ক্যাম্পাসের স্মৃতি আসলে দু-চার পাতায় লিখে শেষ করা যায়না। সে অনেক কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সীমানায় রয়েছে শহীদ মিনার, কার্জন হল, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় কবি নজরুলের সমাধি, তিন নেতার মাজার, বাংলা একাডেমী, একুশে মেলা প্রাঙ্গণ, অপরাজেয় বাংলা সহ আরও অনেক উল্লেখ্যযোগ্য স্থান। বলতে গেলে সারা বাংলাদেশ থেকে একবারের জন্য হলেও এ ক্যাম্পাস ঘুরে যেতে ইচ্ছে করে সবার। ঢাকা মেডিক্যাল এবং ঢাকা শহরের অধিকাংশ কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের অধীনে থাকায় এরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্র-ছাত্রী বলে পরিচয় দিতে এখনো খুব গর্ব বোধ করে। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলতে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই মনে করা হয়।
সেদিন প্রায় ১৭/১৮ বছর পর হটাত রুমির সাথে দেখা। পুরনো দিন সামনে ফিরে এলো। অতীত যেন বর্তমানে। সেই প্রিয় প্রাঙ্গন, ক্যাম্পাস, কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, অপরাজেয় বাংলা, টি এস সি আরও কতো কি। পুরনো স্মৃতি গুলো মনের ভাঁজ খুলে বেরিয়ে গেলো এক নিমেষে। ফেসবুকের কল্যাণে আর যাই হোক বা না হোক পুরানো বন্ধুদের খুজে পাওয়ার একটা উপায় অন্তত পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রুমিদের বন্ধুদের একটি দল ছিল। সারাদিন খুব হই চৈ আর মজা করাই যেন ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মূল কারণ। আমি মোটেও আড্ডাবাজ ছিলাম না। তাই কোন দলেই আমার তেমন একটা উপস্থিতি ছিলোনা। ক্লাস শেষে লাইব্রেরী আর বিকেলে ডাকসু এই ছিল আমার আনাগোনা। আমার এই সিরিয়াস ভাব দেখে ওরা মনে মনে হাসতো তা আমি বুঝতে পারতাম। আসলে আমার এই ভাবখানা ছিল কেউ যেন প্রেমের প্রস্তাব না দেয়। তার একটা ফন্দি মাত্র। কারণ আমার আব্বা হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন এ ধরণের কোন ব্যাপার শোনামাত্র আমার পড়াশুনা বন্ধ করে দিবেন। সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে। এই বিয়ের ভয়ে যথা সম্ভব বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলতাম। হুঁশিয়ারি অবশ্য কাজে লেগেছে। প্রেমট্রেম আর করা হয়নি তবে প্রতিটি পরীক্ষায় প্লেস নিয়ে ক্যাম্পাসে স্বর্নালি সময় কাটিয়ে এসেছি। ডাকসু’তে থাকার কারণে কিছু ঘটনা এখনো খুব মনের গভীরে জীবন্ত হয়ে আছে। যখনতখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে সেই নস্টালজিক সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আবাসিক ছাত্রি হিসেবে পুরোটা সময় ছিলাম রোকেয়া হলে। কলা ভবনে’র সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ঠিক বিপরীত দিকেই রোকেয়া হল। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর কাছাকাছি হওয়ায় আমার জন্য খুব সুবিধা ছিল। বলা যায় রোকেয়া হল ছিল সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। কলা ভবনে ক্লাস শেষে বিকেলে আড্ডা দেয়া যেতো টি এস সি কিংবা ডাকসু ভবনে। আমাদের সময়ে চারটা ব্লক ছিল রোকেয়া হলে। মেইন বিল্ডিং, অনার্স বিল্ডিং, এক্সটেনশান ও নিউ বিল্ডিং ছিল ভবন গুলোর নাম। প্রথম এক্সটেনশান বিল্ডিং এর ৮১ নাম্বার রুমে সিট পাই। সেটা ছিল ডাবল এলোকেটেড সিট। অর্থাৎ অন্য একজন ঐ সিট বরাদ্দ পেয়েছেন কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাসায় থাকেন বলে পাশাপাশি আমাকেও বরাদ্দ দেয়া হয়। তাতে আমার তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। উনিই আমাকে তার সিটটা দখলে রাখার জন্য সুপারিশ করে ছিলেন। সিগ্ধা আপা ছিলেন আমার ছোট ফুফুর প্রতিবেশীর মেয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম দিকে আমি ফুফুর বাসায় ছিলাম। কিন্তু যাত্রাবাড়ি থেকে ক্যাম্পাস অনেক দুর। তাছাড়া কতো দিনই বা তার বাসায় থাকবো। তাই সিগ্ধা আপাকে বলায় তিনিই তার সিটটা আমার নামে বরাদ্দ করার বাবস্থা করেন। মাঝে মধ্যে তিনি শুধু তার জিনিষ নিতে আসতেন। বাকি সময় মূলত ছিল আমারই। আমি একা ঘুমাতে পছন্দ করি। এক অর্থে বেশ লাকি বলা চলে যে বিছানা’টা কারো সাথে শেয়ার করতে হয়নি। অথচ ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের দুজন মিলে এক বিছানা শেয়ার করতে হতো তখন।
আমাদের সময়ে গরমে হলের গেট বন্ধ হতো সন্ধ্যা সাতটায় আর শীতের সময় ছয়টায়। সন্ধ্যা হলেই ঘণ্টা পেটানো হতো গেটের ভেতর ফিরে আসার জন্য। প্রথম প্রথম কিছুদিন সে সময়েই ফিরতে হতো। পরে সাধারণ ছাত্রীরা আন্দোলন করে রাত নয়টা পর্যন্ত গেট খোলা রাখার বাবস্থা করলো। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরী বন্ধ হয় রাত নয়টায়। এ যুক্তিতে কতৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য হল। আসলে রোকেয়া হলের এতো স্মৃতি কোনটা ফেলে কোনটা লিখবো এ নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। হলে থাকলে তার ডাইনিং হলে খেতে হবে এটা ছিল নিয়ম। কিন্তু কেউ এ নিয়ম মানতোনা। প্রায় প্রত্যেক রুমেই হিটারের বাবস্থা রাখতো গোপনে।
সেইসময় ডাকসু থেকে আমরা বিকেল তিনটার যুব তরঙ্গ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতাম। এতে ছিল গান, নাটক, কবিতা সহ অন্যান্য বিষয়। একবার রেকর্ডিঙের জন্য আগারগাও রেডিও স্টেশনে যাওয়ার পথে এক মজার ঘটনা ঘটলো। সেদিন ছিল হরতাল। ক্যাম্পাস থেকে অত দুর কিকরে যাওয়া যায় তা নিয়ে চিন্তায় পরে গেলাম সবাই। পরে ঠিক হল সবাই মিলে হাঁটা শুরু করবো। যদি ঠ্যালাগাড়ী পাওয়া যায় তবে মেয়েরা ঠ্যালাগাড়ী করে যাবে। উপায়ন্তর না দেখে তাই সই। হাঁটা শুরু করলাম সবাই। কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা ঠ্যালাগাড়ী পাওয়া গেলো। মেয়েরা উঠে গেলাম সেই ঠ্যালাগাড়ীতে। ছেলেরা হাঁটছে পিছন পিছন। কিছুক্ষণ পর পিকেটাররা এসে সেই ঠ্যালাগাড়ী উল্টে ফেলে দিলো। তড়িৎ কখন যে এ কাজটা করবে ছেলেরাও বুঝে উঠতে পারেনি। কি আর করা অগত্যা হেঁটেই যেতে হলো সবাইকে।
অবশেষে এক শুক্রবার সন্ধ্যায় রুমিকে বাসায় আসতে বললাম। অবশ্য এর আগেও একবার আসতে বলেছিলাম নীপবন পল্লীর এবছরের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। খুব ঝামেলায় ছিলাম বলে সেদিন তেমন কথা হয়নি। রুমি নাটকের সাথে যুক্ত ছিল সেকথা জানা ছিলোনা। ঢাকা পদাতিকের গল্প হচ্ছিলো বলে কথা প্রসঙ্গে গোলাম মোস্তফা এবং লাভলি মোস্তফা’র কথা ও এলো। ভাবলাম ফোন করে দেখি যদি আসতে পারেন তাহলে আরও কিছু গল্প শোনা যাবে। মজার ব্যাপার হল রুমি’র সাথে উনাদের জানা শোনা আছে তা আমার মোটেও ধরনায় ছিলোনা। যাই হোক সে এক চমৎকার সন্ধ্যা। রুমি ফিলসফি ছেড়ে মিডিয়া ও সোশ্যাল চেঞ্জ নিয়ে রিসার্চ করেছে। এখানে পি এইচ ডি করতে এসেছে। কিন্তু গল্প স্বল্পে পুরোটা সন্ধ্যা ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আত্নকথন। এক পশলা বৃষ্টি যেন ঝিরঝির করে ভিজিয়ে দিলো খরতপ্ত বাস্তব সময়।