পিত মিথ্যাচারের ঘটনায় ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দু যুবকটি থানায় গিয়ে জিডি করেছে। কিন্তু ততোক্ষনে সেখানে মহানবীকে (দঃ) কটুক্তির অভিযোগে তার ফাঁসির দাবিতে মিছিল শুরু হয়ে গেছে। মসজিদের মাইক ব্যবহার করে একজন নির্দোষ নিরীহ যুবকের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়। সাধারন মানুষের কাছে তার পরিচয় বিধর্মী। মহানবীর বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ালে যে কোন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ক্ষুদ্ধ হবার কথা। এক্ষেত্রেও তা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগটি সত্য কিনা তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেমন যাচাই বাছাই করা হয়না, এক্ষেত্রেও তা হয়েছে। কিন্তু এরমাঝে কড়া মূল্য দিতে হয় শান্ত জনপদ বোরহাউদ্দিনকে। হিংসা ছড়ায় সেখানকার সবখানে।

সবচেয়ে বিপদজ্জনক হলো এই ঘৃণা ছড়াতে ব্যবহার করা হয় মসজিদের মাইক। রামু-নাসিরনগরের ঘটনায়ও এভাবে মসজিদের মাইক ব্যবহার করা হয়েছিল। সাঈদির চন্দ্রাভিযানের অপ্রচার চালাতেও ব্যবহার করা মসজিদের মাইক। কোন মসজিদের মাইকে মিথ্যা প্রচার হতে পারে বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষ তা বিশ্বাস করেননা। ধান্ধাবাজরা বারবার এর অপব্যহার করে মিথ্যাচার চালাচ্ছে। বোরহাউদ্দিনের ঘটনা আমলে নিয়ে প্রশাসন তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিয়েছিল। তারা স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসে হিন্দু যুবকটির আইডি হ্যাক করে অপ্রচার, এ সংক্রান্ত থানায় জিডি, আইডি হ্যাককারীদের পটুয়াখালী থেকে গ্রেফতারের বিষয়টি ধর্মীয় নেতাদের অবহিত করে তাদেরকে পরের দিনের প্রতিবাদ সভা স্থগিত করার অনুরোধ করা হয়। ধর্মীয় নেতারা এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা দেন ইউনিয়নে ইউনিয়নে মাইক পাঠিয়ে সভা স্থগিতের বিষয়টি প্রচার করা হবে। কিন্তু ধর্মীয় নেতারা এ নিয়েও প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারনা করেছেন। তাদের দেয়া কথা রাখেননি।

উল্টো গোপনে প্রতিবাদ সভার প্রস্তুতি চলতে থাকে। মানুষ আনার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়। সকাল ১১ টায় সভা হবার কথা থাকলেও হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে সভাস্থলে এসে সমবেত হতে থাকে।  কারন তারা জানে নবীকে (দঃ) অসম্মান করেছে এক হিন্দু। এটা যে একজনের আইডি হ্যাক করে সাজানো ঘটনা তা তারা জানেনা। এরপর দোয়া করে সমাবেশ সংক্ষেপে শেষ করে দেয়া হবে বলে মঞ্চে নেয়া হয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের। কিন্তু প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করে সেখানে শুরু করা হয় উত্তেজক বক্তৃতা। একজন বক্তা সেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আক্রমন করে বক্তব্য দেন। প্রতিশ্রুতি অনুসারে মোনাজাত করে সভা শেষের জন্য কর্মকর্তারা তাগিদ দিলে শুরু করা হয় পরিকল্পিত সন্ত্রাস। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটকে ফেলা হয় মাদ্রাসার একটি কক্ষে। তাদের উদ্ধার করতে গেলে বিষয়টি রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে রূপ নেয়। চারজন নিহত শতাধিক আহত হন। নিহতদের দু’জনের মাথা থেতলে দেয়া হয়েছিল।

এরপর শুরু হয় আরেক তৎপরতা। নিহতরা ধর্মযুদ্ধে শহীদ। ধর্মযুদ্ধে নিহতদের মরদেহ পোষ্টমর্টেম করা যায়না বলে মৃতদেহ পোষ্টমর্টেম ছাড়াই হস্তান্তরের দাবি করা হয়। অথচ দেশের ফৌজদারি আইন হচ্ছে হত্যা মামলার বিচারে মৃতদেহের পোষ্টমর্টেম করাতে হবে। অনেকের ধারনা নিহত যে দু’জনের মাথা থেতলে গেছে তাদের বিষয়টি আড়াল করতেই এমন দাবি করা হয়েছে। ওই দু’জন পুলিশের হাতে মারা যায়নি। আর জেহাদ-ধর্মযুদ্ধ চলে ইসলামিক রাষ্ট্রে। বাংলাদেশ কোন ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। এর অফিসিয়েল নাম গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আর একজনের আইডি হ্যাক করে চরম মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মরক্ষা করতে হবে? এভাবে কি বাড়লো নবীর (দঃ) সম্মান? আমি বিভিন্ন সময়ে একটা কথা বলি তাহলো বাংলাদেশের সমাজে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব রয়েছে। এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি-অনাচারের বিরুদ্ধে তারা নেতৃত্ব দিতে পারেন। কিন্তু ধর্মীয় নেতারা তা কোনদিন করেননি। ফেনীর নুসরাতের ঘটনায় একজন মাদ্রাসা শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা পাবার পরও তার বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামেননি কোন ধর্মীয় নেতা। বোরহানউদ্দিনের ঘটনা ধর্মীয় নেতাদের অপ্রত্যাশিত মিথ্যাচারের বিষয়টি আবার সামনে নিয়ে এসেছে। এসব যে তাদের সামাজিক প্রভাব কমাচ্ছে এটি তারা বুঝলে ভালো।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র ব্যবস্থার দূর্বলতার কারনে বোরহানউদ্দিনের ধর্মীয় নেতাদের বেআইনি দাবি মেনে নিয়ে পোষ্টমর্টেম ছাড়াই নিহতদের লাশ দেয়া হয়েছে। এরমানে যে দু’জন পুলিশের হাতে মারা যায়নি তাদের মৃত্যুর আইনগত কারনটি আর জানা যাবেনা কোনদিন। আরও বিপদজ্জনক মিথ্যাচার এখনও এমন পর্যায়ে ছড়ানো হচ্ছে সেই হিন্দু যুবক নবীকে (দঃ) অপমান করেছেন। বিষয়টি ধরা পড়ার পর বানিয়ে বলা হচ্ছে তার আইডি হ্যাক হবার গল্প! বোরহাউদ্দিনের ঘটনা আবার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হলো আমাদের সাম্প্রতিক দেশটায় সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এখন শিকার যুবক ও তার পরিবারটি আর কোনদিন ওই এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেননা। নীরবে এরা হয় এলাকা ছাড়বে অথবা দেশ ছাড়বে। হয়তো সামান্যমূল্যে তাদের জমিজমা কিনে নেবে আন্দোলনকারী কোন নেতা। প্রায় সব ঘটনার এটাই নেপথ্যের অর্থনীতি। বাংলাদেশটা মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে এতোটা সাম্প্রদায়িক ছিলোনা। আমরা আমাদের দেশটাকে সব মানুষের জন্যে নিরাপদ করতে ব্যর্থ হয়েছি। ধর্মীয় মৌলবাদীরা বাংলাদেশেও সোশ্যাল মিডিয়ার আইডি হ্যাক করে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেশের একটি শান্ত এলাকাকে অশান্ত করতে শিখে গেছে!

ফজলুল বারী