তারেকে লক্ষ্য হাসিল হবেনা

তারেকে লক্ষ্য হাসিল হবেনা

ফজলুল বারী: গরিব হবার অনেক সমস্যা। যত উন্নত দেশ উন্নত দেশ বলে চিল্লাননা কেনো আসল সত্য হলো, অর্থনৈতিক ভাবে এবং মননে চিন্তায়ও আমাদের সিংহভাগ লোক গরিব। এরজন্যে এক কোটির বেশি মানুষ আমরা বিদেশে থাকি। কাজকর্ম করে দেশে টাকা পাঠাই।

এসবকেই আমদের বেশিরভাগ লোক জীবনের সাফল্য হিসাবে দেখি। এরজন্যে দেশে আমাদের পরিবারগুলো ভালো আছে। অনেকে মাঝে মাঝে কটাক্ষ করে বলেন, অত দেশপ্রেম থাকলে দেশে ফিরে আসুন। এরা আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে যত কটাক্ষ করুক না কেনো দেশের প্রয়োজনে আমরা দেশে ফিরতে পারবোনা।

কারন এখানে আমরা একটি ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত আইনানুগ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দেশে ফিরলে এক কোটি মানুষকে কাজ দিতে পারবেন? দেশে যে জনসংখ্যা তা নিয়ে ঢাকা সহ শহরাঞ্চলের মানুষজন এখন রাস্তায় বেরুলে আর নড়তে পারছেননা।

এখানে কাজ না থাকলে আমরা সরকার থেকে যে পরিমান ভাতা প্রতি সপ্তাহে পাই, সে অংকটি দেশের অনেকেই কল্পনায় ভাবতে পারবেননা।  এখানে আমাদের চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশুনা ফ্রি। কেউ মিথ্যা বলেনা। কোথাও ঘুষের সুযোগ নেই। কেউ তা করে থাকলে ধরা পড়লে ক্যারিয়ার শেষ।

সপ্তাহের সাতদিন কাজ করলে যে টাকা আমরা পাই  সে অংকটিও অনেকে ভাবতে পারবেননা।  দেশের জন্যে পরিবারের জন্যে আমরাই এখানে সাতদিন কাজ করার চেষ্টা করি। তখন দেশে আরও বেশি টাকা পাঠাতে ইচ্ছা করে। কারন আমরা যে দেশকে নিঃশর্ত ভালোবাসি।

যখন কাজ থাকেনা তখন মাস শেষে দেশে যারা টাকার অপেক্ষায় থাকেন, তাদের টাকাগুলোর ব্যবস্থা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হই। বিদেশে আমাদের মাথা উঁচু গৌরবটা হলো সিংহভাগ বাংলাদেশি আইনানুগ জীবনযাপন করেন।

প্রথম যারা আসেন তাদের সপ্তাহখানেক একটু সময়-সঙ্গ দিলে তারা আর সমস্যায় পড়েননা। সমস্যা হলো এখনকার বেশিরভাগ তরুন আইনানুগ নয়। ২০০৭ সালে আমি বিদেশে এসেছি। তখন দেশটা যতটা আইনানুগ ছিল, এখন পরিস্থিতির অবনতি ছাড়া উন্নতি হয়নি।

নতুন আসা প্রিয় প্রজন্ম ছেলেমেয়েদের যদি সময় দিতে পারি তখন তাদের আইনানুগ জীবন যাপনের কাউন্সিলিং করতে হয়। কত লক্ষী আমাদের এসব ছেলেমেয়েরা। মাঝে মাঝে ভাবি দুনিয়াটা কোথায় চলে গেলো! কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ তা জানলোনা দেখলোনা!

জানলোনা মানুষ হিসাবে তার অধিকার সমূহ। যাদের মাসে ২০-৩০ ডলার ভাতা দেন আর প্রচার মারান, একবারও তাদের বলেননা এসব যে কোন দয়া নয়। এসব তার সাংবিধানিক অধিকার।  গরিব হওয়ায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সমস্যা হলো, কথায় কথায় বিদেশিদের কাছে ধর্না দেয়া!

এটা আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই করে। আমেরিকায় গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সাহেব সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনকে মিনতি করে বলেছেন তারা যেনো বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ভূমিকা রাখে!  আওয়ামী লীগের পক্ষে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মত!

কি মুশকিলের কথা! ব্যক্তিগত কথা বলতে কি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে গেছেন? আজ পর্যন্ত তার এই ব্যক্তিগত মত নিয়ে কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়েছে! এটা গরিব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবার সাইকোলজিক্যাল সমস্যা।

এটা রাজনৈতিক  ভাবে আওয়ামী লীগকে ভোগাবে। কারন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হরহামেশা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পাননা। এরজন্যে এ নিয়ে তিনি ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টাও করেননি। কারন যাই বলবেন সেটি স্থানীয় দূতাবাসের রিপোর্টে আমেরিকা চলে যাবে।

বেফাঁস কিছু বললে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রিপোর্ট হবে। কাজেই দিনশেষে তিনি যে এ ব্যাপারে আর কথা বলেননি এটাই কূটনৈতিক বুদ্ধি সম্পন্ন হয়েছে। আপাতত ক্ষতিটা বাড়লোনা। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  সম্পর্কের ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বৈঠকটি হয়েছে! কি গদগদ সম্পর্করে!

আমেরিকা যে বাংলাদেশ চায়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, এটা কী কোথাও আর সরকারিভাবে বলা হয়? আমেরিকা যে বাংলাদেশ টিকবেনা বটমলেস বাস্কেট বলেছিল! গমের জাহাজ ফিরিয়ে নিয়ে ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের সৃষ্টি করেছিল, তা কি এখন আর সরকারিভাবে বলা যায়?

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্যে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগ আর আর উচ্চকন্ঠ কিছু বলতে পারে? পচাত্তর পরবর্তী সরকারগুলোকে আমেরিকা সহ তার মিত্ররা নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে! এখন যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া আমেরিকা-চীন-সৌদি আরব সহ প্রভাবশালী সব দেশ-পরাশক্তি তখন যে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল, এসব কি কেউ আর বলে? ঢাকার জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোস্টারের নাম এখন বাংলাদেশের মিডিয়ার লোকজন জানে।

কিন্তু জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে এটা সে দেশের  মিডিয়া কী জানে? না এ নিয়ে গুগলে সার্চ দিতে হয়! সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পতো বাংলাদেশ কোথায় সেটাই জানতেননা! এটাই স্বাভাবিক নয় কি? বিশ্বে এখন ১৯৫ টি দেশ।

আখিম সহ ঢাকার অনেক বিদেশি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নিত্য বৈঠক করেন, নেতারা খুশিতে এসব ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করেন! এর কারন ভদ্রতা হলে চলতো। কিন্তু কারনতো  হলো, আমাদের প্রজা সুলভ মানসিক দারিদ্র।

জার্মানিতে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কি এসব করতে পারবেন? না এপোয়েন্টমেন্ট পাবেন? এপোয়েন্টমেন্ট পেলে কী সে দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পারবেন? সোজা বাংলায় বহিষ্কার হবেন। কারন তাদের কাছে আমরা গরিব দেশ। তাদের দেশে আমরা মূলত শ্রমিকের কাজ করি।

আখিমের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর যে বক্তব্য দিয়েছেন আখিম নজিরবিহীন ভাবে মুখ খোলায়, এতে করে খসরু সাহেব এবং বিএনপির গালে কষে একটা চড় পড়েছে। হয়তো রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেছেন। কারন আমরা সবাই জানি, এসব বিষয়তো দেশে স্বচ্ছ-সহী নয়।

এসব বিএনপির আমলে ছিলোনা। এখনও নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে আখিম যেভাবে বিস্ফোরিত হয়েছেন এটাই তার কূটনৈতিক পেশাদারিত্ব। কূটনৈতিক বৈঠকের পর এ ধরনের কথা মিডিয়ার সামনে বলা যায়না। এটা আখিম বুঝেছেন। তারেকের কর্মী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বোঝেননি।

এরশাদ আমল থেকে আমি সাংবাদিকতা করি। তখন থেকে দেখে আসছি কূটনীতিকরা, এবং তাদের দেশ  শেষ দিন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে থাকেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর তাদের বোল পাল্টাতে সময় লাগেনা। এটি দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে হয়ে আসছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে আমেরিকা ও তার দালালরা অতিদ্রুত বোল পাল্টালেও  একমাত্র চীন-সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি! দেশের মানুষের হজে যেতে তখন  অনেক সমস্যা হয়েছে।

বাংলাদেশ এখন আর মুখ ফুটে এসব বলতে পারেনা। চীন এখন বাংলাদেশের বড় অর্থনৈতিক পার্টনার। সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেনা থেকে শুরু করে বড় কেনাকাটা, নির্মান করা হয় চীনের সঙ্গে। চীন-রাশিয়া-ভারতের বিরোধিতার কারনে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান হলোনা।

এরপরও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক-মানসিক সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো।  কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারত-আমেরিকা বা কাউকে পরোয়া করেনা বাংলাদেশ। কারন আমাদের দেশ এখন এমন দরকষাকষির অবস্থা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশে ব্যবসা যে দেশ যখন চাইছে সবাইকে সুযোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু চাইলেই ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি সাক্ষাৎ দেননা। এটা শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের দৃঢ়তা। একজন রাষ্ট্রদূতকে কথায় কথায় একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেতে পারেননা।

আমেরিকায় বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জো বাইডেনের সাক্ষাৎ পাবেননা। এমন দৃঢ়তা শেখ হাসিনা তাঁর কাজে ও ব্যক্তিত্বে অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের র‍্যাবের সাবেক বর্তমান কিছু কর্মকর্তার ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসবের বাস্তবতা আছে।

কিন্তু এরজন্যে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক থেমে নেই। বিএনপি চেয়ে চেয়ে দেখলো, সম্পর্কের ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জো বাইডেন শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছেন। তাদের বলার কিছু ছিলোনা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

আমন্ত্রন পেয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছে এর জন্যে এমন দৃঢ়তা থাকতে হয়। কে কিভাবে ক্ষমতায় আছে থাকছে এসব নিয়ে দিনশেষে কারোরই মাথা ব্যথা থাকেনা। এরজন্যে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক সরকার টিকে আছে।

ইরাক বা লিবিয়ার মতো অপর দেশগুলোয় অভিযান চালানো হয়না। বিএনপি দলটার জন্মও হয়েছে সামরিক ঔরসে। কাজেই সবাই দেখে ক্ষমতা। সবাই দেখে ব্যবসা। একেবারে হাওয়ার ওপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় নেই। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, আমেরিকা-ব্রিটেনও বাংলাদেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে চায়!

বাংলাদেশের এত অস্ত্রের কী দরকার? বাংলাদেশ কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? বাংলাদেশের অস্ত্র লাগে জাতিসংঘ বাহিনীতে। এসব তারা সঙ্গে নিয়ে যায়। এসব অস্ত্রের জন্যে জাতিসংঘ থেকে ভাড়ার টাকা গুনে। দরকার মনে করলে শেখ হাসিনা আমেরিকা-ব্রিটেন থেকেও অস্ত্র কিনবেন।

শেখ হাসিনার বিরোধীরা আজ পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক-রাষ্ট্র নায়কোচিত রসায়নটাই ধরতে পারেননি। রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করার সংগ্রাম করতে করতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস শুধু শীর্ণকায় হচ্ছে। বিএনপির সামনে শেখ হাসিনার বিকল্প হতে পারেন এমন কোন নেতা নেই।

খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অক্ষম। যুক্তরাজ্যের কাছে নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট সমর্পন করা তারেক রহমানের যদি প্রধানমন্ত্রী হবার গ্রহণযোগ্যতা গার্ডস থাকতো তিনি এতোদিনে দেশে এসে গ্রেফতারের ঝুঁকি নিয়ে কারাগারে গিয়ে সরকারকে ঝাকুঁনি দিতে পারতেন।

নেতা হতে বিশেষ কিছু মেধা-যোগ্যতা-ব্যক্তিত্ব লাগে। তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করে বিএনপি তাই বিদেশিদের সঙ্গে মুলোমুলি করে যেটা পেতে পারে সেটির বাংলা নাম অশ্বডিম্ব। তারেকের স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ যে করছে, কারন তারাও একটি রাজনৈতিক দল। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম বা রামকৃষ্ণ মিশন নয়।