এখনও মনে পড়ে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখার স্মৃতি

এখনও মনে পড়ে কামাল ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখার স্মৃতি

১৯৭৪/৭৫ সাল। ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর শাখার বার্ষিক সন্মেলন। স্থান রমনার বটমূল। এই সন্মেলনে কামাল ভাইয়ের উপস্থিতিতে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়।

সন্মেলনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও পরলোকগত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী (সাবেক এম পি বিএনপি) ও সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান (জাগপা প্রধান, বর্তমানে না ফেরার দেশে চলে গেছেন) সহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন: প্রতিটি কর্মীর প্রতি কামাল ভাইয়ের ছিল অসীম ভালবাসা

কামাল ভাইয়ের মনোনীত পুরো কমিটির প্রতি উপস্থিত হাজার হাজার কর্মীরা সমর্থন জানায়। সন্মেলনে সৈয়দ নুরুল ইসলাম সভাপতি, শফিকুর রহমান সাধারণ সম্পাদক, তফাজ্জল হোসেন সাংগঠনিক সম্পাদক, আব্দুর রউফ শিকদার প্রচার সম্পাদক, এম নজরুল ইসলাম সহ সাধারণ সম্পাদক(সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সহ সাধারণ সম্পাদক), ইউনুস পাঠাগার সম্পাদক, আনিসুজ্জামান খোকন সেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান ও আমাকে করা হয় সমাজ কল্যাণ সম্পাদক। এই সন্মেলনের মধ্য দিয়ে কামাল ভাইয়ের একান্ত প্রিয় ব্যক্তি হিসেবে রউফ, ইউনুস, ডাবলু ও নুরু ভাইয়ের নাম ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ কর্মীদের মাঝে সুপরিচিত হয়ে উঠে।

ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর ও কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে প্রীতি ফুটবল

কামাল ভাইয়ের খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। বিশেষ করে ফুটবল। ঢাকার আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ৭৫ প্রথম দিকে জাতীয় ছাত্রলীগ গঠনের পর এক সময় কামাল ভাই ঢাকা মহানগর জাতীয় ছাত্রলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে একটি প্রীতি ফুটবল খেলার উদ্যোগ নিলেন। খেলার স্থান ঠিক করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্ধালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠ। এখনও ভাবলে মনে হয় এই সেদিনের কথা। অথচ এর মাঝে কেটে গেছে দীর্ঘ ৪২ বছর। সেদিনের সেই প্রীতি ফুটবল খেলায় আমিও খেলেছিলাম।
খেলায় কোন পক্ষ জিতেছিল তা ঠিক মনে নেই। এখানে যাদের নাম আমার মনে আছে তারা হলেন, ডাক্তার মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, শেখ শহীদুল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কামরুল ইসলাম, ইসমত কাদির গামা, মনিরুল হক চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মিলন, মমতাজ হোসেন, চন্দন সরকার, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইউনুস, আব্দুর রউফ শিকদার, শেখ কামাল, গেন্ডারিয়ার পেটেল, কামাল মজুমদার, তেজগাঁও কলেজের রফিক, জগন্নাথ কলেজের মোজাম্মেল, ঢাকা কলেজের আজিজ বাঙাল, হাবিবুর রশিদ, শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজের আলম  তিতুমীর কলেজের কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া ও আমিসহ আরো অনেকে। খেলার শেষে আমরা একত্রে কামাল ভাইকে সাথে নিয়ে ছবিও তুলেছিলাম।

রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতি

রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতি জীবন নিয়েও কামাল ভাই ব্যস্ত  ছিলেন। ফেরদৌস ওয়াহিদের স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠীর সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সিতে Spartacus নাটকের মূল ভূমিকায় তার অভিনয় দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাইl কতোদিক দিয়ে গুণ ছিল কামাল ভাইয়ের।

আরও পড়ুন: আমরা ওই আবদার না করলে শেখ কামালও বেঁচে থাকতে পারতেন

আজকের আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ওই সময় আবাহনীর সাথে ফুটবল খেলা হলে ঢাকা স্টেডিয়ামে আবাহনীর পক্ষে সমর্থকের খুব অভাব ছিল। আমরা ঢাকা মহানগর  ছাত্রলীগ থেকে অনেকেই আবাহনী ক্লাবকে সমর্থন দেওয়ার জন্য স্টেডিয়ামে যেতাম। আর এখন সেই আবাহনী ক্লাবের কী অবস্থা? ওই সময়ে ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী ভাই ছিলেন প্রচণ্ড মোহামেডান ক্লাবের সমর্থক। এনিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক রসিকতা হতো।

পচাত্তরের ১৪ আগস্ট

এই দিন সন্ধ্যায় জগন্নাথ কলেজের ভিপি জিন্না ভাইয়ের হঠাৎ ইন্তেকালে ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত জাতীয় ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগরের কার্যালয়ের ছাদে এক শোক সভার আয়োজন করা হয়। খুব সম্ভব রাত নয়টায় কামাল ভাই এই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। আনুমানিক রাত ১০টার পরপরই কামাল ভাই তার আকাশি রঙের টয়োটা কার চালিয়ে সভাস্থান ত্যাগ করেন।
এই সময় কামাল ভাইকে আমি, নুরু ভাই, রউফসহ আরো কয়েকজন বিদায় জানাই। আমার এখনো মনে পরে কামাল ভাই তখন আমাদের বলেছিলেন রাতে বাসায় যাওয়ার সময় যেন এক চক্কর কলা ভবন হয়ে যাই। কামাল ভাইয়ের এই শেষ কথাটা এখনো আমার মনের মাঝে শক্ত হয়ে গেথে আছে। সেদিন কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি এই দেখায় হবে কামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের শেষ দেখা। আমাদের এই প্রিয় নেতা আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমাদের চিরদিনের জন্য ছেড়ে চলে যাবেন।

 পচাত্তরের ১৫ আগস্ট

১৪ আগস্ট রাতে জিন্না ভাইয়ের শোকসভা শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। একটি রিক্সা করে কাকরাইল থেকে সোবহানভাগ কলোনিতে আসতে আসতে ঘড়ির কাটাতে তখন মধ্যে রাত অতিক্রম করে ১৫ আগস্ট। কলোনির গেটের পাশের মুদির দোকানটা তখন অর্ধেক খোলা। বাসায় এসে দেরি না করে শুয়ে পড়ি। কারণ পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে আমাদের সকলকেই উপস্থিত থাকার কথা।

আরও পড়ুন: নকশাল ভেবে কামাল ভাইয়ের গাড়িতে গুলি করে পুলিশ

কিন্তু ১৫ আগস্ট সকালে কি থেকে কি হয়ে গেল। সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ও কর্মরত কয়েকজন অফিসার খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। তবে আমরা থেমে যাইনি। কামাল ভাইয়ের হাতে গড়া ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সকল প্রকার রাজনৈতিক কার্যকলাপ আন্ডারগ্রাউন্ডে চালিয়ে গিয়েছি।
তৎকালীন সামরিক সরকার জেনারেল জিয়ার চক্ষুর আড়ালে আমরা নুতন করে কামাল ভাইয়ের নগর ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছি। এর মাঝে আমাদের অনেকে পাহাড়ে সসস্ত্র যুদ্ধে চলে গেলে আমার উপর এক বিরাট দায়িত্ব এসে পরে। এমনি এক দায়িত্ব ছিল পচাত্তরের ৪ নভেম্বরের মৌন মিছিল অর্গানাইজ করা।

 

কথা থেকে কেমন করে আজ ৪২ বছর পার হয়ে গেল। আজও জাতির জনকের হত্যাকারীদের কয়েকজন খুনির শাস্তি কার্যকর হয়নি। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে? সময়, পরিস্থিতি আর পরিবেশের কারণে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়, আর ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তব।

পঁচাত্তরের পরবর্তীতে যাদের জন্ম তারা আজ পরিপূর্ণ যুবক। এই সময়গুলোতে ক্ষমতায় আসা সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিথ্যা ইতিহাস প্রচার করে বাস্তব ও সত্য ইতিহাস থেকে তরুণদের অনেক দূরে সরিয়ে রাখে। এই মহান শোক দিবসে পালন করা হয় বেগম খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিন। বাঙালি জাতির জন্য এ এক বিরাট কলঙ্ক।
বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র আমাদের প্রিয় নেতা কামাল ভাই আজ আমাদের মাঝে নেই। তবুও আমার অতীত, আমার রাজনৈতিক শিক্ষা, আমার ছাত্র রাজনীতির পদক্ষেপ চিরদিন কামাল ভাইকে স্মরণ করবে। তার সেই প্রেরণা ও উৎসাহ আমাকে এখনো রাজনীতিতে সক্রিয় রেখেছে। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।

(শেষ)

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

 

 

 

 

 

লেখক: কাউন্টি কাউন্সিলার স্টকহোম কাউন্টি কাউন্সিল, সুইডিশ লেফট পার্টি (সূত্রঃ ঢাকাটাইমস২৪ডটকম )