‘পাহাড়খেকোদের’ কারণেই ধস আর মৃত্যুর মিছিল

‘পাহাড়খেকোদের’ কারণেই ধস আর মৃত্যুর মিছিল

পার্বত্য এলাকায় পাহাড় ধসের জন্য দায়ী পাহাড় কাটা, বনভূমি উজাড় করা আর পাহাড়িদের মধ্যে ‘সেটেলার’দের ঢুকিয়ে দেয়া৷ প্রভাবশালীরা বছরের পর বছর এই অবৈধ কাজ করে শত শত মানুষের মুত্যু ডেকে আনছে৷ তাদের সহায়তায় রয়েছে প্রশাসন৷

টানা বর্ষণে সোমবার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫২ (রাঙ্গামাটি :১০৫ * চট্টগ্রাম : ৩৪ * বান্দরবান :৯ * খাগড়াছড়ি :২ * কক্সবাজার :২) মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এখনও মাটির নিচে অনেকে চাপা পড়ে আছেন৷ উদ্ধারকর্মীরা এখনো ধসে যাওয়া মাটির পাহাড়ের সব ধ্বংসস্তুপে পৌঁছাতে পারেননি৷

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাহাড় ধসে গত ১০ বছরে ৬ সেনা সদস্যসহ ৩ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ পাহাড় ধসের এই ঘটনা ঘটতে শুরু করে ২০০০ সালের পর ধেকে৷ পাহাড় ধসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি প্রথম ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জুন৷ টানা বর্ষণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পাহাড়তলি, বায়েজিদ বোস্তামি, খুলশী এলাকায় পাহাড় ধসে ১২৭ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হন৷ পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৮ সালে বান্দরবান শহরের বালুচরা এলাকায় পাহাড় ধসে ১৩০ জনের প্রাণহানি ঘটে৷
২০০৭ সালের পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের মুত্যুর ঘটনার পর তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাহাড় ধসের কারণ ও প্রতিকার জানতে ১১ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে৷ সেই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও কমিটির সুপারিশ কাজে লাগানো হয়নি৷ কমিটির অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি, পাহাড় ধসের কারণ প্রাকৃতিকের চেয়ে মানুষেরই সৃষ্টি বেশি৷ পাহাড় কেটে ফেলা, গাছপালা কেটে ফেলা, পাহাড় লিজ দেয়া, পাহাড়ে সেটেলারদের বসতি, পাহাড়কে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবাহার করা অন্যতম কারণ৷”

তিনি জানান, ‘‘আমরা পাহাড় ধস রোধে বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলাম৷ এরমধ্যে প্রধান সুপারিশ ছিল পাহাড় লিজ দেয়া বন্ধ করা৷ পাহাড়ের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করা৷ পাহাড় কেটে হাউজিং, শিল্পস্থাপন পাহাড়ের বড় ক্ষতি করে৷ পাহাড়ে ঘর বানিয়ে ভাড়া দেয়া আরেকটি ক্ষতি৷ আর আমরা অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধেরও সুপারিশ করেছিলাম৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের আরো বলেন, ‘‘পাহাড়ের বন উজার করা হয়েছে৷ গাছ না থাকলে পাহাড় টিকবে কী করে৷ তাই আমরা পাহাড়ে দ্রুত বনায়নের প্রস্তাব করেছিলাম৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘বন উজাড় এবং পাহাড় কাটা হচ্ছে অবৈধভাবে৷ যারা এসব করছেন, তারা প্রভাবশালী৷ তাদের সঙ্গে আছেন প্রশাসনের অসাধু কিছু লোক৷”
সামারি চাকমা পাহাড়ে বেড়ে ওঠা আদিবাসী নারী৷ তিনি এখন খাগড়াছড়িতে আইন পেশায় নিয়োজিত৷ সামারি চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড়ে এখন আর বড় কোনো গাছ নাই৷ সব ন্যাড়া পাহাড়৷ আমাদের ছোট বেলায় আলুটিলায় অনেক গাছ দেখেছি৷ কিন্তু সব উজাড় হয়ে গেছে৷ তাই পাহাড় আর তার মাটি ধরে রাখতে পারছে না৷”

তিনি বলেন, ‘‘পাহাড়ের মাটিও নিয়ে যাওয়া হয়, পাহাড়ে নানা বাণিজ্যিক কাজ হয়৷ ফলে পাহাড় তার নিজস্ব ক্ষমতা হারিয়েছে৷ আমরা কথা বলেও কোনো ফল পাইনি৷”

সাংবাদিক এবং মাউন্টেনিয়ার ( ট্র্যাকার) শাকিল হাসান এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২৯ বার পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছেন৷ পাহাড়ের ধস নিয়ে তার কাজও রয়েছে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাহাড় ধসের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে আশির দশকের শুরুতে পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক হারে অন্য এলাকা থেকে এনে বাঙালিদের বসতি স্থাপন করা৷ যেহেতু পুরো এলাকাটি পাহাড়ি, তাই সেগুলো কেটেই বসতি নির্মান করা হয়েছে৷”
তিনি মনে করেন,‘গত ১৫ বছরে  বগা লেক, থানচি, আলীকদম, সাজেক, বাঘাইছড়ির মতো দুর্গম এলাকাতেও পাকা সড়ক নির্মান করা হয়েছে৷ এই কষ্টসাধ্য কাজটি করেছে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ৷ কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, দেশের পাহাড়ের ভূমিবিন্যাস, মাটি নিয়ে দীর্ঘ গবেষনায় ঘাটতি ছিল৷ আর পার্বত্য এলাকায় পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি৷ ষাটের দশকে দেয়া বাঁধের ফলে রাঙামাটির বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে, যা ওই এলাকার ভূমি বিন্যাস, মাটির উপর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব ফেলেছে৷”

তাঁর মতে, ‘‘ব্যাপকহারে গাছ কাটার ফলে পার্বত্য এলাকা অদ্ভুত ন্যাড়া চেহারা নিয়েছে৷ তবে পাহাড়গুলো সবুজ দেখায় প্রচুর বৃষ্টির কারণে লতা গুল্ম আর ছোট প্রজাতির গাছ জন্মায় বলে৷কিন্তু এসবের শেকড় মাটির খুব গভীরে যায় না৷ বড় গাছের শেকড় যেমন গভীরে গিয়ে মাটিকে আকড়ে থাকে৷ তো বড় গাছ কেটে ফেলার কারণে মাটির শক্তি কমে যাচ্ছে৷ ভূমি ধসের এটাও বড় কারণ৷”

সবমিলিয়ে পাহাড়ে এখন পাহাড় খেকোদের দাপট৷ আর পাহাড়খেকোদের কারণেই ভূমি ধসে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন৷ ( সূত্রঃ ডয়চে ভেলে )