ফজলুল বারী:তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সৃষ্টির আগে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁর ছেলের সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম নির্বাচিত বাংলাদেশি জনপ্রতিনিধি প্রবীর মৈত্র তাঁর ছেলে। এদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দল অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির সঙ্গে সক্রিয় জড়িত। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের সুখদূঃখের সাথী আমাদের প্রবীর দা।
২০০৮ সালের ৩১ অক্টোবর আমার পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় আসে। আমার তখন গাড়ি নেই। প্রবীর দা তাঁর গাড়িতে বিমান বন্দর থেকে তাদেরকে লিফট দেন। এভাবে সম্পর্কটি পারিবারিক পর্যায়ে গড়ায়। রণেশ দা’র ছেলেও আমার প্রবীর দা। এটাই মিডিয়ার মানুষজনের সম্পর্ক এবং সম্বোধন।
আর রণেশ দা আমাকে লজ্জায় ফেলে দিয়ে ছেলের মতোই ডাকতেন বারী ভাই। এরপর থেকে রণেশ দা, বৌদি পূরবী মৈত্র যখনই সিডনি আসতেন আমরা তাদের দেখতে যেতাম। বাসায় নিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। তাঁকে নিয়ে লিখতাম। তিনি আমাদের রণেশ দা তথা রণেশ মৈত্র। একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক। তাঁর স্ত্রী পূরবী মৈত্র মহিলা পরিষদের নেত্রী ও শিক্ষকতার পেশায় ছিলেন।
আজকাল বাংলাদেশের অনেক পণ্ডিতম্মন্য মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু নাকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি! আমি তাদেরকে রণেশ দা’র কথায় জবাব দেই। রণেশ দা বামপন্থী রাজনীতিক। খুব অল্প কিছুদিন আওয়ামী লীগ করলেও বাম রাজনীতিক হিসাবেই জীবন পার করেছেন।
ছিলেন। একাত্তরে পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অন্যতম ছিলেন। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রণেশ মৈত্র পাকিস্তান আমলে তাঁর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার সময় কারাগারে ছিলেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র হিসাবে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন।
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা উপলক্ষে তাঁকে ঢাকায় প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তখনও বঙ্গবন্ধু হননি। তখন ঢাকা কারাগারে ছিলেন শেখ মুজিব তথা রণেশ দা’র মুজিব ভাই। জেলখানার ভিতরে প্রতিদিন সকালে বিকালে হাঁটতেন মুজিব ভাই।
তখন বন্দীদের এমন দূরত্বে রাখা হতো যাতে বন্দীদের সঙ্গে মুজিব ভাই’র দেখা কথা না হয়। কিন্তু রাজনীতির মানুষ রণেশ মৈত্র একদিন এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন যাতে তাঁর মুজিব ভাই তাঁকে দেখতে পান। কৌশলে কাজ হয়। মুজিব ভাই তাঁকে ডেকে নেন।
তাঁর নাম পরিচয় জেলে আসার কারন সব জানতে চান। এরপর মুজিব ভাই বলেন, তুই আমার সঙ্গে আয়। একসঙ্গে হাঁটি আর গল্প করি। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে বিকালে হাঁটার সময় রণেশ মৈত্রকে ডেকে নিতেন তাঁর মুজিব ভাই। একদিন হাঁটার সময় জেলখানার বাইরে শোনা শ্লোগানের শব্দ।
তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। রণেশ মৈত্রকে মুজিব ভাই বলেন, আমার আলটিমেইট গৌলতো স্বাধীনতা। মাথা নেড়ে না সূচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে রণেশ মৈত্র বলেন, নাহ, আপনাকে দিয়ে স্বাধীনতা হবেনা। আপনার মক্কাতো আমেরিকা।
আমেরিকা আপনাকে স্বাধীনতার পথে যেতে দেবেনা। মুজিব ভাই রণেশের মাথায় হাত রেখে বলেন, শোনো রণেশ, আমার নানান লোক নানা সেক্টরে কাজ করছে। সবার সেক্টর আলাদা। সেদিনই রণেশ মৈত্র মুজিব ভাই’র মুখে তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্য জেনে যান।
এরজন্যে একাত্তরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করতে তিনি দেরি করেননি। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি এমন কথা আমার সামনে কেউ বললে আমি রণেশ দা’র কথায় জবাব দেই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু পাবনা এলে সার্কিট হাউসে গার্ড অব অনারের পর স্থানীয় বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন।
রণেশ মৈত্র দাঁড়িয়েছিলেন একটু পিছনের সারিতে। বঙ্গবন্ধুর চোখ পড়তে তিনি লাইন ভেঙ্গে হেই রণেশ বলে তাঁর কাছে চলে যান। এরপর পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘বলেছিলামনা, আমার গৌল স্বাধীনতা’। ঘটনা উল্লেখ করে রণেশদা বলেন এমন প্রখর স্মৃতি শক্তি ছিল বঙ্গবন্ধুর। একবার কারও নাম মুখে আনলে সেটা আর ভুলতেননা।
প্রথম দিকে রণেশ মৈত্র ভাসানী ন্যাপ করলেও পরে যোগ দেন মোজাফফর ন্যাপে। মাঝে কিছুদিন করেছেন গণফোরাম। আবার ঐক্য ন্যাপে ফেরত যান। তবে শেষ জীবনটা লেখালেখি করে কাটিয়েছেন। লেখালেখি, সাংবাদিকতা অবশ্য শুরু তাঁর বহু আগে। পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেছেন। সেখান থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্বাধীন লেখালেখি শুরু করেন। এরপর থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন। সিডনিতে কথায় কথায় বলেছেন, জনকন্ঠ কতদিন তার লেখার টাকা দেয়নি। তবু লিখেই গেছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় তার ছেলে প্রকৌশলী, পুত্রবধূ চিকিৎসক। তাই অস্ট্রেলিয়ায় এলে তাঁর মেডিকেল চেকআপের কাজটি ঠিকমতো হতো। নাতি অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট খেলে। এটা তাঁর গর্ব ছিল। আমার প্রতি তাঁর দাবি ছিল আমি যাতে তাঁকে দেখতে যাই। গল্প করি। সময় দেই।
তাঁকে একুশে পদক দেবার সময়ও তিনি সিডনিতে ছিলেন।দেশে তাঁর পক্ষে তাঁর এক ছেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পদক নেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিডনি এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী যখন দেশের বাইরে কোথাও যান তাঁর সঙ্গে দেখা করার লাইন পড়ে যায়।
কিন্তু রণেশ দা’র ভাগ্যটা ছিল ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিডনি আসার আগে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে বলে রেখেছিলেন তিনি রণেশ কাকা’র সঙ্গে দেখা করতে চান। হাইকমিশন সেভাবেই তাঁর সময় চেয়ে রাখে। তাঁর সঙ্গে আলাদা করে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গল্প করেছেন। ছবি তুলেছেন।
১৯৩৩ সালে রাজশাহীর ন’হাটা গ্রামে জন্ম রণেশ মৈত্র’র। পৈত্রিক বাড়ি পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। তার স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। চার ছেলে-মেয়ের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
১৯৫০ সালে পাবনা জিসিআই স্কুল থেকে রণেশ মৈত্র ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ এবং ডিগ্রী পাশ করেন ১৯৫৯ সালে। সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমেই ১৯৫১ সালে তার সাংবাদিকতার শুরু।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে সাংবাদিকতা করেছেন তিন বছর। ১৯৫৫ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেন । ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে পাবনা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন।
১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০০০ সাল পর্যন্ত কাজ করেন ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে। পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে শীর্ষ পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে সারাদেশে ব্যাপক খ্যাতি পান।
সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য ২০১৮ সালে তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। স্কুলজীবন থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালাতেন রণেশ মৈত্র। নিজের সংগ্রাম জানতেন বলে মানুষের সংগ্রামের তিনি সতীর্থ হন।
১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেবার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু। একই সময়ে সাংবাদিকতায় জড়ান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলখাটায় বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচায়’ রণেশ মৈত্রের নাম ছয় বার উল্লেখ করেছেন (দ্রষ্টব্য উক্ত গ্রন্থের ৮৫, ৯০, ১১৮, ১৩৮, ১৫৭ এবং ১৬১ পৃষ্ঠা)।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঐক্য ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পাবনা জেলা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন রণেশ মৈত্র। আইনজীবী হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল। তাঁর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’, ‘নিঃসঙ্গ পথিক’ ‘বাংলাদেশ কোন পথে?’, ‘আত্মজীবনী’ ও ‘আঁধার ঘোচানো বঙ্গবন্ধু’।
আজ জানলাম তিনি নেই। আর সিডনিও আসবেননা কোন দিন। খবর পেয়ে প্রবীর দা’কে ফোন করে কাঁদলাম। আমরা একজন স্বজন হারিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশীদের অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি আলো ছড়াতেন। সেই আলোটাও হারিয়ে গেলো। ভালো থাকবেন রণেশদা। অমর্ত্যকে দেখে রাখবেন।
ছবিতে লেখক রণেশ মৈত্র ও তাঁর ছেলে অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশী ব্যক্তিত্ব প্রবীর মৈত্র’র সঙ্গে