আমাদের গ্রাম ও সুখিয়া

আমাদের গ্রাম ও সুখিয়া

পরীক্ষা দিতে বসি নাই । প্রশ্নতেও আমাদের গ্রাম সংক্রান্ত রচনা লিখার আবদার নাই । তাহলে কেন আমাদের গ্রাম ? শনিবারের সকাল । বিছানা ছাড়ার তাড়া নেই । অফিসে যাবার চিন্তা নেই । শরীরটা ভালো ও মন্দের মাঝামাঝি । গতকাল ভীষন জ্বর ছিল, সবারই সেবা শশ্রুসায় আজ ভালোর দিকে । ফেসবুকে বুদ হয়ে আছি । সুখিয়ার মৃত্যুর খবরটা পেপারে পড়েছিলাম । খারাপ লেগেছিল । আজ অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের এক ছোটভাইয়ের পোষ্ট দেখে কেন জানি মনে পড়ছে আমাদের গ্রামখানির কথা ।
সুখিয়াদের সজাতীয় কয়েকটা পরিবার আমাদের পাশের গ্রামেই থাকতো । গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে সেই পরিবারের একজন জুতো মেরামতের কাজ করত । জুতা বলতে যেগুলোকে বোঝায় ঠি ক শু না । সেন্ডেলের ফিতা সেলাই , অক্ষয় কোম্পানির জুতা মেরামত, নাঘরার সোল্ডারিং ইত্যাদি । ইনকাম খুব হত না তাই পাশাপাশি সাইকেলের লিক ( পাংচার ) দুর করত । বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখেছি । দোকানখানা বংশ পরম্পরা দিয়ে রান করত সর্বদাই ।
হল লাইফে হলের গেটে একজনকে বসতে দেখতাম । জিজ্ঞেস করা হয়নি সুখিয়াদের সজাতীয় কিনা? কথাবার্তায় মনে হয়েছে একই গোত্রের । আমাদের ভাষায় যেটাকে কিনা সংখ্যালঘু বলা হয় । জাফর ইকবাল স্যার লিখেছেন সংখ্যালুঘ কেন ? আমারো একই প্রশ্ন ? আমাদের গ্রামের ৭০ ভাগ এখন যমুনার বুকে । ছোট্ট ছিল আমাদের গ্রামখানা । ভোটার সংখ্যা কম ছিল বিধায় পাশের গ্রামের ভোট সেন্টারে যাওয়া লাগত ভোট দিতে । হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খিস্টান সব ধর্মেরই সহঅবস্থান ছিল । বন্ধুদের বেশীরভাগই ছিল হিন্দু । গর্ব করব না, দাঙ্গা জাতীয় কোন কর্মকান্ড দেখিনী আমাদের গ্রামে । তারপরেও নিরবে ওপাড়ে পাড়ি দিতে দেখেছি বন্ধুদের অনেককেই । হতে পারে আমাদের ব্যবহার কষ্ট পেয়েছে ওরা । জানি না কেমন আছেন অভিনাশ কাকা ? তারাপদ , কান্তি কি করে এখন ? দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নিতাম আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভুলভ্রান্তিগুলোর ।
প্রায় দশ বছর পর হল গেটে দেখেছিলাম সেই বুটপলিশওয়ালাকে । আমাকে দেখে মিস্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল “স্যার কেমন আসেন ? ” । জুতার সংখ্যা দশ বছর আগের চেয়ে একটু বেশীই দেখেছিলাম । পরিবর্তন সেটুকুই । ও বৃদ্ধ হলে হয়ত ওর ছেলেই হাল ধরবে দেখানখানার । তারপরেও নিজেদের উন্নতি কিংবা শান্তি নিয়ে মিছিল মিটিং করতে দেখিনী । সুখিয়া যদি মিছিলে থাকা অবস্থায় পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে মরত তাহলেও বলা যেত ও অন্যায় করেছিল আইন রক্ষাকারীদের দৃষ্টিতে ।
ইজ্জত বাচাতে যেয়ে মরতে  হল দিন দুপুরে । আমাদের গ্রামের চৌরাস্তার মোড়খানা এখন যমুনার ঠি ক মাঝ দড়িয়ায় । বড় বড় জাহাজ চলাচল করে সেখানে । সেইসব জাহাজে সুখিয়াদের সগোত্রীয় কেউ হয়ত আমাদের নোংরা জুতোগুলো পরিষ্কার করে আমাদেরকে সাহেব বানাচ্ছে । ” লাগবে বুটপালিস ” বলে কাস্টমার খোজায় ব্যস্ত হয়ত । ওদের অপরাধ যাত্রীদের ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি মাত্র । তারপরেও সুখিয়াদের জীবন দিতে হয় চৌরাস্তার মোড়ে ! জনসম্মুখে !

( মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান )
( মোঃ মাহবুবর রহমান , তোত্তরি, জাপান )