অনলাইন ডেস্ক , জুন 8, ২০১৫
অনেক দিন ধরেই বলছি, কেউ যেন একাত্তরের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে না পারে অথবা সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাস যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, সে জন্য জার্মানির ‘হলোকস্ট ডিনায়াল’ আইনের আদলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতির বিরুদ্ধে একটি আইন আমাদেরও প্রয়োজন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে না গেলে যেন আমাদের বোধোদয় হয় না। জাতির সবচেয়ে মূল্যবান রক্তে লেখা যে গর্বিত ইতিহাস তা হারিয়ে যাক, তা ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হোক– আমাদের পরাজিত শক্তি এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারে!
প্রশ্ন হল, আমরা কেন সেটা হতে দিচ্ছি? দিচ্ছি বলেই কি আজ ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলের স্পর্ধা হয় ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলার।
পঁচাত্তরের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা, চার মূল নীতি, সব মুছে দেবার চেষ্টা হয়েছে। শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা নিয়ে বার বার বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা দেখছি আমরা। নিজামী, মুজাহিদ শহীদের রক্তে রাঙানো লালসবুজ পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে দম্ভভরে বলেছে, ‘কীসের গণহত্যা!’ তারা বলার সাহস করেছে যে, একাত্তরে নাকি কোনো গণহত্যাই হয়নি। পাকিস্তানিরা যেমন বলে, তেমনি তাদের দালালের দল রাজাকাররা এমন পর্যন্ত বলতে সাহস করেছে যে, একাত্তরে এদেশে কোনো ধর্ষণ হয়নি। অথচ আজও এদেশে বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদজায়ারা বেঁচে আছেন। তাঁরা সাক্ষ্য দিচ্ছেন আদালতে। তার ভিত্তিতে শাস্তি পাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীরা। কী বিচিত্র এই দেশ!
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আর কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দিতে না চাইলে ‘হলোকস্ট ডিনায়াল আইন’এর আদলে আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতি রোধে আইন করা জরুরি। চার মুলনীতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, জয় বাংলা শ্লোগান, শহীদের পরিসংখ্যান, বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা– এ সব বিষয় শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাইকে মেনে নিতে হবে। যে স্বীকার করবে না, এই দেশে তার রাজনীতি করা তো দূরে থাক, তার এ দেশের নাগরিকত্ব থাকাও উচিত নয়। আমার দেশের মুক্তিযোদ্ধার রক্তে রাঙানো মাটিতে এদেশের জন্মের ইতিহাস স্বীকার করতে হবে। তা না হলে জেলে যাওয়া অনিবার্য, এমন আইন করতে হবে।
অনেকের কাছেই আমাদের এই দাবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না বা তারা গ্রাহ্য করছেন না। ফলে গোলাম আযমের মতো যুদ্ধাপরাধীর ছেলে সেনাবাহিনীর উচ্চপদের চাকরি হারানোর পর এখন মিডিয়ায় ও ফেসবুকে দেশবিরোধী কথা বলছে, মুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে দালাল বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। সেনাবাহিনীতে থেকে দেশবিরোধী কার্যক্রম সে চালিয়েছিল কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়। শুনতে পাই আরেক যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের ছেলে গ্রামীণ ফোনে উচ্চ পদে চাকরি করে। যেখানে দেশের তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। আমরা দেখেছি কীভাবে যুদ্ধাপরাধী কামারজ্জামানের ছেলে মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে অবমাননাকর কথা বলেছে। কীভাবে গোলাম আযমের নাতি জনতার হাতে ধোলাই খেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, ট্রাইব্যুনাল ইত্যাদি নিয়ে মিথ্যাচার করতে গিয়ে।
শুধু এটাই নয়, সম্প্রতি দেখেছি সিলেটের এক এমপি শহীদ সন্তান মোহাম্মদ জাফর ইকবালকে চাবুক মারার কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন। যে মানুষটির মেধা, মনন ও যোগ্যতার ক্ষুদ্র অংশও সে এমপি নিজে অর্জন করতে পারেননি। শুধু শ্লোগান দিলেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হওয়া যায় কি? জাফর ইকবাল তাঁর লেখনীর মাধ্যমে কত কিশোরের বুকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আবেগের জন্ম দিয়েছেন, শহীদদের জন্য চোখে পানি এনে দিয়েছেন। ওই এমপির বাবাও রাজাকার ছিল বলে শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো দল করলেই যে রাজাকারের ছেলের ভিতরের রূপটা বদলে যায় না তার প্রমাণও এই এমপি।
এরা যে যে দলই করুক, যে পদেই চাকরি করুক, এরা বাংলাদেশবিরোধী কাজই করবে। উইপোকার মতো আমাদের অজান্তেই আমাদের এত কষ্টে অর্জিত দেশের ভিত কুরে কুরে খেয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে এ রকম কিছু মানুষ। বড় বড় অনেক পদে এরা বসে আছে। আমাদের আশেপাশে আমরা সবাই নিজ নিজ পেশায় এমন রাজাকার পুত্রকন্যাদের অবস্থান জানি। অস্বীকার করার জো নেই।
সমস্যা হল, এসব কথা বললে অনেক ‘নিরপেক্ষ’ সুশীল আছেন যারা বলেন, বাবার কর্মদোষে ছেলে কেন ভুক্তভোগী হবে? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে এটা ঠিক, কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা যখন দেশের ক্ষমতায় ছিল, তখন মুক্তিযোদ্ধা পিতার কারণে কত কত পরিবার ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তখন কিন্তু এই ‘সুশীলদের’ কেউ এটা বলতে আসেননি যে, এসব অন্যায়। সুশীলদের নিরপেক্ষতা কীভাবে কীভাবে যেন কেবল স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে। এটাই যেন বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, নিরপেক্ষতার প্রতীক।
আমরা এটাও বলতে চাচ্ছি না যে, একজন অন্য কারো দোষের জন্য দায় বহন করবে। কিন্তু যখন যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরা তাদের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দেয় যে, তারা তাদের ঘৃণিত পূর্বপুরুষদেরর অপরাজনীতিরই ধারক ও বাহক, তখন কি কিছু করা বাঞ্ছনীয় নয়? লক্ষণীয় যে, এদের কেউ কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের দোষ স্বীকার করেনি বা তাদের অনুসৃত রাজনীতির পথ পরিহার করেনি, বরং একই বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রজন্মান্তরে। তাই এরাও আমাদের ক্ষমাসুলভ দৃষ্টি পাবার অযোগ্য।
গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতার ছুতোয় এবং তথাকথিত নিরপেক্ষতার ধোঁয়া তুলে আমাদের ভিতরের কিছু মানুষও এসবের প্রচারে ও প্রকাশে সাহায্য করছেন। তথাকথিত কিছু সুশীল, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, মিডিয়া, রাজনীতিবিদ– অনেকেই অজান্তে এমন কিছু লিখছেন বা করছেন যা প্রকারান্তরে দেশবিরোধীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে।
তাদের অনুরোধ জানাই, নিজেদের কাজের ফল একবার ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করে দেখুন। অন্যায়ের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বলে কিছু কি থাকা সম্ভব? হয় আপনি ন্যায়ের পক্ষে না হয় বিপক্ষে। আপনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে না পারলে বিপক্ষের লোক বলে বিবেচিত হবেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অথবা বিপক্ষে, এটাই সরল হিসাব। এসব ক্ষেত্রে ‘কিন্তু’, ‘তবে’ ইত্যাদির কোনো সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, অন্যায়ের ক্ষেত্রে আপনি যখন নিরপেক্ষ থাকবেন তখন প্রকারান্তরে আপনি কিন্তু অন্যায় সমর্থন করছেন।
জার্মানিসহ ১৬ট দেশে ‘হলোকস্ট ডিনায়াল ল’ আছে। এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে তারা খুব তৎপর। শুধুমাত্র জোক হিসেবে নাৎসিদের ভঙ্গিতে হাত তুলে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য শাস্তি হয়েছে একজন পর্যটকের। গ্যাস চেম্বার অস্বীকার করায় প্রখ্যাত লেখকের সাজা হয়েছে সেখানে। আর আমাদের এখানে স্বাধীনতার ঘোষণার ইতিহাসের মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে একটি বৃহৎ দল তাদের পুরো রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে। কী আশ্চর্য!
যারা এই ঘটনাগুলোর নায়ক তারা এখনও অনেকেই বেঁচে আছেন, বই লিখেছেন, বার বার সঠিক ইতিহাস বলছেন– তাও কাজ হচ্ছে না। মিথ্যাচার চলছেই। জীবন্ত সাক্ষীরা যেদিন থাকবেন না তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই মিথ্যাবাদীদের হাত থেকে কে রক্ষা করবেন? কীভাবে? এসব ভেবে ভয় ধরে যায়। সে জন্যই আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতির বিরুদ্ধে একটি আইন করে তা সুরক্ষিত করে যাওয়া খুব জরুরি।
মোদ্দা কথা হল, রাজাকারের সন্তান হোক, নব্য রাজাকার হোক বা তাদের সহযোগী– মিডিয়াই হোক বা ‘অতিনিরপেক্ষ’ সুশীল– কাউকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী কোনো কথা বলতে বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না, রাজনীতি করতে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে কনফিউশন বিএনপি তৈরি করেছে এবং তাকে পুঁজি করে রাজনীতি করছে, তার থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায়ও হতে পারে স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতির বিরুদ্ধে আইন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সকল বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এ আদর্শ টিকিয়ে রাখার বড় উপায় এ আইন।
আজ এ আইন করতে আমরা ব্যর্থ হলে সব গর্বিত অর্জনের ইতিহাস হারিয়ে যাবে। মুছে যাবে আমাদের জাতিপরিচয়, জাতিসত্তা। এখনই এ আইন প্রণয়নের পদক্ষেপ নেওয়া তাই খুব জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তাঁরা আর কত দিন আছেন আমাদের মাঝে কে জানে। ভয় হয়, শম্বুক গতিতে চলতে চলতে এই সময়টা না আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। সময় কিন্তু কারও জন্য বসে থাকে না।
ডা. নুজহাত চৌধুরী: সহযোগী অধ্যাপক (চক্ষু), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।, ( সুত্রঃ bdnews24.com, জুন ৩, ২০১৫)