বাংলাদেশের প্রথম সরকার

বাংলাদেশের প্রথম সরকার

MujibNogor

প্রেক্ষাপট

সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বুঝতে পেরেছিলেন, তেমনি বাঙালি অর্থনীতিবিদ, আমলা, সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মোটামুটি রাজনীতি সচেতন সবাই বুঝে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর সম্ভব নয়। এরা বাংলার প্রাপ্য অধিকার কখনো দেবে না, বাংলা ও বাঙালিকে কোনোভাবে নিজের সামর্থ্যের, সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে দেবে না। সংখ্যায় ও সম্পদে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বড় বাংলা যদি কোনোভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের খবরদারি-শোষণ বন্ধ তো হবেই, উপরন্তু বাঙালিকে তার প্রাপ্য কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঘাড়ে চড়ে বসা সুবিধাবাদী সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র কোনোভাবেই তা হতে দেবে না।

দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে শোষণ-বঞ্চনায় পর্যুদস্ত বাঙালিরও সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নিজেরাই বিপুলসংখ্যায় ভোট দিয়ে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিল, আবেগে ভেসে অচিন ভাষায় ‘হাত মে বিড়ি, মুহ মে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান দিয়েছিল, সেই পাকিস্তান যদি বাঙালির কারাগার হয়ে পড়ে, কাঁহাতক সহ্য করা যায়! বাংলার মানুষ মরিয়া হয়ে চেয়েছে সেই কারাগার ভাঙতে, ঘাড়ের ওপর চড়ে বসা পরগাছা শোষক প্রজাতিকে তাড়াতে। এজন্যই তারা দলে দলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আওয়ামী লীগকে বিপুল সংখ্যাধিক্যে বিজয়ী করে এনেছে। ছেচল্লিশে ভোটকেন্দ্রে বাঙালির ঢলে পাকিস্তানের পক্ষে জোয়ার এসেছিল। সত্তরেও তাই হলো। জাতীয় পরিষদে ১৬৭ জন এমএনএ ও প্রাদেশিক পরিষদে ২৯৩ জন এমপি নিয়ে আওয়ামী লীগ পেল বাংলা ও সমগ্র পাকিস্তান শাসনের ম্যান্ডেট। এর পর শুরু হলো নানা টালবাহানা। অবস্থা বুঝে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও বাঙালি বুদ্ধিজীবী-আমলারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বাড়িয়ে দিলেন। নিয়মিত তথ্য ও মতামত বিনিময়, পরামর্শ চলতে থাকল ঘরোয়া আড্ডায়, অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে। প্রকাশ্যে তো কিছু করা যাবে না। সেই বায়ান্ন সালে বাঙালি এমএনএ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে বাংলা ভাষার পক্ষে বক্তব্য রাখায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, এসব কথা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতিকে বিপন্ন করবে। এর পর থেকে যখনই পাকিস্তানিরা বাঙালিকে নড়েচড়ে উঠতে দেখেছে, মরিয়া হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করায় যেই বাঙালি নেতাকে তারা ‘শেরেবাংলা’ খেতাব দিয়েছিল, বাংলার অধিকারের পক্ষে কথা বলায় তাকেই তারা ‘বেইমান’ বলে গাল দিয়েছে। বাঙালির আরেক নেতা সোহরাওয়ার্দীকে তারা জেলে পুরেছে। এদের চেয়ে তরুণ বাঙালি নেতা, যাকে ইস্কান্দার মির্জা সেই চুয়ান্ন সালেই ‘মানুষকে ক্ষেপাতে পটু, বিপজ্জনক লোক’ বলে বর্ণনা করেছিল, সেই শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা বারবার কারাগারে পাঠিয়েছে। বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকারের দাবি উঠায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে মামলা করেছে। কাজেই আলাপ-আলোচনা, শলা-পরামর্শ সব করতে হবে গোপনে। কোনোভাবেই বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ নেয়া যাবে না। তাছাড়া ক’বছর আগে নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রা নামে যে সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছে, তার কপটতা বিশ্বজনমতকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শব্দের ব্যাপারে আরো স্পর্শকাতর করে গেছে। সুতরাং পুরোটাই সারশূন্য জেনেও ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা নামের প্রহসনে অংশ নিতে হবে। পাকিস্তানিদের নতুন কোনো ছুতো ধরার সুযোগ দেয়া যাবে না।

সরকার যখন অবশ্যম্ভাবী

আলোচনার আড়ালে নিজেদের প্রস্তুতি পুরোপুরি শেষ হলে কেটে পড়েন ইয়াহিয়া খান। একদিন পর রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পূর্ণশক্তির পাকিস্তানি বাহিনী। বাঙালি নেতৃত্বের আশঙ্কা এখানেও সত্যি হয়। সভ্যতাকে লজ্জা দেয়া এই কাপুরুষতাকে তারা প্রথামাফিক ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দেয়। ভাবখানা এমন যেন, ‘কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে অভিযান’। বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা, স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, রাজনৈতিক সংগঠক, পুলিশ বিভাগ ও সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালিরা তাদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতকারী’। যার ধমনিতে বাঙালির রক্ত, সে কি এই প্রবঞ্চনায় নীরব থাকতে পারে। আগে থেকেই বাঙালি নেতারা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার কথা বলে গেছেন। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি প্রতিরোধের কথা বলেছেন। তাই কিছুটা প্রস্তুতি ছিলই। সময়ের প্রয়োজনে অন্যরাও যার যার মতো সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জাতির এমন কঠিন সময়ে তার অবর্তমানে এবং নিয়মিত ও সুশৃঙ্খলিত কোনো সেনাবাহিনী না থাকায় ততক্ষণ পর্যন্ত এদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ চলতে চলতেই ধীরে ধীরে গড়ে মুক্তিফৌজ। কিন্তু এমন বিশৃঙ্খল ও অসংগঠিতভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে সেটা লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো গতিই থাকে না। বিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা এসব সশস্ত্র যুদ্ধের একটি পরিচয় যেমন দরকার, তেমনি নির্দিষ্ট নেতৃত্বও জরুরি। অন্যথায় পাকিস্তানিরা একে বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই বলে অভিহিত করবে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা শুরুর পরদিনই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাই চলমান লড়াই বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ। কিন্তু নির্দিষ্ট নেতৃত্ব ও সুবিন্যস্ত নির্দেশনা কাঠামো না থাকলে চূড়ান্ত বিজয় যেমন অধরা থাকবে, তেমনি পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ববিবেককে জানানোও সম্ভব নয়। একদিকে প্রচণ্ড আবেগ আর মনোবল, অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্যতা— সব মিলিয়ে অবস্থা যখন অবনতির সন্নিকটে, ঠিক তখনই অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধে বয়স ১৫ দিন হতে না হতেই ১৯৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদের সদস্যরা মিলে ১০ এপ্রিল গঠন করেন মুজিবনগর সরকার। এ সরকারকে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ভাগ করা হয়।

একটি বাড়ি

মার্চের ৭ তারিখের আগে থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি দেশ-বিদেশের কৌতূহলী মানুষ ও সংবাদকর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ৭ তারিখে রেসকোর্সে ভাষণ দেয়ার পর থেকে যেন জনতার ঢল উঠে ওই বাড়ির সামনে। প্রতিদিন সকাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ কৌতূহলী মানুষও তাদের আগ্রহের, ভালোবাসার ‘শেখ মুজিবকে’ দেখতে ওই বাড়ির সামনে জড়ো হতো। ৩২ নম্বরে রীতিমতো কয়েকটি চা-নাশতার দোকান বসে যায় এসব মানুষের চাহিদা মেটাতে। মার্চের ২৪ তারিখ বঙ্গবন্ধু তার ঘনিষ্ঠ সহচর এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে অন্যত্র নিরাপদ ও নির্দিষ্ট স্থানে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, যথাসময়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হবে। ২৫ ও ২৬ মার্চের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আর দেখা করতে পারেননি তিনি। অবশেষে ২৭ মার্চ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঝিনাইদহে যান। সেখানকার এসডিপিও মাহবুব আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। মার্চের ৩০ তারিখ পশ্চিমবাংলা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২ এপ্রিল তিনি দিল্লি যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিদের নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে এক অধিবেশন আহ্বান করেন। এ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এ মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিরা ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে। শত শত দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের উপস্থিতিতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।

আম্রকানন আখ্যান

নবাবের সিপাহসালার মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতা ও চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের কারণে যেখানে ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন কোম্পানি বাহিনীর হাতে বাংলার স্বাধীনতা পরাভূত হয়েছিল, পলাশীর সেই জায়গাটি ছিল আম্রকানন। নবাবের বাহিনী যুদ্ধে হেরেছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আরেক আম্রকাননে উদিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। এবারে শঠতা নয়, প্রত্যয়ের গল্প। দখলদারী প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র নয়, দখলদার তাড়ানোর দৃপ্ত অঙ্গীকার ঘোষিত হলো মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা আমবাগানে। কালক্রমে বৈদ্যনাথতলার নাম পাল্টে মুজিবনগর রাখা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই প্রথম সরকারটিই মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। মুজিবনগরের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বছর ধরে বাংলার মানুষ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব অধিকার নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করবই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই।’

প্রশাসনের পথ চলা

মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম আইনটি জারি করেন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ ১৯৭১’ শিরোনামের এ আইনে বলা হয়, ‘আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণায় আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল, সে সমস্তই প্রয়োজনীয় অবস্থানগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘোষণাসাপেক্ষে বলবত থাকবে এবং সকল সরকারি, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসামরিক, সামরিক, বিচার বিভাগীয়, কূটনৈতিক যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তাঁরা সকলেই তাঁদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তাঁরা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।’

উপরোক্ত আইনটি পাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার প্রজাতন্ত্রে কর্মরত আমলা ও অন্যদের জন্য স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার পথ সুগম করেছিল।

থিয়েটার রোড

মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বলা যায় ‘বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা’। কলকাতার থিয়েটার রোডের একটি বাড়িতে কাজ শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

সেখানেই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন মানুষ হাল ধরেন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক ভাগ্যের। থিয়েটার রোডের পুরানো এই বাড়ির সামনের মাঠের মাঝখানে বড় একটা পুরোনো বটগাছ। দালানে বড় বারান্দা পার হলেই মস্তবড় একটা হলঘর। ঐ হলঘরে ঢোকার আগে বারান্দার সাথে দুইদিকে দুটো কক্ষ, মাঝারি মাপের। একপ্রান্ত থেকে উপরে উঠে গিয়েছে প্রশস্ত সিঁড়ি। বারান্দা থেকে করিডোর দিয়ে ঢুকলে বাঁ-দিকের কামরাটি ব্যবহার করতেন সচিবরা এবং তাদের সহকারীবৃন্দ। আর ডানদিকের করিডোর দিয়ে গেলে ডান ও বাম উভয় পাশে দুটো মোটামুটি ধরনের ঘর। ডানদিকে কর্নেল ওসমানী ও তাঁর এ.ডি.সি., বাঁ-দিকেরটি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য সংরক্ষিত। মন্ত্রিপরিষদ সভাও মতো এই কক্ষটিতে। বড় হলঘর অতিক্রম করে সমুখে এগিয়ে গেলেই হাতের বামদিকে মোটামুটি বড় একটা কক্ষ, সংলগ্ন বাথরুমসহ। এই কক্ষটিতে থাকতেন প্রধানমন্ত্রী। একদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, লুটপাট ও স্বাধীনতার সপক্ষের নেতাকর্মীদের আত্মগোপন। আরেকদিকে সামরিক অস্ত্রে সজ্জিত ও শৃঙ্খলিত পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার স্বপ্ন বাস্তবায়ন— সব মিলিয়ে চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এ মুজিবনগর সরকার। বিরাট অসাধ্য সাধন করে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের অন্যতম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, উপ-সেনাপতি একে খন্দকার, চিফ অব স্টাফ কর্নেল আব্দুর রবসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা গোটা দেশের যুদ্ধরত অঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতিটিতে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন। এছাড়া মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স, মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্স ও মেজর কেএম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স গঠন করা হয়। প্রতিনিয়ত এ সেক্টরগুলো কোথায়, কীভাবে, কোন রণকৌশল নিয়ে এগোবে এবং তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ দিয়ে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা-সাহায্য করার যাবতীয় নীতি পরিকল্পনা করেছে এই মন্ত্রণালয়। যুদ্ধের সপক্ষে আন্তর্জাতিক পক্ষ তৈরি ও পাকিস্তানিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেখেছিল এক অনন্য নজির। যুদ্ধের সময় বিদেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে বহির্বিশ্বের সরকার ও জনগণেরর সমর্থন আদায়ে নিরলস পরিশ্রম করেছেন এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। এ লক্ষ্যে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, স্টকহোমের মতো জায়গায় কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা হয়— এমনকি আফগানিস্তান, সিরিয়া-লেবানন, নেপাল, শ্রীলংকা, বার্মা, জাপান, থাইল্যান্ডের সমর্থন আদায়ে পর্যন্ত কূটনৈতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা হয়েছিল এ মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনায়। এছাড়া যখন জীবন সংশয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি, তখন তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানকে সার্বক্ষণিক চাপে রাখার ক্ষেত্রে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে এ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাঠানো হতো। পররাষ্ট্র দফতর অবস্থিত ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাসের বাংলাদেশ মিশনে। এর পর আসা যাক অর্থ মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে। অর্থ বিভাগ এই সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে। যেমন সরকারের আয়-ব্যয়ের বাজেট তৈরি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উত্স থেকে প্রাপ্ত সম্পদের হিসাব তৈরি, বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, রাজস্ব ও শুল্ক আদায় এবং যে কোনো ধরনের আর্থিক অনিয়ম রোধের জন্য এ কমিটি দায়িত্ব নিয়েই তার কাজ করে গেছে। এমনকি প্রথম ছয় মাসের আয়-ব্যয়ের জন্য একটি বাজেটও তৈরি করেন তারা। এ সময় দেশের ভেতর থেকে প্রাপ্ত অর্থ সংরক্ষণের জন্য ট্রেজারি স্থাপন করা এবং প্রবাসী বাঙালি-বিভিন্ন বিদেশী নাগরিক ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অর্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড নামের তহবিলও গঠন করা হয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয়ে যেন কোনো ধরনের অসামঞ্জস্যতা বা ভুল না থাকে সেজন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।

সুত্রঃ ( বনিক বার্তা )