মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় নিউইয়র্কের ওয়ালডর্ফ টাওয়ার্সের বঙ্গবন্ধুর স্যুইটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন। পরস্পর সম্ভাষণ বিনিময়ের সময় আলোকচিত্রীরা তাঁদের ছবি তোলেন। পরে তাঁরা একান্ত আলোচনায় মিলিত হন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে ছিলেন নিকটপ্রাচ্যবিষয়ক (এনইএ) সহকারী সচিব আলফ্রেড এল এথার্টন জুনিয়র, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের (এনএসসি) রবার্ট ওকলি। আর পুরো আলোচনাটি লিপিবদ্ধ করেন এনইএর পিটার ডি কনস্টেবল। লেখাটি অনুবাদ করেছেন জামিল বিন সিদ্দিক।
হেনরি কিসিঞ্জার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আপনাকে স্বাগত জানাতে পেরে এবং আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ভীষণ প্রীত। আগামী মাসে ঢাকায় আমার সফরের বিষয়েও আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
শেখ মুজিবুর রহমান: আমিও আপনার সফরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। মিসেস ফোর্ডের দুর্ভাগ্যজনক অসুস্থতায় আমার সমবেদনা গ্রহণ করুন।
কিসিঞ্জার: আপনাকে এখানে দেখতে পেয়ে দারুণ আনন্দ লাগছে। ১৯৭০-এ জাতিসংঘে যোগ দিতে ইয়াহিয়া খান যখন এখানে আসেন, তিনি আমাকে বোঝান, পাকিস্তানে নির্বাচনকে কেন তাঁর পক্ষে কাজে লাগানো যাবে। তিনি জানান, পূর্ব পাকিস্তানে ২০টি দল আছে। কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে না। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দারুণ একটা সুযোগ পাবেন ইয়াহিয়া। এরপর তো পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতে আপনি নাটকীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন। এরপর থেকে রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীতে আমি আর বিশ্বাস করি না, যদি না সেটা আপনি নিজে করেন।
শেখ মুজিব: নির্বাচনের আগে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ৯০ শতাংশ ভোট পাব কি না। বলেছিলাম, ৯৭ শতাংশ পাব। আমি এত নির্বাচন করেছি যে অবশ্যই আমি ইয়াহিয়ার চেয়ে ভালো জানি। তাঁর আইডিয়া, কর্মকৌশল আমি ভালোই বুঝি…
কিসিঞ্জার : [ফলাফল] কী হবে তা যদি সে জানত, তাহলে কোনো নির্বাচনই হতো না। চীন যাওয়ার পথে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা, আমার জন্য যে সফরটার ব্যবস্থা সে করে দিয়েছিল। আমার সম্মানে সে একটা ডিনার দিয়েছিল, টেবিলে সে আমাকে বলল, ‘লোকে আমাকে একনায়ক বলে।’ তারপর সবাইকে উদ্দেশ করে সে বলল, ‘আমি কি একনায়ক?’ সবাই বলল, ‘না।’ তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলে বললাম, ‘আমি ঠিক জানি না। তবে একজন একনায়ক হিসেবে খুবই বাজে একটা নির্বাচন করেছেন আপনি।’
শেখ মুজিব: কিছু কি পান করতে চান?
কিসিঞ্জার : একটু চা খাব।
শেখ মুজিব : সানন্দে। আমরাও চা উৎপাদন করি।
[চা-কফি দেওয়া হলো।]
কিসিঞ্জার: আপনি জানেন যে বাংলাদেশের ভালোর জন্য আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ না করে আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে আপনাদের সাহায্যে যা যা করণীয়, সব আমরা করব। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে আমরা বিশ্বাস করি, আপনার দেশের স্থিতিশীলতার জন্য আপনিই সর্বোত্তম গ্যারান্টি। আপনাকে সাহায্য যা যা আমরা করতে পারি, সবই আমরা করতে চাই।
শেখ মুজিব: ধন্যবাদ। সে আপনার বদান্যতা। জেল থেকে বেরিয়ে বড় বড় সব সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। তারপর তো আপনারা বিপুল সাহায্য দিলেন, দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেল।
কিসিঞ্জার: যা পারি করব। এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশকে দেড় লাখ টন খাদ্যশস্য দেওয়ার অঙ্গীকার আমরা করেছি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হতে হতে এই প্রান্তিকেই আরও এক লাখের অনুমোদন জোগাড়েরও চেষ্টা করছি। জানি, এতেও আপনাদের পুরো চাহিদা পূরণ হবে না। তবে আমাদের গমের ফলনও হতাশাব্যঞ্জক আর এটা আমাদের গম সরবরাহকে একটা চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে।
শেখ মুজিব: আমাদের সমস্যা হচ্ছে সামলে ওঠা আর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা। কিছুটা অগ্রগতি আমাদের হয়েছে। আমাদের চালের ঘাটতি ৩০ লাখ টন থেকে ২০ লাখে নামিয়ে এনেছি। জেল থেকে যখন বেরোই, আমাদের কোনো সরকার ছিল না। কিছুই ছিল না।
কিসিঞ্জার: সবকিছু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসত।
শেখ মুজিব: লড়াই শেষে আমাদের কিছুই ছিল না; না অর্থ, না কোনো সম্পদ।
কিসিঞ্জার: আপনি ফিরলেন কবে? ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ। যখন ফিরলাম, সবাই সশস্ত্র। সেটা নিয়েও আমাদের সমস্যা হয়েছিল। এখন আমাদের একটা সরকার আছে। জেল থেকে বেরিয়ে আমি ‘ক্ষমা কর আর ভুলে যাও’ নীতি অনুসরণ করেছি।
কিসিঞ্জার: ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিটা আপনি বের করেছেন, সেটাকে আমরা খুবই কদর করি। আপনি খুবই রাষ্ট্রনায়কোচিত [আচরণ করেছেন]।
শেখ মুজিব: বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সংঘটিত গণহত্যার কারণে এটা কিছু মাত্রায় আমার অজনপ্রিয়তার কারণ হয়েছে। আমি আপনাকে নাম বলতে পারি, যাঁদের আপনি চিনবেন।
কিসিঞ্জার: বাঙালিরা তো বিদ্রোহী। আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন হার্ভার্ডে আমার ছাত্র, তখন তো বেশ কিছু বাঙালি সেখানে ছিল।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, জনাব মুর্শেদসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি ছিল।
কিসিঞ্জার: তিনি ঠিক আছেন তো?
কামাল হোসেন: হ্যাঁ।
শেখ মুজিব: পাকিস্তানি জেনারেল ফরমান আলী খান একটা চিরকুটে লিখেছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ মাটিকে লালে রঞ্জিত করে তুলতে হবে।’ ওটা আমরা পেয়েছি। ভুট্টো ঢাকায় এলে তাকে এ বিষয়ে বলেছি। তাকে ওটা দেখিয়েছি। তাকে বলেছি, ‘তোমার দিক থেকে একটা কিছু করো।’ বাংলাদেশে ৬৭ হাজার অবাঙালি পরিবার আছে, যারা পাকিস্তানকে বেছে নিয়েছে। কিন্তু ওরা তাদের ফেরত চায় না। আমরাও তাদের চাই না। তারা ক্যাম্পে আছে। আমরা তাদের খাওয়াতে পারব না। আমাদের কোনো সম্পদ নেই। আমার কর্তব্য আমি করেছি। আমি গণহত্যার শিকার। পাকিস্তানিরা কেন উদারতা দেখাতে পারে না?
কিসিঞ্জার: আমরা পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের জোর পক্ষপাতি। এ অঞ্চলে আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে, যেকোনো প্রভাব খাটিয়ে হলেও স্বাভাবিককরণ উৎসাহিত করা। আমার তো ধারণা, এটা আসলে পাকিস্তানের ঘরোয়া রাজনীতির বিষয়। সুনির্দিষ্ট করে এমন কিছু কি চান যেটা আমি করি?
শেখ মুজিব: আমি দায় নিয়েছি, তাহলে সম্পদ কেন পাব না? না সোনা, না বিমান, না জাহাজ—কিছুই আমরা পাইনি। আমার সাড়ে সাত কোটি লোক। যুদ্ধবন্দীদের আমি পাকিস্তানে ফেরত দিয়েছি। দর-কষাকষির জন্য চার হাজার বন্দীকে আমি আটকে রাখতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করতে চাইনি। দক্ষিণ এশিয়ায় আমি সুসম্পর্ক চাই। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ।
কিসিঞ্জার: সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাংলাদেশ কোনো ছোট দেশ নয়।
শেখ মুজিব: ভূখণ্ডের হিসাবে আমরা ছোট। স্বাধীনতার প্রথম দুই কি তিন মাসেই আমরা সড়ক ও সেতু পুনর্নির্মাণ করেছি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমরা খুলে দিয়েছি, আমরা একটা সংবিধান অনুমোদন দিয়েছি। দুই বছর আমাদের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা পাকিস্তানে আটকা ছিল। বাংলাদেশে আমার সম্পদ আছে—উর্বর জমি, পর্যাপ্ত মানুষ, গ্যাস, কয়লা, গবাদিপশু। আশা করছি, আমরা তেলও পাব।
কিসিঞ্জার: বাংলাদেশে কয়লা আছে? আপনারা তেল পেয়েছেন?
শেখ মুজিব: তেল অনুসন্ধানের জন্য মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি। চুক্তি বাবদ আমরা বোনাস অর্থও পেয়েছি।
কিসিঞ্জার: তেল পেলে আপনাদের কাছ থেকে হয়তো আমরা ধার নেব।
শেখ মুজিব: আপনাদের ধার করতে হবে না। আপনারা আমাদের জন্য যা করেছেন, সব আমরা শোধ করে দেব। বাংলাদেশে আমাদের দরকার একটা মার্শাল প্ল্যান। খনিজ আর সার কারখানায় আমাদের দরকার বিদেশি বিনিয়োগ। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস আছে, আমরা সেটা বিক্রি করতে পারি। বন্যা নিয়ন্ত্রণ একটা গুরুতর সমস্যা। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ জরিপে একটা মিশন হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে নদী পরিষ্কারের জন্য তাদের ড্রেজ ছিল, যাতে করে কলকাতায় মালামাল নিয়ে যাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর থেকে আর ড্রেজিং হয়নি। পাকিস্তান সরকার জরিপ প্রতিবেদনটি ধামাচাপা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু অববাহিকা প্রকল্প চালু করে। বাংলাদেশে তারা কিছুই করেনি, এখন আমরা তার পরিণাম ভোগ করছি। বানের হাত থেকে আমাদের গবাদিপশু, খাদ্যশস্য, হাঁস-মুরগি, শাকসবজি রক্ষার কোনো উপায়ই আমাদের নেই। আমরা নিজেরা মিলে একটা সমাধান বের করতে পারি। জার্মানির পুনরুদ্ধারে আপনি মার্শাল প্ল্যান সংগঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশের জন্য এখন আপনি কিসিঞ্জার প্লান শুরু করতে পারেন।
কিসিঞ্জার: কোনো প্লানে আমার নামটা জুড়তে পারলে তার জন্য আমি যেকোনো কিছু করতে রাজি।
শেখ মুজিব: ভিয়েতনাম আর মধ্যপ্রাচ্যে আপনি কত সফল। বাংলাদেশেও আপনি সফল হতে পারেন। আমার দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা।
কিসিঞ্জার: মার্শাল প্ল্যানের সময় যেমন ছিল, এই দেশের ঘরোয়া অবস্থা এখন তার চেয়ে অনেক কম অনুকূল। সত্যি বলতে কী, ঘরোয়া অবস্থা এখন প্রতিকূল। খোলাখুলি বলতে গেলে আমাকে বলতেই হবে, সে রকমের কোনো কর্মসূচি আর সম্ভব নয়। তবে আমরা বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামে যোগ দিচ্ছি। আপনার দেশের সম্ভাব্য দ্রুততম উন্নয়নের পক্ষে আমরা। একাত্তরে ভারতের সঙ্গে আমাদের বিরোধটা ছিল আমাদের চীন-নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থন আমরা দিয়েছি। যতটা পারি তার সর্বোচ্চটা করব। তবে অতিরিক্ত প্রত্যাশা করাটা ঠিক হবে না। কনসোর্টিয়ামে আমরা চূড়ান্ত সক্রিয় থাকব। আপনাদের সমস্যাদি বিশেষ মনোযোগ পাবে। আমি যে ঢাকায় যাচ্ছি, তার মানেই হচ্ছে, আমি এগুলোকে বিশেষ মনোযোগ দেব।
হোসেন: আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কিছুটা সময় দরকার…
কিসিঞ্জার: আমলাতন্ত্রের অভিশাপই হচ্ছে, যতটুকু করলে সংকটটা এড়ানো যায়, তারা ঠিক ততটাই করে কিন্তু সমস্যাটা একেবারেই চুকে যায় অতটা তারা করে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি বড় পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষপাতি। আপনাদের সমস্যাগুলোকে আবার আমাদের দেখতে হবে। মি ম্যাকনামারার সঙ্গে দেখা করে দেখি কী করা যায়। আপনি কী তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, ওয়াশিংটনে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে সদয় [সম্মত হয়েছেন]।
হোসেন: দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের তিন-চার বছর সময় দরকার।
কিসিঞ্জার: আপনারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবেন?
হোসেন: হ্যাঁ, তিন-চার বছরে।
কিসিঞ্জার: এই চলতি প্রান্তিকেই আরও এক লাখ টনের খোঁজে আছি আমরা।
আলফ্রেড এল এথার্টন: এর বাইরেও বাকি বছরজুড়েই বাড়তি খাদ্যশস্য কী দেওয়া যায়, তা-ও আমরা বিবেচনা করে দেখব।
হোসেন: আমাদের দরকার উদ্ভিজ্জ তেল, সার আর আমাদের সব সম্পদের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প-সাহায্য, যাতে করে রপ্তানি বৃদ্ধি করে বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। আমাদের কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নেই। ৪০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও এখনো উপনির্বাচনগুলোতে আমরাই জিতছি।
কিসিঞ্জার: প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের সময় কীভাবে এটা আপনারা করলেন, ১৫ মিনিট এ বিষয়ে তাঁকে পরামর্শ দেবেন।
শেখ মুজিব: বাংলাদেশে আমি ৪ হাজার ৩০০ ইউনিয়ন পরিষদ স্থাপন করেছি। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে খয়রাতি লঙ্গরখানার ব্যবস্থা করেছি।
কিসিঞ্জার: আপনি কী অনেক ঘোরাঘুরি করেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য লোকজনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করি, যাতে করে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
কিসিঞ্জার: ভারতের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কেমন?
শেখ মুজিব: খুব ভালো। আমাদের বিদেশনীতি নিরপেক্ষ, নির্জোট ও স্বাধীন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বার্মার সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক। চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্যও আমরা খুব ব্যগ্র।
কিসিঞ্জার: ভারতের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক উন্নত করছি।
শেখ মুজিব: আমরা সেটাকে স্বাগত জানাই। ভারতের সঙ্গে আমাদের একটি মৈত্রী চুক্তি রয়েছে আর আছে একটি নদীশাসন কমিশন। আমাদের সুসম্পর্কের বিষয়টি আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে চাই। জেল থেকে বেরোনোর সময় বাংলাদেশে মার্কিনবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান ছিল। এখন আমার সব লোকই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পরম বন্ধুভাবাপন্ন।
কিসিঞ্জার: জেল থেকে বেরিয়ে দারুণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন আপনি। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলা এবং তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করার প্রবল প্রলোভন নিশ্চয়ই ছিল। বাঙালিদের প্রতি বরাবরই আমরা ভীষণ সহানুভূতিশীল। আমাদের দিক থেকে এটা একটা সহজাত বন্ধুতা।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ। আপনাদের দীর্ঘমেয়াদি আগ্রহকে ভীষণ কদর করা হয়।
কিসিঞ্জার: মার্কিনদের হৃদয়ে আপনার জন্য একটা বিশেষ জায়গা আছে। উদাহরণস্বরূপ খাদ্যের কথাই ধরুন না, আমরা বিশেষভাবে চেষ্টা করছি।
শেখ মুজিব: যে বিপুল খাদ্যসাহায্য আপনারা জুগিয়েছেন আর আজ যা করছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
কিসিঞ্জার: আপনি যুক্তরাজ্যে গেলেন, তারপর বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গেই কি সরকারের দায়িত্ব নিলেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ। সেটা ছিল খুবই দুরূহ। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। সেটা একটি গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করল। তাদের অস্ত্র সমর্পণের জন্য প্রত্যেকের কাছে আবেদন করি। আমার কাছে দেড় লাখ অস্ত্র সমর্পণ করা হয়। পাকিস্তানিরা প্রত্যেককে সশস্ত্র করে। বেসামরিক লোকদের সশস্ত্র করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অনুমতি চেয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শেষ দিকে বেসামরিক লোকদের যে সশস্ত্র করতে অনুমতি চেয়েছিল, তার দলিলাদি আমাদের কাছে আছে।
কিসিঞ্জার: চীনাদের ব্যাপারটা কী? তারা আপনার দেশে নাশকতামূলক কিছু কি করছে? এত দিনে আপনাদের সম্পর্ক হয়েছে কি?
শেখ মুজিব: এখনো হয়নি। আমরা পরস্পরকে জানি। ১৯৫৮-তে আমি পিকিং যাই, ১৯৬২-তে তারা ঢাকা আসে। আমি চীনের সঙ্গে বন্ধুতা চাই। তবে আমাদেরও আত্মমর্যাদা আছে। আমি বন্ধুতার প্রস্তাব করতে পারি, তবে তাদের দিক থেকেও তো উদ্যোগী হতে হবে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আমরা মূল্য দিই। সেখানে প্রথম দিন থেকেই আপনারা আমাদের নিয়মিত সমর্থন দিয়ে আসছেন।
কিসিঞ্জার: আমার ধারণা, আগামী বছর থেকেই চীনারা আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা শুরু করবে। ভারতকে নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের কোনো [মনোভাব] নেই। তারা আস্তে ধীরে এগোবে। আপনাদেরটাই ঠিক নীতি: সব বড় শক্তির সঙ্গে বন্ধুতা কিন্তু তাদের সব ধরনের ঝগড়াঝাঁটি এড়িয়ে চলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আপনাদের সুসম্পর্ক বিষয়ে অবশ্যই আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
শেখ মুজিব: ধন্যবাদ। গত দুই বছরে আপনি চমৎকার সব কাজ করেছেন।
কিসিঞ্জার: প্রতিষ্ঠিত কোনো দেশের হয়ে সম্পর্ক করা তো সহজ, আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তো নতুন দেশের হয়ে সম্পর্ক করতে হবে, একেবারে শূন্য থেকে। সেটা তো অনেক অনেক দুরূহ। আপনারা কি একসঙ্গেই ছাড়া পেয়েছেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আমাকে ছাড়ার পর আমি তাদের বললাম, আমার বন্ধুকে তারা কেন ভুলে গেলেন? তাকেও ছেড়ে দিতে বললাম, কারণ সে তো আমার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা।
কিসিঞ্জার: আপনার সঙ্গে কী খারাপ আচরণ করা হয়েছিল?
শেখ মুজিব: তারা আমাকে নিঃসঙ্গ কারাবাসে রেখেছে। পরিবেশ ছিল খারাপ। [তাপমাত্রা] ছিল ১১৭ ডিগ্রি।
হোসেন: আমি অবশ্য অপেক্ষাকৃত ঠান্ডায় ছিলাম, আমি ছিলাম উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশে।
শেখ মুজিব: আমার বিরুদ্ধে যে মামলাটা তারা সাজিয়েছিল, সেটা ছিল একটি প্রহসন।
কিসিঞ্জার: আমরা প্রবল চাপ দিই।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, আপনারা যে দিয়েছিলেন, আমি জানি। তারা আমাকে হত্যার চেষ্টা করে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে বের করে নিয়ে পাঁচ দিন চশমা বাঁধের কাছে লুকিয়ে রাখে। কয়েদিদের একটা বিদ্রোহ হয়েছিল আর কয়েদিরা আমাকে হত্যা করেছে, এই বলবে বলে ঠিক করেছিল তারা। তিনবার আমাকে মারার চেষ্টা করেছে তারা: ১৯৫৮ সালে যখন সামরিক শাসন জারি হলো, তারা আমাকে গ্রেপ্তার করল; ১৯৬৬ সালে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তারা আমাকে গ্রেপ্তার করল, ১৯৭১ সালে তারা আমাকে গ্রেপ্তার করে হত্যার চেষ্টা করল। আমি আসলে বাড়তি আয়ুতে বেঁচে আছি।
কিসিঞ্জার: বাঁচার জন্য আপনার আরও ছয়টা জান আছে। লোকে বলে না, বিড়ালের নয়টা জান। কিন্তু আপনার অর্জন তো বিশাল। নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন আপনি। আগামীকাল আপনার আলোচনায় দেখবেন, প্রেসিডেন্ট ভীষণ দরদি। আমাদের খাদ্যঘাটতি এবং সাহায্য বিষয়ে কংগ্রেসের বেঁধে দেওয়া চৌহদ্দির কারণে আমাদেরও কিছু নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা বিশেষভাবে চেষ্টা করব। এই মাসের শেষে বাংলাদেশে আবার আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় রইলাম।
শেখ মুজিব: এই যে লোকগুলো, এই যারা বাংলাদেশে থাকতে চায় না—এদের নিয়ে আমি বিশেষ সমস্যায় আছি। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ইদি আমিনের মতো আমারও কী তাদের বহিষ্কার করা উচিত?
কিসিঞ্জার: আপনি বিহারিদের কথা বলছেন?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ।
কিসিঞ্জার: পাকিস্তানিরা তাদের নেবে না? সেখানে যখন যাব, এই প্রশ্নগুলো আমরা তুলব। আরও বিস্তারিত করে এটা আমাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন।
শেখ মুজিব: দরাদরি করার মতো কিছুই আর আমার হাতে নেই। আমি ঝুঁকি নিয়েছি। আত্মসমর্পণের ঠিক আগে আগে তারা অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক হত্যা করেছে। আমার লোকদের এসব ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। কখনো কথার বরখেলাপ করি না, কিন্তু এবার করেছি। বলেছিলাম, বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিচার হবে। কোনো বিচার হয়নি।
কিসিঞ্জার: বিচার না করাটা খুবই মানবিক ও রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ হয়েছে। ফলে এখন আপনি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনে কাজ করতে পারছেন। আমি বিষয়টি তুলব।
মার্কিন সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের জবাবেও পরে একই ধরনের মন্তব্য করেন দুই অংশগ্রহণকারী। দক্ষিণ এশিয়া সফরের তারিখ ঠিক হয়েছে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব এই সপ্তাহেরই কোনো একসময় জানা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাটব্যাগ বিক্রি এবং পিএল ৪৮০ চুক্তি স্বাক্ষর—এই দুয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে ওই দিন সকালের ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটা খবর বিষয়ে করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে গেলেও পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বিষয়টি তাঁদের আলোচনায় আসেনি। ‘আমার আরেক ছাত্র’ বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব। ( প্রথম আলো )