একদিনে খসে পড়লো তিন মুখোশ

একদিনে খসে পড়লো তিন মুখোশ

ফজলুল বারী: দেশে একদিনে তিন বিশেষ লোক চিহ্নিত হয়েছে। এরা হলেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, কক্সবাজারের ইয়াবা বদি নামে খ্যাত আব্দুর রহমান বদি এবং বিজেএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। বাংলাদেশের আইন সবার জন্যে সমান না হওয়ায় তারা এখনও গ্রেফতার হননি।

সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী গাড়িতে বসে বর্বর জমিদারি শাসন যুগের মতো এক ভ্যান চালককে বেত মেরেছেন! সেই ভ্যান চালকের অপরাধ সে তার ভ্যান রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সিগারেট ডেলিভারি দিতে গিয়েছিল। ভ্যান চালকের এই অপরাধ দেখার দায়িত্ব পুলিশের, মেয়রের নয়।

পুলিশ এই অপরাধের জন্যে অন দ্য স্পট ভ্যান চালককে জরিমানা করতে পারবে। গায়ে হাত তুলতে বা বেত মারতে পারবেনা। সিলেটের মেয়রের এই অপরাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দিনের দ্বিতীয় অপরাধ করেন! দ্বিতীয় অপরাধ হলো মিথ্যা বলা।

মেয়র দাবি করেন তিনি বেত মারেননি। বেত দেখিয়েছেন! একজন মিথ্যাবাদী লোকও নৈতিকভাবে একটি শহরের মেয়রের পদে থাকতে পারেননা। মেয়রের দাবি যদি সত্যও হয়, তাহলে তার গাড়িতে বেত থাকবে কেনো? একজন মেয়র কোন একজন নাগরিককে বেত দেখাবেন কেনো এর জবাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে আদায় করতে হবে।

গত বিএনপি আমলে আরিফুল হক চৌধুরী সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার হন। ওই সময়ে মেয়র ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা বদরউদ্দিন কামরান। তখন বিএনপি সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন কামরানকে এড়িয়ে চলতে এই আরিফুল হক চৌধুরীর উত্থান ঘটান।

সাইফুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বড় সব নির্মান কর্মকান্ডে নেতৃ্ত্ব দিচ্ছিলেন কমিশনার আরিফুল হক চৌধুরী। এসব আস্কারায় তার তৎকালীন বেপরোয়া ভূমিকা নিয়ে সিলেটবাসীর অভিযোগ জানতে সরেজমিন রিপোর্ট করতে আমি তখন সিলেটে গিয়েছিলাম।

খবর পেয়ে আরিফুল হক চৌধুরী আমার হোটেলে চলে আসায় তার বক্তব্য নিতে সুবিধা হয়। আরিফুল হক চৌধুরী সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন তিনি মৌলভীবাজারের লোক হওয়ায়, মৌলভীবাজার থেকে এসে সিলেটের নেতৃত্বে জায়গা করে নিচ্ছেন দেখে তার বিরুদ্ধে এসব অপ্রচার হচ্ছে।

সেই আরিফুল হক চৌধুরী পরে আওয়ামী লীগ আমলেই বদর উদ্দিন কামরানকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই তিনি কাজ করে চলেছেন।

কিন্তু তার এমন নিজের হাতে আইন তুলে নেয়া, দূর্বৃত্তপনা আগে এভাবে জানা যায়নি। দাবিমতো তিনি যেহেতু এভাবে গাড়িতে বেত নিয়ে ঘোরেন, তাহলে তিনি নিশ্চয় প্রায় এভাবে লোকজনকে মারধর করেন! অবএব তিনি যত কর্মবীর হননা কেনো আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সব শূণ্য।

সবার আগে মানুষ এবং মানুষের সম্মান। এমন অবিশ্বাস্য মারধরের ঘটনা ভাইরাল হবার পর যদি একজন মেয়র মিথ্যা বলেন সেটা চরম অপরাধ। একজন মিথ্যাবাদী একটি নগরের শাসক, নগর পিতা বা মেয়রের দায়িত্বে থাকতে পারেন কিনা তা স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের বলতে হবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে বিষয়টির খোলাসা করতে নিতে হবে উদ্যোগ। আরিফুর রহমান চৌধুরীকে বরখাস্ত, গ্রেফতার, বিচারের সম্মুখিন করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মেয়রকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। কিন্তু অপরাধ দুটি ক্ষমার অযোগ্য। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া এবং মিথ্যা বলা।

টেকনাফের ইয়াবা বদি নামে খ্যাত সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি শনিবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভায় দলের এক নেতাকে মারধর করেছেন! টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোহাম্মদ ইউসুফ মনু দলের ভিতরের নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে বদি মঞ্চ থেকে নেমে এসে তাকে মারধর শুরু করেন!

পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মোঃ ইউসুফ ভূট্টো মনুকে রক্ষায় এগিয়ে এলে বদির ছোটভাই আব্দুল শুক্কুর ও তার অনুসারীরা ভূট্টোর ওপর চড়াও হন। শাসকদলের একটি স্থানীয় ইউনিটের সভার এসব বর্বর কর্মকান্ডের ভিডিও ভাইরাল হলে বদি বলেছেন, তিনি মারেননি, শাসন করেছেন!

টেকনাফের ঘটনায় এখনও বদিকে গ্রেফতার করা হয়নি। এই সুযোগে একটি প্রসঙ্গে আলাপ করে নেই। বাংলাদেশে প্রায় শুনবেন পুলিশ বলবে ‘যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে! বিশ্বাস করুন পুলিশের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ভুগবে।

কারন বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবার স্বপ্ন দেখছে। উন্নত দেশ হবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন রক্ষায় সক্রিয় পুলিশ। কভিড আইন লংঘন করায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে জরিমানা করেছে পুলিশ। বরিস জনসন সেই জরিমানা পরিশোধ করেছেন।

অস্ট্রেলিয়ার আইন হচ্ছে স্পিডবোটে চড়ার সময় জীবনরক্ষাকারী ভেস্ট পরা থাকতে হবে। ম্যালকম টার্নবুল প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পত্রিকায় ছবি ছাপা হয় ভেস্ট পরা ছাড়া স্পিডবোটে তিনি বসে আছেন! পত্রিকার ওই ছবি দেখে টার্নবুলকে জরিমানার নোটিস পাঠানো হয়। টার্নবুল জরিমানা পরিশোধ করেন।

করোনার ভয়াবহ অবস্থার সময় অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান উপপ্রধানমন্ত্রী বার্নাবি জয়েস একটি পেট্রোল পাম্পে তেল কিনতে ঢুকেছিলেন। তার মুখে মাস্ক ছিলোনা। তখন একজন পুলিশের ক্রাইম স্টপার দলকে ফোন করে ঘটনা জানান। পুলিশ আসার আগেই জয়েস সেখান থেকে চলে যান।

পুলিশ তখন পেট্রোল পাম্পের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে উপপ্রধানমন্ত্রীর ঠিকানায় ২শ ডলার জরিমানার নোটিশ পাঠান। জয়েস জরিমানা শোধ করেন। আর উন্নত দেশ হবার স্বপ্নদেখা বাংলাদেশের পুলিশ মুখস্ত বলতেই আছে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেবে!

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির নবম বার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার রাতে একাত্তর জার্নালে বিজেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা সিদ্দিকুর রহমানকে আমন্ত্রন করে আনা হয়। ভবন ধসের মর্মন্তুদ ওই ঘটনায় ১ হাজার ১শ ২৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিক প্রান হারান। ২ হাজার ৪শ ৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। তাদের কেউ হাত হারিয়েছেন। কেউ পা হারিয়েছেন। কারও মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। বাংলাদেশে যেহেতু শ্রম আইন কার্যত শ্রমিকবান্ধব নয়, ইন্সুরেন্স ব্যবস্থাপনা দূর্বল, প্রতিবন্ধীদের ভরনপোষনের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়না, এই মানুষগুলোর বাকি জীবন কাটবে দূঃখেকষ্টে।

ভয়াবহ সেই দূর্ঘটনার নবম বর্ষে এসে বিজেএমইএ দিনটি উপলক্ষে কোন কর্মসূচি নেয়নি। একাত্তর জার্নালের আলোচনায় এসে সিদ্দিকুর রহমান যখন বলেন বাংলাদেশের মানুষের আবেগ বেশি, চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, এসব অভিযোগ সত্য নয়, তখন অনুষ্ঠানের দর্শক অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন পৃথিবীর অনেক দেশেই নাকি এমন ঘটনা ঘটেছে! অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ফারাজানা রূপা ‘বাংলাদেশের লোকজনের আবেগ বেশি’ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইলে সিদ্দিকুর রহমান বলেন আমেরিকায় এখন মে দিবস কিভাবে পালন করা হয় আর বাংলাদেশে কিভাবে পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানেক অন্যতম আলোচক আরিফ জেবতিক বলেন যে ঘটনায় ১ হাজার ১২৭ জন মানুষ ০প্রান হারিয়েছেন সে ঘটনা নিয়ে আলোচনায় যদি বলা হয় বাংলাদেশের মানুষের আবেগ বেশি তখন বলতে হবে আমরা অমানুষ। তখন অমানুষ সিদ্দিকুর রহমান উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।

এভাবে একদিনে আরিফুর রহমান চৌধুরী, আব্দুর রহমান বদি, সিদ্দিকুর রহমানের মুখোশ আবার খসে পড়লো। রোজাকে সংযমের মাসে বলা হয়। এই তিন চরিত্র নিশ্চয় সংযম নিয়ে এ মাসে ম্যালা বক্তৃতাও দিয়েছেন। কিন্তু তিন অমানুষকে গ্রেফতার না করে সবচেয়ে সংযমের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ!

কেউ যে তাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে যায়নি”! অভিযোগ না নিয়ে গেলে তারা কিছু দেখেওনি শোনেওনি অক্ষম জড় পদার্থ! আবার বিশেষ ফোন বাজলে “জি স্যার ইয়েস স্যার ধরে ফেলবো স্যার, এই মিনিটের মামলা স্যার”, এসব কারা বলে আর কাজ করে তা সবাই জানে।