ফজলুল বারী:পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশ। কবে সেতুর কোন প্রান্তে বাতি জ্বললো, কোথায় কোথায় লেজার শো’র উৎসব হবে এ নিয়ে নানান রিপোর্ট হচ্ছিল। কিন্তু জাতির এই গৌরব অর্জন নিয়েও আমরা একমত একজোট হতে পারিনি! আমাদের স্বপ্ন-প্রাপ্তিগুলোকেও আমরা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছি।
পদ্মা সেতু যারা আটকে দিতে চেয়েছে, জোড়াতালি দিয়ে বানানো(!) পদ্মা সেতুতে উঠতে যারা নিষেধ করেছে তাদেরকে প্রধানমন্ত্রী টুস করে ফেলে দেবার কথা বলেছেন। আর বিএনপি এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে এটিকে বলেছে খালেদা জিয়াকে হত্যার চেষ্টা!
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। বিএনপির উদ্যোগেও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কখনো খালেদা জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এমনটিও শোনা যায়নি। উপরন্তু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারীরা বিএনপি ও খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ।
কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুখে মৃত্যুর আশংকা করছিল তাঁর দল! সুপ্রিমকোর্টে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানির তারিখ দিলে ‘এর আগে যদি ম্যাডামের কিছু হয়ে যায়’ বলে আপীল বিভাগের দরজায় লাথির প্রতিযোগিতা হয়।
‘বিএনপির চেয়ারপার্সন লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত, তাঁর রক্তক্ষরন হচ্ছে, দেশে তাঁর কোন চিকিৎসা নেই, তাঁকে অতিদ্রুত অমুক অমুক দেশে উন্নত চিকিৎসার জন্যে অতিদ্রুত নিয়ে যেতে হবে, নইলে এরমাঝে যদি ম্যাডামের কিছু হয়ে যায় তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে!’
এসব ছিল বিভাগীয় শহরগুলোতে বিএনপির সমাবেশগুলোর বক্তৃতার ভাষা। কথা ছিল আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির আগ পর্যন্ত এসব সমাবেশ চলবে। আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা করতে না পারলেও বিএনপির কর্মসূচি সমূহ ধারাবাহিক থাকেনি।
অতঃপর তাদের ভাষার ‘অবৈধ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছে’ আবেদন করে ছয় মাস পরপর খালেদা জিয়ার দন্ড স্থগিত করে বাসায় থেকে ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও পছন্দের হাসপাতালে বেগম জিয়ার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা চলছে। দেশের সবচেয়ে দামী হাসপাতালের চিকিৎসায় তিনি ভালো আছেন।
এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর টুস করে বক্তব্যের পর বিএনপির মনে হলো এটা ‘খালেদা জিয়াকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র’! এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে উল্টো বেকায়দায় পড়ে গেছে বিএনপি! ছেলেপুলেকে সঠিক ইতিহাস না পড়ালে যা হয়। অথবা সঠিক ইতিহাস বলতে পড়াতে গেলে সমস্যায় পড়ে যেতে হয় দলটিকে!
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের সমাবেশে শ্লোগান দেয়া হয়েছে, ‘পচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’! একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার বললে মুক্তিযুদ্ধকে মনে করা হয়। আর পচাত্তরের হাতিয়ার মানে জাতির পিতার সপরিবারে হত্যাকান্ড।
এটা পচাত্তরের হত্যাকান্ডের খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির শ্লোগান। পচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তারা মুজিব পরিবারকে নির্বংশ করতে চেয়েছে। যাতে এই পরিবারের কোন সদস্য আর কোন দিন বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসতে না পারেন।
ওই সময়ে জাতির পিতার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে প্রানে বেঁচে যান। অথবা তখনও ঘাতকরা ভাবতে পারেনি বাংলাদেশে কোন দিন নারী নেতৃত্ব ক্ষমতায় আসতে পারে। তাহলে হয়তো বিদেশে গিয়েও তারা তাদের খুন করে আসতো।
সেই ক্ষোভে হতাশায় তারা শ্লোগান দেয়, ‘পচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার’! ফ্রিডম পার্টি এখন নিখোঁজ একটি দল। এ দলের কয়েক নেতার ফাঁসিতে প্রান গেছে। অন্যরা, এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরা পৃথিবীর কোন প্রান্তে আছেন সেটিও গোপন রাখা হয়।
খুনি রশীদের মেয়েকে গুলশানের ক্লাবে স্থান কারা দিয়েছে এটিও অনুসন্ধানের বিষয়। আর সেই নিখোঁজ ফ্রিডম পার্টির শ্লোগান দেয় ছাত্রদলের নেতা! এ নিয়ে টেলিভিশনে একাত্তর জার্নালে প্রশ্ন করলে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বলেন, এই শ্লোগান তারা নাকি ৭ নভেম্বরের স্মরনে দেন!
৭ নভেম্বর কোন হাতিয়ার গর্জে উঠেছিল? সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে হত্যার? আরেক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল(অবঃ) আবু তাহেরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার? এ প্রশ্নে ছাত্রদল নেতা আমতা আমতা করেন! ইতিহাস নিয়ে ভুল পাঠ, ভুল জ্ঞান থাকলে এভাবেই যে আমতা আমতা করতে হয়।
এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলতে শুরু করেন, ‘পদ্মা সেতু কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আমরা জনগনের ট্যাক্সের টাকায় গড়া সেতু। কাজেই আমরা পদ্মা সেতুর বিরোধী নই। আমাদের প্রশ্ন অত হাজার কোটির পদ্মা সেতু নির্মান ব্যয় অত হাজার কোটিতে পৌঁছলো কেনো?
সরকার পদ্মা সেতুর নামে মেগা প্রকল্প বানিয়ে লুটপাট করে বিদেশে টাকা পাচার করেছে!’ এভাবেই চলছে বিএনপি নামের দলটি। এদের চোখে দেশের কোন সাফল্য নেই! দেশের কোন অর্জনে এ দলের ছেলেমেয়েরা অংশগ্রহন-উৎসব করতে পারেনা। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতেও নয়!
‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’র দলের নেতাকর্মীরা বাংলাদেশের জন্মবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির ঘটনায় এক রকম বেদনা অনুভব করে! এভাবেই বিএনপি দলটি দিনে দিনে দেশের মূলধারা বিচ্ছিন্ন দল! স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এই মূহুর্তের ইতিবাচক দেশের মূলধারার প্রধান ঘটনা।
এখানে বিএনপির অংশগ্রহন নেই। আবার তাদের অংশগ্রহন থাকা উচিত ছিল এমন একটি আকাংখা স্পষ্ট হয় মির্জা ফখরুলের সর্বশেষ একটি বক্তব্যে! হঠাৎ বিএনপির মহাসচিব বলা শুরু করেছেন, পদ্মা সেতুর নির্মান কাজ শুরু করেছিলেন খালেদা জিয়া!
মির্জা ফখরুল এক সময় শিক্ষকতা করতেন। এখন তিনি তারেক রহমানের ছাত্র। তিনি হয়তো তার সর্বশেষ বক্তব্যের পর বুঝতে শুরু করেছেন এই প্রজন্ম অনেক স্মার্ট, তথ্য নির্ভর। তারা ধারাবাহিক তথ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর সব তথ্য উপস্থাপন শুরু করেছে।
এই সময়ের চমৎকার একটি আত্মপরিচয়, ‘আমি—আমার টাকায় আমার সেতু, স্বপ্নের পদ্মা সেতু’। এই সময়ে বিএনপি-ছাত্রদলের সদস্য-সমর্থকদেরও নিশ্চয় এমন পোষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তারেক রহমান-মির্জা ফখরুলদের বিএনপির কারনে দলটির নেতাকর্মীরাও দেশের মূলধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন।