কাজী সুলতানা শিমি :২০শে নভেম্বর আমার বাবার না ফেরার দেশে চলে যাবার দিন। জাগতিক সময় পেরিয়ে কোথায় আছেন তিনি জানিনা। বাক্তিগত জীবন ও অনুভূতি নিয়ে আমার কখনো কিছু লিখতে কিংবা বলতে ইচ্ছে করেনা। অনেকে গল্পচ্ছলে নিজের পারিবারিক জীবন নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ করেন। কিন্তু কেন জানি আমার সেটাও করতে ইচ্ছে করেনা। এলেবেলে জীবন সেতো সবারই একরকম। যা থেকে অন্যরা কিছু শিখতে পারে, জানতে পারে শুধু সেরকম কিছ লিখতে ইছে হয়। যাই হোক সেটা যার যার নিজেদের ব্যাপার। নিজস্ব কিছু পছন্দ-অপছন্দ তো থাকতেই পারে। যেমন বাবার ব্যাপারে আমার একটা নিভৃত ইচ্ছা হচ্ছে তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব লিখতে ইচ্ছে করে। মনে হয় মাকে নিয়ে তো সবাই-ই কিছু না কিছু লিখছে। বাবাকে নিয়ে এতো কৃপণতা কেন!
একটি মানুষের শিশু থেকে বড়ো হয়ে উঠার পেছেনে কিন্তু বাবার অবদান কম নয়। কিছু কিছু বাবা হয়তো বাতিক্রম হতে পারেন। কিন্তু সে তো সব কিছুতেই হয়। তাদের আবেগ প্রকাশের ব্যাপারটা ভিন্ন বলে তারা তো অনুভূতিহীন নয়। বাবা বিহীন হয়ে বড়ো হওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যর ব্যাপার। আজ আমার বাবাকে নিয়ে অল্প কিছু স্মৃতি লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার বাবা বিচিত্র চরিত্রের একজন মানুষ। খানিকটা হুমায়ুন আহমেদের কল্পিত চরিত্রের মতো। তার রাগ ও আনন্দ কিছুই বুঝা যায়না। এনিয়ে সবসময় আমরা ভাইবোনরা তাকে খুব খেপানোর চেষ্টা করতাম। অবশ্য এখনো করি। কিছুদিন আগে আমার মা’র ফেসবুকে দেখলাম বাবা শাদা-লাল ট্রাক-স্যুট পরে সাইকেল চালাচ্ছেন। কানাডার অটোয়া। সবুজ বনবীথিকায় মাথার সিঁথির মতো সরু ফুটপাত। চারপাশে সিগ্ধ ছায়া। বাবা তার সাইকেলে। সাথে আমার ভাইয়ের বাচ্চারা। ছবিটা দেখে আমরা সবাই নানারকম মন্তব্য করলাম। আরেকটা ছবিতে তিনি লেকের পাড়ে মাছ ধরছেন। তার বরশীর হুকে মাছ আঁটকে আছে। এ নিয়ে তিনি মহা খুশী। সত্যি বলতে কি তাকে এরকম প্রনবন্ত খুশী হতে কখনো দেখিনি। সারাজীবন দেখে এসেছি ৯টা-৫টা অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতেন। বিকেলের চা শেষে খবরের কাগজ নিয়ে বসা। তারপর আমাদের পড়াতে বসতেন। তিনি ছিলেন একজন সরকারী ব্যাংক অফিসার। বদলীর চাকরী হওয়ায় আমাদের সারা জীবন কেটেছে এ জেলা থেকে সে জেলায়। কোন ধরণের তদ্বির এবং ঘুষ খেতে কিংবা দিতে’ পারতেন না বলে তার বদলী ও হতো খুব ঘন ঘন। আর তল্পী-তল্পা নিয়ে আমাদের ছোটবেলা কেটেছে সিলেট, চিটাগাং, কুমিল্লা সহ নানা জায়গায়। এ নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে ছিল অসীম বিরক্তি। নতুন স্কুলে বন্ধুত্ব হতে না হতেই আবার অন্য স্কুলে যেতে হতো। এজন্য আমাদের কারোই কোন বন্ধু ছিলোনা স্কুল-জীবনে। তার নিজের জীবনেও একই দশা। বিভোর আড্ডার মানুষ নন তিনি।
আসলে বাবাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কথাই এসে যায়। যে কথা লিখতে বসেছিলাম। আমাদের পড়াশোনা ও ভাল মানুষ হয়ে গড়ে তোলার ইচ্ছেই ছিল তার মুল লক্ষ্য। এজন্য নিজের কোন চাওয়া-পাওয়া ছিলোনা। সারাদিন পড়ার কথা বলাই ছিল তার একমাত্র কাজ। ছোটবেলায় আমার খুব গান শেখার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছেটা জানার পর কিনা জানিনা তিনি সবুজ রঙের একটা রেডিও কিনে এনেছিলেন। বললেন শুনে শুনে গান শিখতে হবে। কারো কাছে শিখতে গেলে সময় নষ্ট তাতে পড়াশুনার ক্ষতি হবে। সত্যি বলতে কি রেডিওতে শুনে শুনেই আমি অনেক গান মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। সিলেটের আম্বরখানায় থাকি। আমার বাবা হটাত একদিন বিকেলে আমাকে ডাকলেন। পাশে বসালেন। তারপর বললেন, একটা গান কর। তোকে আমি গুন-গুনিয়ে গান গাইতে শুনেছি। ভালো করে কর দেখি আমি শুনি। আমি হতভম্ব। তারপরও ভয়ে ভয়ে, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়”-এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটা গেয়ে শুনিয়েছিলাম। ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ে মুখস্থ রবীন্দ্র সঙ্গিত গাইতে পারে শুনে সে রীতিমতো অবাক।
অনেক কথা লিখার আছে তাকে নিয়ে। লিখবো হয়তো কোন একসময়। তবে যে বিষয়টা আমি খুব বেশী মিস করি সেটা হল আমার স্বাধীনতা বোধে কখনো বাধা দেয়নি আমার বাবা। আমার মনে আছে ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট যখন বের হয় একই সাথে চট্টগ্রাম বিশ্ব-বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট ও বের হয়েছিলো। তখন সবাই আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ব-বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হবার জন্য জোরাজোরি করেছিলেন। বিশেষ করে আমার মা ও চাচা। তাদের মতে ঢাকায় থাকলে মেয়ে অনিরাপত্তা ও নানা ঝামেলায় পরতে পারে ভেবে ঢাকায় পড়ার ব্যাপারে আপত্তি। কিন্তু আমার বাবা দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন মেয়ে যেখানে পড়তে চায় যা কিছুই পড়তে চায় সেটা সম্পুর্ন তার ব্যাপার। বলতে গেলে তার অকুণ্ঠ সমর্থনে আমার ঢাকা বিশ্ব-বিদ্যালয়ে দর্শন বিষয়ে পড়া। যদিও দর্শন বিষয়ে পড়া নিয়ে অন্য সবার ঘোর আপত্তি ছিল। আমার ইচ্ছাই সব এ বিষয়ে বাবার সমর্থনের উপর কারো কোন কথাই আর টিকলোনা। যখন যা কিছু করতে চেয়েছি সব সময়ই করতে পেয়েছি।
আমি রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা’র লাবণ্য হতে চেয়েছিলাম। শুধু দর্শন চর্চা করবো আর জীবন জগত নিয়ে ভাববো। তাই ঠিক করেছিলাম বিয়ে করবোনা কোনদিন। হয়তো এটা জানতে পেরে তিনি কোনদিন আমাকে বিয়ের জন্য পীড়া-পিড়ি করেননি বরঞ্চ অনেককেই ফিরিয়ে দিয়েছেন আমার ইচ্ছের কথা ভেবে। তাই মেয়ে দেখতে আসার ব্যাপারটি আমার জীবনে একবার ও ঘটেনি।
বাবাদের অনুভুতি বুঝনোর প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঙলা ছোটগল্পের অসাধারণ সৃষ্টি ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে’র কিছুকথা তুলে ধরছি। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পে’র নায়ক রহমত। রহমত দেশে রেখে আসা নিজের ছোট্ট মেয়ের স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে সওদা করে কলকাতার পথে পথে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, হাতে খানিকটা ভূসা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে”। ছেলে-মেয়ের প্রতি বাবাদের যে স্নেহ তার তুলনা শুধু বাবাই হতে পারেন আর কেউ নয়।