পূরবী পারমিতা বোস: ছোটবেলায় মা আমাদের প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে ছোট ছোট শিক্ষামূলক গল্প শোনাতেন।আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে সেই সব গল্প।আবার তার কিছু কিছু আমি আমার ছেলেকে বলি।কিছু কিছু গল্প হারিয়ে যাচ্ছে ।কোথাও আর দেখি না।তাই ভাবলাম লিখে ফেলি।মায়ের মুখে শোনা আর আমার ভাষায় লিখা “রাজার তোতা পাখি”।খুব ছোটবেলায় মা আমাদের শিক্ষামূলক গল্প শোনাতেন।সেই সব গল্পের একটা গল্প ছিল “রাজার তোতা পাখি।”
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক রাজা আর তার ছিল এক কথা বলা তোতা পাখি। সেই পাখি সকাল বিকাল নাচিয়া গাহিয়া রাজার মনোরঞ্জন করিতো।বহুদিন রাজার সাথে থাকিয়া সে রাজার বিশ্বাস অর্জন করিয়াছিল।রাজা তাহার খাঁচার দরজা খুলিয়া দিলেও সে উড়িয়া যাইতো না। খাঁচা হইতে বাহির হইয়া কখনো রাজার হাতে কখনো কাঁধে কখনো মাথায় বসিয়া সুরেলা কণ্ঠে গান গাহিত ,পুচ্ছ নাচাইয়া নাচিত।
রাজা মহা আনন্দে করতালি দিতো আর সভাসদ কে বলিত দেখো দেখো কি বিশ্বাসী পাখি আমার। সভাসদ গন মাথা নাড়িয়া আজ্ঞে মহারাজ আজ্ঞে মহারাজ বলিয়া কলরব করিত।
একদিন এক সকালে মহারাজ দেখিলেন পাখি নাচিতেছে না,গান ও গাহিতেছে না ,মনমরা হইয়া খাচার এক কোন মাথা ঝুকাইয়া বসিয়া আছে । রাজা দুঃখভারাক্রান্ত মনে জিজ্ঞাসা করিল তোতা তোমার কি হইয়াছে। কেউ কি তোমাকে কটু কথা বলিয়াছে।খাদ্য কি বিস্বাদ লাগিতেছে। কোনো কি রোগ বাধাইয়াছো।বোলো বোলো কি কারণে তুমি বিষন্ন। তোতা মুখ ভোতা করিয়া বলিল মহারাজ অভয় দেন তো বলি। মহারাজ তটস্থ হইয়া বলিল বলো বলো খুলিয়া বলো বিশদ ।
তোতা বলিলো ,”মহারাজ নিজের দেশে যাইতে মন চায়,বাবা , মা ,ভাই ,বোন ,বন্ধু পরিজন দেখিতে প্রাণ কাঁদে। একবার যদি অনুমতি দিতেন আমি দিন গিয়া দিন ঘুরিয়া আসিতাম ।”রাজা চমকিয়া উঠিল।পাখি সেই বুঝিয়া বলিল,”বহুদিন আপনার নিকট আছি ।কখনো অবিশ্বাসী হই নাই.কত দিন খাঁচা খুলিয়া দিয়েছেন কোথাও উড়িয়া যাই নাই। আপনার নিকট থাকিতে থাকিত বয়স বাড়িলো। কবে মরিয়া যাইবো তাই মনোবাঞ্ছা পরিবার পরিজন কে শেষবার দেখি।” এই কথা শুনিয়া রাজার টনক নড়িল সত্যি তো পাখি তো কবেই চলিয়া যাইতে পারিত সেতো যায় নাই তবে তো তাহার কথা ঠিক। একবার তো তাকে সুযোগ দেয়াই যায়। মহারাজ ভাবিলেন বনের পাখি তাহাকে বহুত আনন্দ দিয়াছে খুশি করিয়াছে তার তো পাখির জন্য কিছু করাই উচিত। রাজা আনন্দচিত্তে বলিলেন ,”যাও পাখি তুমি আজই রওনা হইয়া যায়। তোমার পরিজনদের সাথে দেখা করিয়া সময় মতো ফেরত আসিও,আমি অপেক্ষায় রইবো”। সভাসদ হা হা করিয়া উঠিল।মহারাজ বনের পাখি একবার গেলে কি আর ফিরিবে।
মহারাজ অভয় দিয়া বলিলেন আমি উহাকে বিশ্বাস করিলাম। বাকিটা তার চরিত্র।পাখি রাজার কাঁধে বসিয়া কৃতজ্ঞতার গান শোনাইয়া উড়াল দিলো রাজা হাত নাড়িয়া তাহাকে বিদায় জানাইয়া সভা ভাঙিয়া অন্দরে চলিল।সভাসদ পাখি বিষয়ক নানাবিধ জল্পনা কল্পনা শুরু করিল।বনের পাখি বনে ফিরিয়া পরিবার পরিজন কে খুঁজিয়া পাইতে কিঞ্চিৎ সময় লাগাইলো ,তারপর সকল কে পাইয়া নাচিয়া গাহিয়া মনের কথা কহিতে কহিতে কোথা দিয়া সময় কাটিয়া গেলো বুঝিতে পারিল না।রোদের
তেজ কমিতেছে দেখিয়া মনে পড়িল অাজই তার ফিরিবার কথা।
পাখি তার পরিবারের সবাইকে বলিল সে অল্প সময় লইয়া আসিয়াছে তার আজিকেই ফিরিতে হইবে।সকল পাখিরা কাঁদিয়া কাটিয়া তাকে বুঝাইতে লাগিল সে যেন আর বন্দি জীবনে ফেরত না যায় স্বাধীন জীবন ঢের ভালো। পাখি দৃঢ় কণ্ঠে বলিল আমি কথা দিয়েছি,আমাকে ফিরিতেই হইবে।
তখন পাখির মাতা কহিল আজ বুঝিতে পারিয়াছি রাজামশাইকে তুমি অতি ভালোবাসো তাই ফিরিয়া যাইতেছে ।যাইবার সময় আমাদের তরফ হইতে তাহার জন্য একটি সুস্বাদু ফল উপহার লইয়া যাও।
পাখি সানন্দে রাজি হইলো।সবার সাথে গলা জড়াইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া বিদায় লইয়া ঠোঁটের ভেতর অমৃত ফল লইয়া উড়াল শুরু করিল।একে তো বিষন্ন মন তাহার উপর ফলের ভারে তার উড়ার গতি কমিয়ে গেলো।উড়িতে উড়িতে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল।সে বুঝিল তার পক্ষে আজ আর ফেরা সম্ভব নয়। কিছুটা ভয় ও ভাবনায় একটি গাছের কোটর খুঁজিয়া তাহাতে ফল খানি রাখিয়া সে পাখা দুটি গুটাইয়া একটু ক্লান্তি নিবারণে চক্ষু মুদিল।
ভোরের আলোয় আর নানান পাখিকুলের কিচিরমিচিরে তার ঘুম ভাঙিল। তাড়াহুড়ায় ফল খানি মুখে লইয়া উড়াল দিলো। ইচ্ছা মনে রাজামশাইয়ের ঘুম ভাঙিবার আগেই যেন সে পৌছাইতে পারে।
ছোট ডানায় যতটুকু শক্তিতে কুলায় সে তার সবটুকু শক্তি প্রয়োগ করিয়া উড়িলো উড়িলো এবং উড়িলো।উড়িতে উড়িতে সে রাজদরবার যখন আসিয়া পৌঁছাইলো রাজা সবে সভায় আসন নিয়েছেন।সভার মধ্য খানে আসিয়া টুপ করিয়া মহারাজের কোলে ফলটি ফেলিয়া তার কাঁধে গিয়া বসিল।
পাখিকে দেখিয়া রাজা আনন্দে চিৎকার করিয়া উঠিল আমার তোতা ফিরিয়াছে আমার প্রাণ প্রিয় পাখি ফিরিয়া আসিয়াছে।তোমরা দেখো সে শুধু ফিরিয়া আসে নাই আমার জন্য ফল উপহার লইয়া আসিয়াছে।এই কে কোথায় আছিস শীঘ্রই ফল কাটিয়া আমাকে দে।
আর পাখি কে জল খাবার দে। রাজার জন্য ফল কাটিয়া আনা হইলো।রাজা যেই ফল খানা মুখে দিবে তখন সভার পিছন হইতে কেউ বলিয়া উঠিল মহারাজ বনের পাখি কিনা কি ফল নিয়া আসিয়াছে আপনি খাইবার আগে যদি একটু পরীক্ষা করিয়া লইতেন তবে তাহা ঠিক হয়তো।ইহা তো বিষ ফল ও হইতে পারে।রাজা রাগিয়া উঠিতে গিয়া ভাবিলেন সত্যি তো বনের পাখি না বুঝিয়া কে জানে কি আনিয়াছে।
তিনি হুকুম দিলেন এই ফল কোনো পশু কে আগে খাওয়ানো হউক। সিপাহী একটি খরগোশ ধরিয়া আনিয়া তাহাকে কাটা ফলের একটি টুকরা খাওয়াইলো কিছুক্ষনের ভেতর খরগোশটি ছটফট করিতে করিতে মরিয়া গেলো।সভাসদ সব আতংকে হায় হায় বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল।আর বলিতে লাগিল কি সর্বনাশা পাখি।নিজের মুক্তির জন্য বন হইতে বিষ ফল আনিয়াছে রাজা কে মারিবার জন্য।হটাৎ করিয়া রাজার মাথা গরম হইয়া গেলো কাঁধ হইতে এক ঝটকায় অকৃতজ্ঞ পাখিকে একটানে ধর হইতে মাথা বিচ্ছিন্ন করিয়া মেঝেতে ছুড়িয়া ফেলিয়া গট গট করিয়া দরবার হইতে অন্দরে চলিয়া গেলো।অবুঝ পাখির দেহখানি কিয়ৎক্ষণ ছটফট করিতে করিতে একদমই নিথর হইয়া মেঝেতে উল্টায়া পড়িয়া রহিল।অন্দর হইতে রাজার হুকুম আসিল এই ফলের বীজ রাজমহলের পাঁচিলের কাছে পুতিয়া রাখো।রাজ্যে যে অপরাধ করিবে।তাকে বিষফল খাইবার প্রাণদন্ড দেয়া হইবে এবং অকৃতজ্ঞ পাখির কথা সবাই কে জানানো হইবে।
দিন গিয়া বছর ঘুরিল।বীজ হইতে গাছ বাড়িয়া বিশাল বৃক্ষ হইলো।বৃক্ষ ভরিয়া ফল আসিল।কিন্তু কেহই ওই পথ মাড়ায় না। শুধু দূর হইতে দেখে লাল লাল ফলে বৃক্ষ ঝুকিয়া পড়িতেছে। বিষবৃক্ষের ফল যত হয় সে রাজ্যে তত অপরাধ কমিতে লাগিল। সকলেই ত্রস্ত থাকে বিষ ফল খাইবার ভয়ে। সেই গ্রামে এক হতদরিদ্র ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর বাস ছিল। শীর্ণকায় জরাজীর্ণ। এবেলার খাদ্য জোটে তো আরেক বেলা না খাইয়া থাকে।ভিক্ষা করিয়া কোনোমতে দিনাতিপাত করে।হটাৎ তাদের ভিক্ষা করা বন্ধ হইলো শরীর স্বাস্থ্যেও উন্নতি দেখা গেলো।কিন্তু কোনো কাজ করিতে দেখা গেল না। রাজ্যের সকলে বলাবলি করিতে লাগিল ব্রাহ্মণ নিশ্চয় চোর হইয়াছে।রাতের বেলায় চুরি করিতেছে। তাহা না হইলে এই উন্নতি কিরূপে।
এই কান সেই কান হইয়া রাজার কানে কথা গেল।রাজা হুকুম করিলেন দুইজন কে ধরিয়া আনো। সিপাহী ছুটিল ব্রাহ্মন-ব্রাহ্মনীকে ধরিতে।পিঠ মোরা দিয়া তাহাদের বাঁধিয়া নিয়া আসিল।রাজা হুঙ্কার দিয়া বলিলেন। তুমি ,তোমরা অপরাধী।এই বিষয়ে কি কিছু বলিতে চাহ?এই কে আছিস যাও বিষ ফল তুলিয়া নিয়া আসো ।ইহাদের সেই ফল খাইতে দাও।ফল খাইয়াই ইহারা মরুক।ব্রাহ্মণ হাত জোড় করিয়া বলিল ,”মহারাজ অভয় দেন তো আমি বলি আজ্ঞে মহারাজ চুরি আমি করিয়াছি ,তবে কাহারো গৃহে নয়।আপনার বাগান হইতে।সেই অপরাধে আমি অপরাধী ,কিন্তু এই ফল খাইয়া তো আমি মরিব না। রাজা বলিলেন ,”মানে কি খুলিয়া বল।ব্রাহ্মণ বলিতে শুরু করিল।ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পারিয়া তারা সিদ্ধান্ত নিয়া ছিল যে আত্মহনন করিবে এবং রাজার বাড়ির বিষফল হইবে সবচেয়ে সহজ উপায়।তাই তারা দুইজনে ব্যাগ ভরিয়া বিষফল চুরি করিয়া নিয়া পেট ভরিয়া ফল খাইয়া দুইজন দুইজনের কাছ হইতে বিদায় নিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া পেট ভরিয়া ফল খাইয়া ঘুমাইতে গেল। ভরা পেটে তাহাদের ভালো ঘুমও হইয়াছে।
সকালে জাগিয়া দেখে তারা মরে তো নাই বরং বহুদিন পর পেট ভরিয়া কোনোকিছু খাইবার ফলে ভালো ঘুম হওয়াতে তারা শরীরে বল পাইতেছে।তখন তাহারা বুঝিল এই ফল বিষফল নয়।তাই প্রতি রাতেই তারা ফল চুরি করিয়া তিনবেলা ফলাহার করিতেছে।আর তাহাতেই তাদের ক্ষুধাও নিবারণ হইতেছে উপরন্তু শরীর স্বাস্থ্য উন্নত হইতেছে বলিয়া ব্রাহ্মণ হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল ।মহারাজ আমরা ফল চুরির অপরাধে অপরাধী। মহারাজ ও সভাসদ অবাক হইয়া গেলো।কেউ কেউ পিছন হইতে বলিতে লাগিল মিথ্যাবাদী ব্রাহ্মণ। রাজা বলিলেন তোমার কথা সত্য কিরূপে বুঝিব। কথা যদি মিথ্যা হয় তোমার দ্বিগুন অপরাধে শিরোচ্ছেদ করা হইবে।ব্রাহ্মণ বলিল আমাকে দিয়া পরীক্ষা করুন মহারাজ। বিষবৃক্ষের ফল আনিয়া দিন,আমি খাইয়া দেখাইয়া দেই। মহরাজের হুকুমে সিপাহী ছুটিলো ফল আনিতে ।ভয়ে ভয়ে ফল ছিড়িলো।গোটাকয় ফল লইয়া দৌড়াইয়া আসিল।ব্রাহ্মণ এর হাতে ফল দিয়া রাজা হুকুম দিলেন, আমার সামনে বসিয় ফল খাও। ব্রাহ্মণ শান্তচিত্তে মনের আনন্দে ফল খাইতে লাগিল।একটা দুইটা তিনটা। সুপক্ক ,সুমিষ্ট ফলের সুবাস চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।ব্রাহ্মণের হাত গড়াইয়া ফলের রস পড়িতে লাগিল।
সকলে অবাক হইয়া সেই দৃশ্য দেখিল।সবগুলি ফল শেষ কোরিয়া ব্রাহ্মণ বলিল মহারাজ এখন আমার কি বিচার হইবে।রাজা যেন ধ্যানমগ্ন ছিলেন।হটাৎ ব্রাহ্মনের কথায় তিনি কি ভুল কি ভুল বলিয়া হুঁ হুঁ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।সভাসদ নিশ্চুপ রহিল।রাজা ধাতস্ত হইয়া বলিলেন।বনের পাখি অমৃত স্বাদের ফল ঠিকই আনিয়াছিল কিন্তু পথমাঝে কোথাও রাত্রি যাপনে সে কোনো গুহা বা কোটরে যে ফল রাখিয়া ছিল তাহা কোনো সাপের কোটর হইবে।রাতে সেই সাপ কোনো প্রাণী ভাবিয়া সেই ফলে ছোবল দিয়েছে তাহাতে সাপের বিষ ফলে আসিয়াছে।তোতা তো তাহা বোঝে নাই সে লইয়া আসিয়াছে সেই ফল খাইয়া খরগোশ মরিয়াছে।বীজ মাটিতে লাগানোতে তাহার বিষ নষ্ট হইয়া পুনরায় গাছ হইয়া তাহাতে ফল ধরিয়াছে।সেই সুমিষ্ট ফল খাইয়া ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী সুস্বাস্থ্য পাইয়াছে।আমি না জানিয়ে না বুঝিয়া অন্যের কথা শুনিয়া রাগের মাথায় আমার প্রানপ্রিয় তোতা পাখিকে হত্যা করিয়াছি। আমি পাপী , আমি পাপী। অতঃএব তোমরা কেহ আর কোনোদিন রাগের বশবর্তী হইয়া,কোনো কিছু না জানিয়া ,না দেখিয়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে না। এই বলিয়া রাজা তোতা তোতা বলিয়া হাহাকার করিতে করিতে অন্দর মহলে চলিয়া গেলো।