ফজলুল বারী: আমার প্রথম পাহাড় দেখা ছিল পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের সময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে তখন গভীর বন ছিল। আজকের মতো এত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিলোনা। বন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে হাঁটা পথ দিয়ে যেতে যেতে গা ছমছম ভয় করতো।
এমনও দিন গেছে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁটেছি কোন লোক দেখিনি। দূর থেকে কাউকে হয়তো দেখেছি, কিন্তু সে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে পথ থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে! ভয় তাড়াতে অনেক সময় চিৎকার করে গান গাইতাম! কত দূরে আর কত দূরে! অথবা আমি এক যাযাবর–!
গানের শব্দ পাহাড়ে প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছে ফিরে আসলে ভয় আরও বাড়তো! এভাবে দিনের পর দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল জুড়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় আমি দেখেছি আমার অপূর্ব সুন্দর এক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় লোকজন সন্দেহ করতো আমি সত্যি সত্যি হাঁটি কিনা!
পার্বত্য চট্টগ্রামে কেউ সন্দেহ করতোনা! কারন হাঁটাই ছিল তাদের জীবন। হাঁটাই ছিল তাদের নিয়তি। ওই সময় একদিন খাগড়াছড়ির তবলছড়িতে রাত কাটাই। পরদিন গুইমারা থেকে তাইন্দং হয়ে পানছড়ি যাবার পথে শান্তি বাহিনীর একটি দল আমাকে পথ থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়।
গভীর অরণ্যপথে আমার এভাবে হেঁটে বেড়ানো নিয়ে তারা সন্দেহ করেছিল। পর্যটক নিশ্চিত হবার পর তারা আবার চোখ বেঁধে পথে ফেরত দিয়ে যায়। পর্যটক জীবনে আমার বিপদে পড়ার তেমন গল্প অথবা ঘটনা ছিলোনা। শান্তি বাহিনীর হাত থেকে বেঁচে ফেরার পর ভাবলাম, বলার মতো একটা গল্প পেলাম!
এরপর আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে যাই লংগদু গণহত্যার পর। ১৯৮৯ সালের ৪ মে স্বৈরাচারী এরশাদ আমলে ওই গণহত্যা হয়। প্রসিত বিকাশ খীসা, রবি চাকমা সহ কয়েকজনের উদ্যোগে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একটি দল ঢাকার একদল সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে যায় লংগদু গণহত্যার স্পটে।
পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার আমরা সেখানে যাই। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ির বহরকে তখন অবশ্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অকুস্থল পর্যন্ত যেতে দেয়া হয়নি। পাহাড়িদের উৎসব বৈসাবি উপলক্ষে আবার পাহাড়ে যাওয়া হয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে।
তখন সব বেলাতেই ভয় থাকতো সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত যেতে দেবে কিনা! কারন পথে পথে সেনা চৌকিতে তল্লাশী চালানো হতো। সেনাবাহিনীর সদস্যরা কোথাও আটকে দিলে বলতাম, এই যে আমাকে আটকে দিলেন, এটাও কিন্তু আমার রিপোর্টের একটা লাইন।
হেলিকপ্টারে পার্বত্য চট্টগ্রাম গিয়ে রিপোর্ট করার সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কিছু বাছাই করা সাংবাদিক তখনও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু স্বাধীনভাবে পাহাড়ে গিয়ে রিপোর্ট করার থ্রিলই ছিল আলাদা। ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকতোনা পার্বত্য চট্টগ্রামে। তাই রিপোর্ট পাঠানো ছিল দুরুহ সংগ্রামের কাজ!
তখন আমরা হাতে লিখে ফ্যাক্সে রিপোর্ট পাঠাতাম। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হতো। অনেক সময় হাটহাজারীর বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করে রিপোর্ট পাঠানোর কথা বলে পাঁচ মিনিটের জন্যে বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়ে আনা লাগতো। আমাদের সেই সব সংগ্রাম এই প্রজন্ম জানেনা।
প্রসিত বিকাশের নেতৃত্বে একদল পাহাড়ি ছেলে বৈসাবি উংসবেও প্রথম আমাদের নিয়ে যায়। খাগড়াছড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় সৌখিন চাকমা নামের স্থানীয় এক আদিবাসী নেতার বাড়িতে। তার টিনের চালের বড় ঘর ছিল। বড় চৌকি ছিল।
এক চৌকিতে একসঙ্গে অনেকজন ঘুমানো যেত। বিজুর দ্বিতীয় দিন প্রসিত বিকাশ খীসার বাড়িতে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রসিত বিকাশ খীসার বৃদ্ধ বাবা শিক্ষাবিদ অনন্ত বিহারী খীসা তখনও বেঁচে ছিলেন। খেতে খেতে তাঁর সঙ্গে আমাদের অনেক কথা হয়। বিজু উপলক্ষে রান্না করা হয় পাহাড়ি বিশেষ খাবার পাজন।
হরেক রকম সব্জিতে রান্না করা হয় সুস্বাদু এই খাবার। সেই টেবিলের খাবারের মেন্যুতে হরিণের মাংসও ছিল। আমরা অবাক জিজ্ঞেস করি হরিনের মাংস কোথায় পেলেন। আমাদের রহস্য করে জবাব দিয়ে বলা হয় জঙ্গল থেকে আপনাদের বন্ধুরা পাঠিয়েছেন! বন্ধুরা মানে শান্তিবাহিনী!
পাহাড়ে আমাদের প্রথম বেসাবি প্রথম বিজু মানে এমন এক ধরনের রাজনৈতিক সফর। এভাবেই গল্প করতে করতে আমাদের সামনে পাহাড়ের রাজনৈতিক সমস্যা তুলে ধরতেন পাহাড়ের তৎকালীন তরুন প্রজন্ম। ছোট ছোট আদিবাসী জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম।
তারাই তখন ঢাকার সমমনা সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব-সংগঠকদের কাছে পাহাড়ের সমস্যার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করে তুলে ধরেন। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরে তারাই পাহাড়ি নেতৃবৃন্দের কাছে হয়ে গেলেন ষড়যন্ত্রকারী!
বিজু চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান আনন্দ উৎসব। বাংলা বছরের শেষ দু’দিন ও বাংলা নববর্ষের দিন মিলিয়ে মোট তিন দিনে উৎসবটি পালন করা হয়। ১২ এপ্রিল পালন করা হয় ফুলবিজু। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা ফুল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে।
সংগ্রহ করা ফুলের একভাগ দিয়ে তারা বুদ্ধকে পুজা করে। একভাগ ভাসিয়ে দেয়া হয় পানিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারনে এখন ছবি তোলার যুগ। তাই পানিতে ফুল ভাসিয়ে দেবার ছবিই হয় মূখ্য। ফুলের বাকিভাগ দিয়ে সাজানো হয় ঘরবাড়ি। বিজুর ফুল এখন পাহাড়ের বাজারে বিক্রিও হয়।
১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মূলবিজু। এদিন সকালে বুদ্ধিমূর্তিকে গোসল করিয়ে পুজা করা হয়। ছেলেমেয়েরা তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানিকে গোসল করিয়ে তাদের আশীর্বাদ নেয়। ঘরে ঘরে রান্না করা হয় উৎসবের খাবার। বিরানী, সেমাই, পাচন সহ নানান পিঠা-পায়েস।
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন একে অন্যের বাড়িতে বেড়াতে গেলে তাদের আপ্যায়ন করা হয়। বাংলা নববর্ষের দিন তথা ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় গজ্যা গজ্যা দিন, অর্থাৎ গড়িয়ে পড়ার দিন। ত্রিপুরাদের বৈসুব, বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই, চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যাদের বিজু থেকে তিন জাতি উৎসবের তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো বৈসাবি উৎসব।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অপরূপ সুন্দর এবং অশান্ত একটি অঞ্চল। পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি হয়েছে। মোবাইল ফোন গেছে। বিকাশ হয়েছে এনজিও কার্যক্রম ও পর্যটন শিল্পের। কিন্তু শান্তি চুক্তির বেশির ভাগ অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হয়নি।
হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে ছিল, চুক্তি করলাম, কিন্তু এসব দেবোটেবোনা! শান্তি চুক্তির বড় সাফল্য আমাদের দুটি সমস্যা পাহাড়ি শরণার্থী এবং শান্তি বাহিনীকে সীমান্তের ভিতর নিয়ে আসা। ১৯৬০ সালের দিকে কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প চালু হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বেশিরভাগ কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে যায়।
বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার পাহাড়ি শরণার্থী গিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। পুনর্বাসনের অভাবে তাদের অনেকে আশ্রয় নেন গভীর পাহাড়ে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন মানবেন্দ্র লারমা। তিনি বাংলাদেশের সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।
জিয়া-এরশাদ আমলে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নদী ভাঙ্গনের শিকার লোকজনকে জমি-বাড়ি-রেশনের ব্যবস্থা সহ পুনর্বাসন করা হয় পাহাড়ে। জেল খাটা অনেক লোকজনকে সেখানে একই ব্যবস্থাপনায় ঠাঁই পান। ব্রিটিশ আমল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ অঞ্চল।
সেখানে রাজা হেডম্যান-কারবারীরা আছেন। বাঙালি সেটেলমেন্টকে পাহাড়িরা দেখেন তাদেরকে নিজভূমে পরবাসী করার সামরিক শাসকদের নকশা! এর প্রতিবাদে গঠিত হয় শান্তি বাহিনী। যারা ভারতে আশ্রয় ও অস্ত্র পায়। শান্তি চুক্তির মাধ্যমে শান্তি বাহিনীকে আত্মসমর্পন-অস্ত্র সমর্পন করানো হয়েছে।
কিন্তু এসব বাহিনী কখনও তাদের অস্ত্রের পুরোটা সমর্পন হয়না। শান্তি বাহিনীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সংগঠনগুলোর চরম বিরোধিতা ছিল। কারন তারা ভেবেছিল চুক্তির পর তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
চুক্তির প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় দিনের পর দিন হরতাল করেছে। পরিস্থিতি শান্ত করতে মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ’র মতো নেতারা দিনের পর দিন পার্বত্য এলাকায় সভা-সমাবেশ করেছেন। রিপোর্টার হিসাবে আমিও তখন পার্বত্য অঞ্চলে তাদের অনুসরন করেছি।
তাদের সামনে সেনাবাহিনীর অফিসাররা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এই চুক্তি করা ঠিক হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের মতো সংগঠন এই চুক্তির সরাসরি বিরোধিতা করেছে। খালেদা জিয়া বলেছেন চুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে।
চুক্তির প্রতিবাদে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত গাড়ির বহর নিয়ে রোড মার্চ করেছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় ফিরে বিএনপি-জামায়াত অবশ্য চুক্তির গায়ে হাত দেয়নি। আন্তর্জাতিক চাপ-সম্পর্কের কারনে তা অবশ্য সম্ভবও ছিলোনা। তবে তারা চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে শ্লথগতির করে দেয়।
যা আর কোন দিন গতি পায়নি। আন্দোলন সংগ্রামে ক্ষান্তি দিয়ে এমন একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরকে আপোস উল্লেখ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সংগঠনগুলোতে বিভক্তি আসে। জনসংহতি সমিতির কর্তৃ্ত্ব থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে গঠন করা হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি তথা ইউপিডিএফ।
অথচ এই প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বেই পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একদল তরুন এক সময় ঢাকায় মিডিয়া এবং বুদ্ধিজীবী মহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রশ্নে মতামত গঠন করেছিলেন। খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে শান্তি বাহিনীর অস্ত্র সমর্পন অনুষ্ঠানে প্রতিবাদের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ।
সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমা তার বিরোধিতাকে চুক্তি বিরোধী সেনাবাহিনীর উদ্যোগ বলে ইঙ্গিত করেছিলেন। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিও এখন বিভক্ত। ইউপিডিএফও বিভক্ত। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বে খুনোখুনি লেগেই আছে পাহাড়ে।