নাইম আবদুল্লাহ: আজ মামলার রায় হলো। মূল অপরাধীর যাবজ্জীবন আর সহযোগী দুজনের দশবছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। পড়ন্ত বিকালে আবিদা এক কাপ চা হাতে ছাদে এসে বেতের চেয়ারটায় বসেছে। ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে সারি সারি টবে নানা জাতের ফুলের গাছ। নার্সারি থেকে নূতন জাতের ফুলের চারা কেনা, টব এনে তাতে রঙ করা, সময়মতো মাটি সার মেশানো আর পানি দেয়া তার প্রতিদিনের শখের কাজ।
আজ অনেক বছর পরে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। সে তখন ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তির জন্য কোচিং করছে। একদিন বিকালে এমনিভাবে সে ছাদে ফুলগাছে পানি দেওয়ার সময় হঠাৎ নিচের রাস্তায় ধরপাকোড় আর ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেল। কৌতুহলবশত সে ছাদের কিনারা থেকে নিচের রাস্তায় তাকাল। ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখে হজম করার মতো মানসিক প্রস্তুতি তার ছিলনা। তার মাথা ঘুরে উঠলে সে ছাদে বসে হড় হড় করে বমি করে ভাসিয়ে দিল। সবকিছু যেন নিমিষের মধ্যে তাকে নীরব সাক্ষী রেখে ঘটে গেল। পরবর্তী কিছুদিন সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলো না।
পরদিন দৈনিক পত্রিকার পাতায় বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হোল। বাড়ি সংক্রান্ত সীমানা নির্ধারণ নিয়ে পূর্ব শত্রুতার জের হিসাবে মহল্লার অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র রাশেদ নিজাম খুন হয়েছে। সে পাড়ায় নম্র ভদ্র আর ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসাবে সুপরিচিত ছিল। থানা পুলিশ হওয়ার পর অপরাধীরা ধরা পড়লেও কিছুদিনের মধ্যে আইনের ফাঁক ফোকর গলিয়ে তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। বিষয়টা আবিদার ঘুমন্ত বিবেককে নাড়া দেয়।
রাশেদ আর আবিদা একই মহল্লায় জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে। এমনকি হাইস্কুল আর ইন্টারে একই কলেজে পড়েছে। ওদের দুই পরিবারের মধ্যেও বেশ ঘনিষ্ঠ আর আন্তরিক সম্পর্ক। সুখ দুঃখে আচার-অনুষ্ঠানে বা যে কোনও আয়োজনে একে অন্যের পাশে থাকে সবসময়। ওরা দুজনে একই ক্লাসে পড়লেও রাশেদ আবিদার চেয়ে লেখাপড়া ও অন্য সব কিছুতে বেশী মেধাবী। আবিদার স্মৃতির ঝুড়িতে রাশেদকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জমা পড়ে আছে।
তখন ওরা দুজনেই প্রাইমারীতে পড়ে। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে স্বপরিবারে রাশেদরা ওদের গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার সময় সে দুটো শালিকের বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। একটি শালিক খাঁচাশসহ সে আবিদাকে দিয়ে অন্যটি নিজের জন্য রেখেছিল। তারপর দুজনেই অধির আগ্রহ নিয়ে শালিক দুটোকে কিছুটা কথা বলা শিখিয়েছিল। রাশেদ তাদের বাসায় আসলে আবিদা তার শালিকটিকে বলতো
রাশেদ আসছে।
তখন শালিকটি বলে উঠত
রিশিদ কাঁদছে।
একথা শুনে দুজনেই হাসতে হাসতে মাটিতে লুটোপুটি খেতো।
কিছুদিন পর আবিদার শালিকটি খাঁচা খোলা পেয়ে পালিয়ে যাবার সপ্তাহ খানেক পরে রাশেদের পাখিটিও উড়ে যায়।
রাশেদ খুব ভালো ক্রিকেট খেলত। কোনও টুর্নামেন্টে খেলতে যাবার আগে আবিদার কাছে এসে বলতো
এই আবিদা শোন, দু’চোখ বুজে আমার এই দুই আঙ্গুলের যে কোনও একটা ধরতো?
আবিদা প্রশ্ন করতো
কেন ধরলে কি হবে?
আরে ধরেই দেখনা তারপর বলছি। কিন্তু চোখ বুজে ধরবি।
আবিদা দু’চোখ বুজে যে কোনও আঙ্গুল ধরলে সে বলে উঠতো
ধুর, দেখিস এবার আমাদের টীম হারবে।
খেলা শেষে ফিরে এলে দেখা যেত আঙ্গুল ধরা খেলার অনুমান সত্যি হতো।
ইন্টার পরীক্ষার আগে আগে আবিদার খুব জ্বর হোল। সে পড়াশুনা আর নোট তৈরিতে পিছিয়ে পড়লো। সে দুঃখ করে একথা বলতেই রাশেদ তার সব নোটগুলি তার জন্য ফটোকপি করে এনে দিল। মাঝে মাঝে পাড়ার মোড়ে দেখা যেত ক্লাসে যাওয়ার জন্য রাশেদ রিক্সা পেয়ে গেছে অথচ আবিদা অপেক্ষা করছে। রাশেদ তক্ষুনি রিক্সা থেকে নেমে তার জন্য পাঠীয়ে দিয়েছে।
রাশেদ মারা যাওয়ার পর আবিদা মেডিকেল ভর্তির কোচিং বাদ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং শুরু করলো। সে এলএলবি অনার্সে ভর্তি হয়ে খুব মন দিয়ে পড়াশুনা করে প্রথম শ্রেণীতে পাশ করলো। তারপর মাস্টার্স করার পাশাপাশি সে সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস শুরু করলো।
ভালো ছাত্রী আর তুখড় ল’ইয়ার হিসাবে সে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চারিদিকে পরিচিত হয়ে উঠলো। ব্যারিস্টার ডঃ আজাদ বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান ক্রিমিনাল ল’ইয়ার। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিতে পেরে আবিদা নিজেকে ধন্য মনে করলো।
বছর খানেক কাজ করার পর কথায় কথায় সে ব্যারিস্টার আজাদকে তার স্মৃতিতে সযত্নে ধরে রাখা রাশেদ খুন হওয়ার পুরো ঘটনাটা খুলে বললো। ব্যারিস্টার আজাদ আবিদার সহমর্মীতায় খুব খুশি হয়ে নিজেই বিনা পারিশ্রমিকে এই মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিলো।
তারপর শুরু হোল আবিদার দিনরাত পরিশ্রম আর ছুটাছুটি। পত্রিকা অফিস থেকে সেই ঘটনার দিন থেকে পরবর্তী সংশ্লিষ্ট যত খবর ছাপা হয়েছে তা সংগ্রহ করা, সাক্ষীদের খুঁজে বের করে তাদের রাজি করানো, থানা থেকে মামলার নথি এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার রিপোর্ট জোগাড় করা ইত্যাদি।
মামলা কোর্টে উঠলো। শুনানি শুরু হোল। আবিদা নিজেও মামলার একজন অন্যতম সাক্ষী। ব্যারিস্টার আজাদ তার অন্য কয়েকজন জুনিয়রসহ কেসে লড়াই করে গেলো। শুনানি, রুলজারি, জেরা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সময় দ্রুত পেরিয়ে গেল।
সন্ধ্যার লাল আভা মিলিয়ে গেলে আবিদা ছাদ থেকে নেমে এলো। সাওয়ার সেরে হালকা বেগুনি রঙের শাড়ির সাথে মিলিয়ে বেগুনি চুড়ি আর টিপ পড়লো। চুলগুলোকে ছেড়ে পিঠের উপর ছড়িয়ে দিলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিচু হয়ে শাড়ির কুঁচির ভাজগুলো ঠিকঠাক করে সামনে পিছনে দেখে নিয়ে নিচে নেমে এসে গাড়িতে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে গাড়ি এসে শুভদের গাড়ি বারান্দায় থামলো। আবিদা সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে শুভ’র রুমের দরজায় টোকা দিলো। শুভ দরজা খুলে আবিদাকে হঠাৎ দেখে কথার ভাষা হারিয়ে ফেললো। নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞাসা করলো
কেমন আছো আবিদা?
আবিদা পাশের সোফাটায় বসতে বসতে বললো
থ্যাংক ইউ
তারপর মাথা নিচু করে মুচকি হেসে বললো
মিস্টার, আপনার অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে। আজ আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছি।
লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া আবিদার মুখ দেখে শুভ’র খুব ভালো লাগে। লজ্জার লাল আভায় আরও খানিকটা রাঙিয়ে দিতে সে কৃএিম অভিমানের সুরে বললো
মিস আবিদা অবশেষে বন্ধুর প্রতি তোমার প্রগাঢ় ভালোবাসার একটা দায়িত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হোল।
আবিদা খুব আস্তে করে নিজের মনেই বলে উঠলো
সম্পর্কটা আসলে ভালোলাগার ভালোবাসার নয়।