ফজলুল বারী:আমি খবরের মানুষ। বিদেশে থাকলেও সারাক্ষন দেশের খবরের সঙ্গে থাকি। ইউটিউবের মাধ্যমে দেশের একাধিক নিউজ চ্যানেলের খবর লাইভ দেখি। এমনকি আমি যখন গাড়ি চালাই তখনও ফোন সেটের মাধ্যমে এমন কোন না কোন নিউজ চ্যানেলের নিউজ চলতে থাকে। কাজেই দেশের কোন খবর সহজে নজর এড়ায়না। যদি ঘুমে না থাকি। গত কয়েকদিন ধরে খালেদা জিয়ার জামিনের নিউজটি অনুসরন করছিলাম। এই জামিন আবেদন নিয়ে যা কিছু ঘটছিল দেশে তা অস্ট্রেলিয়ায় অকল্পনীয়। কারন প্রথম কথা এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে এদেশে কেউ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকেননা। অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করে চলে যান। বাংলাদেশের এমন আরও অনেক কিছু আছে যা অস্ট্রেলিয়ার সাধারন মানুষজনের ধারনারও বাইরে। আর আপিল বিভাগের এজলাসে হট্টগোল! এটা যে কোন দেশের ক্ষেত্রে অকল্পনীয়। এখন দেশে যদি সবকিছুতে সরকারি নিয়ন্ত্রন না থাকতো তাহলে এই একটা ঘটনাকে ইস্যু করে দেশে অভ্যুত্থানও ঘটতে পারতো।
বিভিন্ন লেখায় আমি একটা কথা প্রায় লিখি তাহলো, খালেদা জিয়ার এই মামলা দুটি নিয়ে শুরু থেকে তাঁর আইনজীবীরা শংকায় ছিলেন। কারন বাংলাদেশে এ ধরনের মামলাতেই সাজা হয়। অকাট্য প্রমানপত্র। এমন মামলায় একজনের কমপক্ষে তিন বছরের সাজা হলেই তাকে পরবর্তী নির্বাচনের বাইরে রাখা যায়। এরশাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। এর কারনে বিএনপির পক্ষে মামলা দুটির বিচার নানাভাবে বিলম্বিত করা হচ্ছিল। কত যে হরতাল দেয়া হয়েছে মামলার দিন দেখে। একটার পর একটা কোর্টের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানানো হয়েছে। এভাবে দেরি করতে করতে হয়তো আশা করা হচ্ছিল এরমাঝে সরকার বদল হয়ে যাবে। আগে বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তন হতো। কিন্তু এই প্রথম একটি সরকার অবিশ্বাস্য দাপটের সঙ্গে টানা ক্ষমতায়। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা হাসে তাঁর চোখমুখে। আপনি পছন্দ করেন আর না করেন। কথা বলে তাঁর বডিল্যাঙ্গুয়েজ। বাংলাদেশের চুরি-চামারি যেমন সত্য, তেমনি সত্য দেশটার নানাকিছুতে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি। কারন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব।
খালেদার যেদিন বিচারের রায় হয়, বিএনপির কতিপয় নেতাকর্মীর কবল থেকে খালেদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুলিশ বেষ্টনীর ভিতর তাঁকে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো জেলখানায় যেদিন তাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হলো, সেদিনও তাঁর আইনজীবীদের ধারনা-প্রস্তুতি ছিল দিন কয়েকের মধ্যে জামিনের মাধ্যমে বের করে নেয়া হবে বিএনপি নেত্রীকে। এ দলটায় মেজর যেমন বেশি, ব্যারিস্টারও বেশি। রাজনৈতিক পোড় খাওয়া লোকজনের চাইতে ক্রিম খাওয়ার লোকজন এ দলে বেশি যোগ দিয়েছিলেন। ক্রিম খেতে অভ্যস্ত আইনজীবীরা শুধু সরলসোজা আইনটাই দেখেছেন! এই ক্রিম খাওয়া ব্যারিস্টাররাও জামিন প্রশ্নে খালেদাকে নিশ্চয় তেমন ধারনাই দিয়েছেন। নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে আইন-আদালতের কি রকম অপব্যবহার করেছেন, এটা মাথায় রাখলে তারা ভালো করতেন।
এখনতো জামিন জামিন বলে কান্দেন! মানবিক কারনে জামিন চান! আর নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে আইন করে রেখেছিলেন যাতে শেখ হাসিনা কোনদিন তাঁর পিতার হত্যাকান্ডের বিচার করতে না পারেন! বিচার চলছিল। এর মাঝে ক্ষমতায় এসে আটকে দলেন বিচার! ক্ষমতার এতো দাপট! খালেদার একটা বক্তৃতা প্রায় কানে বাজে! শেখ হাসিনাকে উপহাস করে বলছিলেন, আপনাকে আমরা মারতে যাবো কেনো, আপনি বেঁচে থাকলেইতো আমাদের সুবিধা! কী তিরস্কার! এটা কারো জন্যে ভালো নয়।
এমন পদে পদে রাজনৈতিক পোড় খাওয়া মানুষের দল আওয়ামী লীগকে মোকাবেলার কোন প্রজ্ঞা-যোগ্যতা ঘাটতিওয়ালাদের দল বিএনপি। সে কারনে আওয়ামী বিরোধীদের সবচেয়ে বড় দল হওয়া স্বত্ত্বেও এ দলটি আজ পর্যন্ত দেশের জনগনের দল হতে পারেনি। পিঁয়াজের দামের চাইতে খালেদার বাতের ব্যথার কষ্ট নিয়ে এরা কাঁদে বেশি। যা দেশের মানুষকে স্পর্শ করতে পারেনা। কারন দেশের কমপক্ষে দেড়-দুই কোটি মানুষের এমন বাতের ব্যথার রোগী আছেন। কারাবন্দীদের মধ্যে এমন রোগী আছেন কয়েকশ। হৃদরোগে যে কারও জীবনঝুঁকি থাকে। কিন্তু বাতের ব্যথায় কোন লোক মরে যায় না। এরজন্যে শেখ হাসিনা যখন বলেন জেলখানায় খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন, তখন আমি নিজের থেকে বলি, নাগো বুবু, রাজার হালে না। রানীর হালে।
কোন বন্দী জেলখানায় কাজের লোক সহ জেল খাটতে পারে এই দৃষ্টান্তও খালেদা জিয়ার। খালেদা জিয়া চরিত্রটি বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে রানীর। জেলখানায় রানী বাতের ব্যথায় কষ্টে আছেন। প্রজামন এটি কী সইতে পারে? এখন খালেদার জামিন প্রসঙ্গে আসি। খালেদা জিয়া যেদিন জেলে যান সেদিন দেশের একটি সূত্র আমাকে তাঁর দীর্ঘ জেল জীবনের আভাস দিয়েছিল । আমাকে বলা হয়েছিল খালেদার দল শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মারতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনার দল খালেদার বেলায় তা করবেনা। পুরনো আদালত ভবনে কাটবে তাঁর বাকি জীবন। কথাগুলো তখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনি। আমি ভেবেছি বিএনপি নিশ্চয় দেশ এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করবে যাতে করে সরকার বিকল্প কিছু ভাবতে বাধ্য হবে। কিন্তু আমার ভাবনাটা ভুল ছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারির একটি নির্বাচন বিএনপিও করেছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।
এবার জামিনের আবেদন নিয়ে বিএনপি পদে পদে চালাকির আশ্রয় নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে নিজের ফাঁদে! বিএনপির জয়নুল আবেদিন আদালতে বললেন তাঁর কাছে মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট আছে। এই বোর্ড খালেদাকে বাতের ব্যথার চিকিৎসার জন্যে বিদেশ নিয়ে যেতে বলেছে। কিন্তু কোর্ট যখন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে রিপোর্ট দিতে বললো তখন আদালতে আটকে গেলেন জয়নাল আবেদিন। বাংলাদেশের আইনজীবীরা আদালতের আদেশ দ্রুত জায়গামতো পৌঁছে দিতে কাজ করেন। এরজন্যে মক্কেল থেকে আলাদা করে টাকা নেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে নিয়ে বক্তৃতার ভাষা ক্ষুরধার হলেও টাকা দেবার যে কেউ নেই তা জানলাম ডিসেম্বরের ২ তারিখে! সেদিন জানা গেলো বিচারপতিদের স্বাক্ষর সম্বলিত আদালতের আদেশ সেদিন হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছেছে! সেদিনই বুঝতে পারি এটি অতজলদি কোর্টে গিয়ে পৌঁছবেনা। কারন আমি আমার দেশকে চিনি জানি।
এরমাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতাটি এসেছে। প্রধানমন্ত্রী একটি দলেরও নেত্রী। তাঁর দল যেমন রামকৃষ্ণ মিশন না, বিএনপিও কোন সেবা সংস্থা না। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতাটি দিয়েছেন। মনে করিয়ে দিয়েছেন খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে জেল খাটছেন। আর হুইল চেয়ারও তাঁর জীবনে নতুন না। হজে গেলে তাঁর হুইল চেয়ার ঠেলতেন ফালু। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। এরপর ঘটনা ধামাচাপা দিতে সাজানো হয়েছে জজ মিয়া নাটক। এরপরও শেখ হাসিনা কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে শোক জানাতে গিয়েছিলেন। খালেদাকে জেলে নেবার পর বিএনপি যদি সে রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতো তাহলো সরকারও হয়তো বিকল্প ভাবতে বাধ্য হতো। যেমন ছাত্রদের আন্দোলনের বেলায় ঘটেছে। শুধু পিঁয়াজ না, নানাকিছুর উচ্চমূল্যে দেশের মানুষ দিশেহারা। আর বিএনপি ব্যস্ত খালেদার বাতের ব্যথায়!
এখন আদালতে বিএনপির আইনজীবীরা যা করেছেন তা বিএনপির পক্ষে যায়নি। আপিল বিভাগ যদি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে আদালতের মর্যাদা থাকেনা। এখন আপিল বিভাগ বনাম বিএনপির আইনজীবীদের অরাজকতা মামলার তর্জা চলতে থাকবে। ঝুলে যাবে খালেদার জামিনের বিষয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার আপাতত মুক্তি দরকার। এখন মুক্ত হলে তাঁর বিশেষ রাজকীয় চিকিৎসা হবেনা। তাঁর বাতের ব্যথার বাংলাদেশে যা চিকিৎসা দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে সমান চিকিৎসা। কিন্তু মুক্তি পেলে খালেদা জিয়ার মন ভালো হবে। মন ভালো হলে তাঁর ব্যথা বেদনার সমস্যাও কমে আসবে। সরকার খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তি দিতে চায়। আপিল বিভাগে গিয়ে বিএনপি মানবিক বিবাচনায় খালেদার মুক্তি চায় জামিনে। মানবিক বিবেচনায় মুক্তি পেতে চাইলে তাদেরকে যেতে হবে সরকারের কাছে। এবং তা প্যারোলে।