রাকিব মামার উপরে অফিস নীচে ভিডিওর দোকান। এবার দেশে এসে একদিন দোকানে বসে আছি। তখন বেলা একটার মতো বাজে। মধ্যাহ্ন ভোজের সময়। এই সময় মামার একজন ক্লায়েন্ট আসলো। ডকুমেন্টারি বানাবে এই বিষয়ে কন্ট্রাক্ট করার জন্য। মামা আমাকে দোকানে বসিয়ে রেখে ক্লায়েন্ট নিয়ে উপরে অফিসে চলে গেল।
কোন কাস্টমার না থাকায় আমি ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন মহিলার ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম,
আপনারা জন্মদিনের ভিডিও প্রোগ্রাম করেন?
কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তক্ষুনি মনে পড়লো কাল বিকেলে মামা অন্য একজনকে বলছিল যে, আমরা উইন্টার সিজেনে বড় প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় জন্মদিন কিংবা অন্য ছোট প্রোগ্রাম করার সময় পাইনা।
আমি বললাম, বড় আপা, আমরা উইন্টারে বার্থডে প্রোগ্রাম করি না। তবে আমাদের পাশের দোকানের ওরা করে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
চলেন, দেখিয়ে দেই।
মহিলা রেগে গিয়ে বললেন, প্রোগ্রাম তো প্রোগ্রামই, ছোট আর বড় কিসের? তাছাড়া আমার মেয়ের বার্থডে তে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারবো না। আর আপনি আমাকে বড় আপা বলছেন কেন? আমাকে কি দেখতে বড় আপা টাইপ লাগে? ডাকুন আপনার মালিককে ডাকুন। ফাজলামো যতসব।
আমি মাথা নিচু করে থেকে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম,
বস তো খুলনা গেছে, আবার বিকেলে আসবে? আপনি কি বসের বিশেষ পরিচিত কেউ? মহিলা এবার দ্বিগুণ রেগে বললেন,
বিশেষ পরিচিত বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? আমি কথাটা একটু ঘুরিয়ে বললাম,
এই যেমন আপনি বসের খালা, মামি, চাচি কেউ হতে পারেন। মহিলা এবার ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, যতসব রাবিশ। আমি ঢাকায় একটি নামকরা কলেজে পড়াই।
আমি বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম, ম্যাডাম আমার ভুল হয়ে গেছে। কাউন্টার থেকে বের হয়ে এসে ওনাকে চেয়ার এগিয়ে দিলাম। উনি অপমানের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে বসলেন।
আমার বার্থডে বুকিং এর কি করলেন? আপনার বসকে ফোনে জিজ্ঞাসা করেন।
প্লিজ, আমাকে একটু সময় দেন। আপনি কি খাবেন ঠাণ্ডা না গরম? আমাদের ঐ মোড়ের দোকানে ভালো কফি বানায় আপনাকে দিতে বলি?
মহিলার রাগ সম্ভবত কিছুটা কমেছে। বলল,
আচ্ছা দিতে বলেন। আমি আপনাদের এখানে কিছু সময় বসে আমার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করবো। আপনি ততক্ষনে আপনার বসকে ফোন করে বুকিং কনফার্ম করেন।
তখন আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। বার্থডে বুকিং মামাকে রিকোয়েস্ট করে রাজী করানো যাবে। কিন্তু মামা যদি মিটিং শেষ করে নীচে নেমে আসে তাহলেই কাজ সেরেছে।
আমি মোবাইল ফোনে মামাকে উপরে ফোন করলাম।
বস, বার্থডে বুকিং আছে রাখবো? মামা ওপাশ থেকে তাজ্জব বনে জিজ্ঞাসা করলো, কি বস, বস বলছো? ভাগিনা তুমি ঠিক আছো? আমি গলা নিচু করে পরামর্শের সুরে বললাম,
বস বুকিংটা রাখলাম। পার্টি বিশেষভাবে ধরেছে। মন্ত্রী কিংবা এমপির লোক হবে বোধ হয়। ওহ বস আরেকটা কথা আপনি মিটিং সেরে ধীরে সুস্থে অফিসে আসেন। ভিড় তেমন নেই। আমি এদিকটা সামলে নেবো। ওপাশ থেকে মামার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল সাইলেন্টে রেখে দিলাম।
তারপর মিষ্টি হেসে মহিলাকে বললাম,
ম্যাডাম আপনার বার্থডে বুকিং করতে বস রাজী হয়েছে। তবে সামান্য একটু মিথ্যে বলেছি। বলেছি, আপনি মন্ত্রী, এমপির লোক।
এই সব কি আজেবাজে কথা বলছেন। আমাদের চৌদ্দগুষ্ঠিতে কোন মন্ত্রী এমপি নাই।
আমি বললাম, তাতে কোন সমস্যা নেই। পত্রিকা দেখে একজনের নাম বলে দিলেই হোল। যেমন ধরেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোঃ নাসিম এমপি গতকাল খুলনায় কি একটা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। আজ পত্রিকায় এসেছে। তার নাম বলে দিলেই হোল। আর আমার বস খুলনার সব এমপি, মন্ত্রীর নাম জানে না। আর ঢাকা তো বহুত দূর।
মহিলা কি ভাবলেন জানিনা। একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
বুকিং কনফার্মের রিসিট দেন। আমি রিসিট বই খুলে বললাম,
কি নামে হবে?
শারমিন সুলতানা শম্পা
মিস না মিসেস লিখবো, ম্যাডাম
তিনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিলে তাকিয়ে বলল,
বাঙ্গালীদের এই এক সমস্যা। সব কিছুতেই আগ বাড়িয়ে কৌতূহল। আমি বললাম, সরি ম্যাডাম।
আমি ঠিকানা, সময় ও কন্ট্রাক্ট নম্বর লিখে নিলাম।
ততক্ষনে কফি এসে গেছে। আমি নিজের হাতে কফির কাপটা তার হাতে দিয়ে কাউন্টারে ফিরে গেলাম।
২০০১ সালের কথা। দেশে এসেছি বিয়ে করতে। ঢাকা, খুলনা ও আশেপাশের কোন সোর্স বাদ রাখিনি পাত্রি খুঁজতে। কিন্তু কিছুতেই মিলছিলো না। মামা প্রতিদিন সকাল বেলায় দোকানে আসার আগে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসতো। তার স্টুডিও তে অনেক মেয়ে ছবি তুলতে আসে। দোকানের সামনে দিয়ে কলেজ, ভার্সিটিতে অনেক মেয়ে যায়। একটা যদি লাইগা যায় এই ভরসায়।
আমার ছোট বোন নিফাত ও তার স্বামী মরহুম ইফতাদুল, অন্য বোন মরহুমা নাহিদ ও তার স্বামী ফরহাদ, আম্মা, আব্বা, রাকিব মামা, মামি সহ পাড়া প্রতিবেশীর কেউ বাকী ছিলনা যে পাত্রি খোজেনি।
যাহোক, ওই সময় শম্পা একদিন স্টুডিওতে ছবি তুলতে এসেছে। মামার মেয়েটা খুব পছন্দ হলো। আমি মামাকে বললাম, ঠিক আছে খোঁজ খবর করো। মামা আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নিল। আমার বায়োডাটা মেয়ে পক্ষকে দিলো। সবশেষে, দুই পক্ষের সম্মতিতে মামার স্টুডিওতে ছেলেমেয়ের সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ করা হোল।
শম্পা আমাকে জানালো, সে সিডনিতে ফোন করে শুনেছে যে, আমি সেখানে কোন ব্যাঙ্কে চাকুরী করি না। মামা প্রতিবাদ করে প্রমান দিতে চাইলে আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। মামা অনেক বুদ্ধিমান। তিনি শম্পাকে বলল,
আপনি যদি অনুমতি করেন তাহলে আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারি?
শম্পা সায় দিল। আপনার কি কারও সাথে অ্যাফেয়ার্স আছে?
সে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো। মামা বলল,
তাহলে আপনি আমাদের আগে জানালেন না কেন? আমরা তো জোর করে কিছু করতে চাচ্ছি না।
শম্পা মাথা নিচু করেই বলল, তাহলে অ্যাফেয়ার্সের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যেত। আর আমার বাবা মাও পছন্দের ছেলের কাছে বিয়ে দিতে রাজী হবে না।
মামা বলল, তাহলে ভাগিনা যে ব্যাংকে চাকুরি করে না, এই মিথ্যে কথাটা আপনি আপনার বাবা মা কে বানিয়ে বলেছেন?
শম্পা উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
মামা আমার অনুরোধে লোক পাঠিয়ে শম্পার মেয়ের বার্থডে প্রোগ্রাম করে দিলো। কয়েকদিন পর শম্পা বার্থদে’র ভিডিও ডেলিভারি নিতে মামার অফিসে এলো। মামা তাকে বসিয়ে আপ্যায়ন করলো। শম্পা কর্মচারীর বেয়াদবির কথা মামাকে নালিশ করে এই টাইপ কর্মচারীদের চাকুরী না দেয়ার পরামর্শ দিলো।
মামার নাকি তখন হাসিতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। মামা শম্পাকে চিনতে পেরে সব ঘটনা খুলে বলল। শম্পার লজ্জিত মুখ তখন নাকি দেখার মতো ছিল।
কথায় কথায় শম্পা মামাকে জানিয়েছিল, বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ভালবাসার মানুষটির সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন সে ঢাকার একটি সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করে। রূম্পা নামের ১৫ বছরের মেয়ে নিয়ে তার সংসার।
শম্পা আমার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাইতে মামাকে কয়েকবার অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু মামা বা আমি কেউই আগ্রহ দেখাইনি।