যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল একাত্তরের মার্চে, সেই যুদ্ধ নাকি এখনো চলছে। তার কাছে একাত্তরের যুদ্ধ এখনো চলমান মুক্তির সংগ্রাম। একাত্তরে যে হাতে স্টেনগান আর গ্রেনেড উঠেছিল, সেই হাতে এখন স্টেথোস্কোপ, চোখে পুরু চশমা। সদা হাসিমুখ, বিনয়ী আর নিরহঙ্কারী ডাক্তার তিনি। পেশা ডাক্তারি হলেও গাড়ি-বাড়ি করা তাঁর নেশা নয়। যিনি মনে করেন, ডাক্তারিবিদ্যা কেবল মুনাফার নয়, সেবা করার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত; তিনি চট্টগ্রাম শহরের রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ‘ডা. মাহফুজ ভাই’ নামে।
একাত্তর সালে তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেধাবী ছাত্র। পড়ছিলেন পঞ্চম বর্ষে। কিন্তু ক্যারিয়ারের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন যুদ্ধে অংশ নেওয়াকে। ছাত্রাবস্থাতেই হাতে তুলে নেন স্টেনগান আর গ্রেনেড। লড়েছেন সমর যুদ্ধে, গেরিলা কায়দায় ভয়ের কাঁপন তুলেছেন শত্রুশিবিরে। স্বাধীন দেশের সংগ্রামে সংগঠিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। এখন স্বপ্ন দেখেন সাম্য, সুশাসন, মানবিক আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার।
বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) চট্টগ্রাম সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। পেশায় চিকিৎসক এই মানুষটির সঙ্গে ২৬ মার্চ আলাপ হয় জয়নিউজের। স্মৃতি রোমন্থনে তিনি একনাগাড়ে বলে গেছেন মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ঘটনা প্রবাহ।
যুদ্ধের পটভূমিটা কেমন ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের চেতনার উপর ভিত্তি করে ’৬২ সালে ছাত্রলীগ প্রথম স্বাধীনতার জন্য একটা নিউক্লিয়াস (রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিশেষ ধারা) গড়ে তোলে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একসঙ্গে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এরপর ‘৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি তোলেন। ’৬৯-এ এগারো দফা আন্দোলন হয়। ওই আন্দোলন ছিল সর্বদলীয় আন্দোলন। স্লোগান ওঠে “আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ”, “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”। এই স্লোগান মুখে ‘৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মিছিল শুরু হয়। অক্টোবর মাসে গিয়ে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় প্রস্তাব ওঠে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের। যদিও ছাত্রলীগের একটি অংশ এটার বিরোধিতা করে।
‘এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ’৭১ এর পহেলা মার্চ। বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক করে ঢাকার বুকে দোসরা মার্চ পতাকা উড়ল। তেসরা মার্চ ইস্তেহার পাঠ আর সাতই মার্চ এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। তার অংশ হিসেবে ১৬ মার্চ আন্দরকিল্লায় একটা অস্ত্রের দোকান লুট করি। যদিও পরে জানতে পারি ওই অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব না, কিন্তু তারপরও চট্টেশ্বরী রোডে ২৬ মার্চ আমাদের প্রথম অপারেশন চালাই সেই অস্ত্র দিয়ে। কারণ কানে বাজছিল শুধু, “যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে”। সেভাবেই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।’
ডাক্তার মাহফুজের কথায় উঠে আসে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস আর ২৫ মার্চ কালরাতের ঘটনাও। তিনি বলেন, ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কোথাও তাদের পতাকা উড়েনি। বিপরীতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিল চট্টগ্রামের সবখানে। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি এই যে- ২৫ মার্চ কালোরাতে চট্টগ্রামে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ হয়নি। বরং উল্টো ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল পাকবাহিনী।
২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারে খবর পাঠ করেন মাহফুজুর রহমানসহ অনেকেই। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, বেতারে কী বলবো ঠিক করিনি। মাথায় চিন্তা আকারে যা ছিল, মুখ দিয়ে তাই-ই বলেছি। প্রথমেই বলে বসলাম, “টিক্কা খান নিহত”! কিন্তু আসলে সেরকম কিছুই ঘটেনি। উত্তেজনায় মুখের বুলিতেই তাকে মেরে ফেললাম! এখন সেই কন্ঠ শুনলে নিজের কাছেই কেমন যেন লাগে (হাসি)।
তিনি যোগ করেন, একটা বিষয় এখন বলে রাখা উচিত। বেতার রুমে একটা কল আসে। বিহারী কন্ঠ, পূর্ণাঙ্গ বাংলা বাক্য বলতে পারছিলেন না। পরিচয় দিলেন তিনি মেজর জিয়া। টেলিফোনের অপরপ্রান্ত থেকে ধমকাচ্ছিলেন। কেন আমরা গেলাম। পরে তিনি আসলেন, ততোক্ষণে বেতারের চারটা অধিবেশন শেষ। পঞ্চম অধিবেশনে এসে জিয়া বলেন, ‘অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট লিডার.. ‘কিন্তু কেন এখন তার অনুসারীরা দাবি করেন তিনিই প্রথম ঘোষক সেটার গবেষণা হওয়া উচিত। যাক, জিয়ার সমালোচনা করতেও আমার ইচ্ছে হয় না….।
এরপর তো চলে গেলেন ভারতে। অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কেমন ছিল আপনাদের গেরিলা যুদ্ধ? ‘হিট এন্ড রান’ কৌশল সম্পর্কে যদি বলতেন….
‘চট্টগ্রামে বিএলএফের একটি গেরিলা দলের দলনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমার দলে ছিল অসংখ্য গেরিলা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো অভিযান চলতো আমাদের। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর- এই পাঁচ মাস আমরা মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন চট্টগ্রামের নানা স্থানে সফল অভিযান চালিয়েছি। গেরিলারা নানা লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ছুঁড়ে পালিয়ে যেতাম। আমাদের কৌশল ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। আমাদের এই কৌশলের মানেই ছিল শত্রু শিবিরে ভয়ের কাঁপন ধরানো। তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। আমাদের একটা শপথ ছিল, গেরিলা মাস্ট নট ডাই (গেরিলারা মরবে না)। মেরে চলে আসা, পেছনে ফিরেও দেখার দরকার নাই কী হল। এভাবেই চলতো আমাদের ঝটিকা আক্রমণ। সে সময় এক দিনে ১০০টি অভিযানও একসঙ্গে চালানো হয়েছে। নৌ কমান্ডোদের দিয়ে জাহাজ ধ্বংস করার অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপটও’ সফল হয়েছে সে সময়।
ডা. মাহফুজ বলেন, যুদ্ধে সাধারণ জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা না থাকলে একা মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই পেরে উঠতাম না। কিছু কুলাঙ্গার, রাজাকার, আলবদর ছাড়া আসলে সেই সময়ের প্রত্যেকেই এই যুদ্ধের সহযোগী। তাই রাষ্ট্রের এখন উচিত সেই সময়ের মানুষ, যারা এখন প্রবীণ তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া। সব জায়গায় তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা সৎ মন্তব্য করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তিনি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কাজ করছেন। তবে তাকে জনগণের কথা শুনতে হবে। সাম্য, সুশাসন ও অসাম্প্রদায়িক হওয়া ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলমান।
(একাত্তর নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ সূত্রঃ পার্থ প্রতীম নন্দী, জয়নিউজ এবং ছবি: ইমরুল হায়দার সুমন।)