চিরকালের জন্য স্তব্ধ হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বারের দরাজ কণ্ঠ।

চিরকালের জন্য স্তব্ধ হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বারের দরাজ কণ্ঠ।

চিরকালের জন্য স্তব্ধ হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল জব্বারের দরাজ কণ্ঠ। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বুধবার (৩০ আগস্ট) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গুণী এই শিল্পী (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
১৯৩৮ সালে ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় জন্মেছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৫৮ সাল থেকে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে গান গাইতে শুরু করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্রে প্রথম গান গাওয়ার সুযোগ আসে তার কাছে। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হান পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সংগম’-এর গানে কণ্ঠ দেন। একই বছর থেকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনে নিয়মিত গাইতেন তিনি।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন আবদুল জব্বার। হারমোনিয়াম কাঁধে কলকাতায় বাংলাদেশি শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন মানুষকে। তাঁর গানে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন অনেকেই। এছাড়া প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবদুল জব্বার গেয়েছেন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অংসখ্য গান। পথে পথে গণসংগীত গেয়ে পাওয়া ১২ লাখ টাকা তিনি দান করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হৃৎপিন্ড, প্রস্টেটসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগেছেন আবদুল জব্বার। এ কারণে গত ৩১ মে থেকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। গঠন করা হয়েছিল চিকিৎসা সহায়তা কমিটি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে সবার চেষ্টা।

সংগীত জীবনে ছয় হাজারেরও বেশি গান গেয়েছেন আবদুল জব্বার। এর মধ্যে কালজয়ী হয়ে আছে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’, ‘পীচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘বন্ধু তুমি শত্রু তুমি’ প্রভৃতি। বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পদকসহ (১৯৯৬) অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

ব্যক্তিজীবনে তিনবার বিয়ে করেন আবদুল জব্বার। তার প্রথম স্ত্রী হালিমা জব্বার একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দুই ছেলে মিথুন জব্বার ও বাবু জব্বার এবং মেয়ে মুনমুন জব্বার। দ্বিতীয় স্ত্রী শাহীন জব্বার ছিলেন গীতিকার। তার তৃতীয় স্ত্রী ডলি জব্বার বাংলাদেশ বেতারের একজন কর্মকর্তা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে আবদুল জব্বারের অবদান ভোলার নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গণে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছে যেসব গান, সেগুলোর মধ্যে তার ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ অন্যতম।

ষাটের দশক থেকে দেশাত্মবোধক, প্রেম ও বিরহের গানে সংগীত পিপাসুদের মন ভিজিয়েছেন আবদুল জব্বার। জীবদ্দশায় দরাজ কণ্ঠের এই শিল্পী গেয়েছেন ছয় হাজারেরও বেশি গান। এর মধ্যে সবশ্রেণির সবচেয়ে প্রিয় ‘ওরে নীল দরিয়া’। সত্তর দশকের কালজয়ী এই গান আজও সমান আকুল করে তোলে শ্রোতাকে। এর সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছিলেন প্রখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব আলম খান। বুধবার (৩০ আগস্ট) সকালে আবদুল জব্বারের চিরবিদায়ের খবর শুনে তার বাসায় ছুটে যান তিনি। বিকালে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আলম খান তুলে ধরলেন ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি তৈরির গল্প। চলুন পড়ি তার বয়ানে…

“১৯৭৮ সালের কথা। আবদুল জব্বার তখন সংগীত চর্চা করে না। গান-বাজনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’ ছবির ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটা তাকে দিয়েই গাওয়াবো ঠিক করি। কারণ জব্বারকে মাথায় রেখেই গানটা সুর করেছিলাম। আমার চোখের সামনে ভাসছিল— ও গাইছে! তাই অনেক বলেকয়ে একরকম জোর করে তাকে গাইতে রাজি করালাম। মানুষ হিসেবে আবদুল জব্বার কিছুটা উদাস আর একরোখা ছিল।

‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের অস্থায়ী সুর অবশ্য কোনও ছবির কথা ভেবে করিনি। ১৯৬৯ সালে একদিন সুরটা মাথায় আসে। কিন্তু এটা কয়েক বছর কোনও ছবিতে কাজে লাগাইনি। আবদুল্লাহ আল মামুন ‘সারেং বউ’ ছবির গল্প শুনে ভাবলাম এই সুরে এবার গান বানাবো। গল্পটা এমন— গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছে সারেং। তার স্ত্রী তা স্বপ্নে দেখছে।
সুরটা শোনালাম গীতিকার মুকুল চৌধুরীকে। তিনি সুরের ওপর ‘ওরে নীল দরিয়া’র পুরো মুখরা লিখে দেন। এর দুই দিন পর গল্প অনুযায়ী অন্তরাসহ লিখে নিয়ে এলেন। তাঁর কথার ওপরই সুর করি।

পরিচালক জানালেন— গানের প্রথম অন্তরায় রেলগাড়িতে, দ্বিতীয় অন্তরায় সাম্পানে চড়ে এবং সবশেষে মেঠোপথ ধরে সারেং বাড়ি ফিরবে। তাই ট্রেনের ইফেক্ট, সাম্পান, বৈঠা, পানির ছপছপ শব্দ এবং একতারার ইফেক্ট তৈরি করলাম।

পানির ছপছপ শব্দ তৈরির জন্য গামলা ভরে পানি নিয়ে এলে আবদুল জব্বার বললো, ‘এটা দিয়ে কী করবা?’ তাঁকে বললাম— দেখো কি করি। সে তো অবাক! কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গানটির রেকর্ডিং হয়েছিল।

মুক্তির পর ‘ওরে নীল দরিয়া’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর আমার সুরে আরও কয়েকটি গান গেয়েছে আবদুল জব্বার। সবশেষ সে গেয়েছিল ১৯৮০ সালে ‘সখী তুমি কার’ ছবির ‘তুমি আছো সবই আছে’। ওর গায়কীর তুলনা হয় না।

আবদুল জব্বার চলে গেছে, খুব খারাপ লাগছে। ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের গীতিকার মুকুল চৌধুরী এবং ‘সারেং বৌ’ ছবির পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনও নেই, আমাকেও একদিন নিয়তির কাছে চলে যেতে হবে। তারা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। শান্তিতে থাকুক।”

* দেখুন ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের ভিডিও:

‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের কথা
শিল্পী: আবদুল জব্বার
গীতিকার: মুকুল চৌধুরী
সুর: আলম খান
ছবি: সারেং বউ (১৯৭৮)

ওরে নীল দরিয়া
আমায় দেরে দে ছাড়িয়া
বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া।

কাছের মানুষ দূরে থুইয়া
মরি আমি ধড়-ফড়াইয়ারে।
দারুণ জ্বালা দিবানিশি
অন্তরে অন্তরে
আমার এত সাধের মন বধূয়া হায়রে
কি জানি কি করে।

ওরে সাম্পানের নাইয়া
আমায় দেরে দে ভিড়াইয়া
বন্দি হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে
কান্দে রইয়া রইয়া
ওরে সাম্পানের নাইয়া।

হইয়া আমি দেশান্তরী
দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরীরে
নোঙর ফেলি ঘাটে ঘাটে
বন্দরে বন্দরে
আমার মনের নোঙর পইড়া আছে হায়রে
সারেং বাড়ির ঘরে।

এই না পথ ধইরা
আমি কত যে গেছি চইলা
একলা ঘরে মন বধূয়া আমার
রইছে পন্থ চাইয়া।