ক্লিক

ক্লিক

সোডিয়াম আলোর কাছে হার মানা অন্ধকার চিরে রাজকীয় প্রাডোখানা ছুটে চলেছে নিত্যকার মত ক্লাবের দিকে-  ক্লাবের কাছাকাছি আসতেই আবারো মঞ্জুর মেহদির মুঠোফোন বেজে উঠে। বাসা থেকে রুমার ফোন-  সেই আবার একই তাগিদ –

-তুমি কোথায়?

-এইতো ক্লাবের কাছাকাছি

-তোমাকে না বাসায় আসতে বললাম

– ক্লাব সেরে বাসাতেই তো আসব…

– না, তুমি এখুনি বাসায় এসো

-আচ্ছা কি ব্যাপার বলবেতো… এত জরুরী তলব কেন ? আমার একটু কাজ ছিল…

– তোমার জরুরি কাজ তো সেই ক্লাবে, ও আমার জানা আছে । আজ ক্লাবের কাজ করতে হবে না, বাসায় এসো সত্যিকারের জরুরী কথা আছে।

-ঘন্টা খানেক পরে আসি ?

না, তোমার ঘন্টা খানিক মানে কি, আমি জানি। তুমি এখুনি এসো। আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, রুমা ফোন কেটে দেয়।

মঞ্জুর মেহদি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকে গম্ভীর হয়ে ড্রাইভারকে বাসার দিকেই যেতে বলে। আজ আর ক্লাবে যাওয়া হবেনা। ভাবতেও মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠছে। আবার রুমার ডাক উপেক্ষাও করতে পারছে না। মনে মনে ভাবে রুমা ত আজ বহু বছর হয় তেমন কোন ব্যাপারেই মঞ্জুরকে ফোন করে না। তাদের মধ্যে কথা বার্তাও প্রায় হয়না বললেই চলে। কাজেই ফোন করাকরি ওদের মধ্যে হয়ই না। খুব দরকার পরলে মঞ্জুরই ফোন করে, সেটাও খুব কদাচিৎ। তেমন একটা প্রয়োজন হয় না।

আজ আবার হঠাত কি হল ! বেশ কদিন ধরেই রুমা যেন অতিরিক্ত থমথমে হয়ে আছে। মনে হয় রুমার শরীরও ভাল যাচ্ছে না। গত সপ্তাহ খানেক ধরে সে ঘরে শুয়েই থাকছে, একদিন মনে হয় বমি করার শব্দও কানে এসেছিল। কাজের লোকটাও একদিন বলছিল ম্যাডামের শরীর ভাল না।

কিন্তু তাতে কি, ফ্যামিলি ডকটর, গাড়ী, ড্রাইভার, ব্যাংকের কার্ড যা যা লাগে সব তো রুমার কাছেই মজুদ, মঞ্জুরের কাছে দরকার কি !

ধুর, এসব মান্ধাতা মার্কা, আন্টি মার্কা মেয়েদের নিয়ে যত সমস্যা। নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে যত্ত প্রবলেম ক্রিয়েট করা। আজকের সন্ধ্যাটা মাটি হয়ে গেল।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ি এসে দাড়ায় শহরের পশ এলাকার অত্যাধুনিক এক অট্টালিকার সামনে। সিকিউরিটি গেট খুলে দিলে গাড়ী ঢুকে যায় অন্দরে ।

ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেই ছিল রুমা। মঞ্জুর ঘরে ঢুকে কিছু বলার আগেই রুমা মৃদুস্বরে বলল- বস ।

রুমার এই প্রবল গভীর ব্যক্তিত্তের কাছে মাঝে মাঝে মঞ্জুরের মত মানুষও কিছুটা  ম্রিয়মাণ হয়ে যায়।

মঞ্জুর বসে বিরক্তি, উদ্বেগ ঢেকে রেখে হালকা ভাবে বলার চেস্টা করে

-কি হয়েছে ?  বাড়িতে  ডাকাতও পড়েনি, আগুনও লাগেনি, তুমিও বহাল তবীয়তে আছ, তো এভাবে আমাকে আর্জেন্ট ডেকে আনার মানে কি ?

রুমা এসব কথার ধার দিয়েও গেল না। বলল

-বস, একটু সুস্থির হয়ে বসে আমার কটা কথা শোন।

-তোমার হাতে ওগুলো কিসের কাগজ ?

-বলছি…

এই বলে রুমা যেন একটু দম নেয়। তারপর শুরু করে –

-আমি এখন তোমাকে কিছু জরুরী কথা বলব, বাচ্চারা ওদের ঘরে আছে পড়ছে, বা খেলছে, আর নাহয় কম্পিউটারে বসে আছে। চিৎকার করনা, কেবল শুনে যাও।

-আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ ১৪ বছর হল। আমাদের দুটি যমজ বাচ্চা, ওদের বয়স হয়ে গেল প্রায় ১২ বছর। ওরা যখন জন্মালো আমরা দুজনই খুব খুশি হয়ে ছিলাম তুমি হলে বাবা, আমি হলাম মা…  মঞ্জুর কি একটা বলতে গেলে রুমা বলল

-আমাকে শেষ করতে দাও, তাছাড়া আজ আমি কিছু শোনার জন্য বসিনি, কেবল বলতেই বসেছি। দাম্পত্য জীবনের পুরোটা সময় তুমি শুনিয়েছ, আমি শুনেছি । তুমি ডিসিশন নিয়েছ আমি মেনে নিয়েছি…  সংসারটা যে যৌথ এটা কখনই তোমার মনে হয়নি। আজ কেবল আমিই বলব।

হ্যা, তুমি ঠিকই তোমার মত করে ওদের বাবা হলে কিন্তু আমার মা হওয়া হল না। তুমি হতে দাওনি। তুমি ওদের টিউনিং করে করে তোমার মন মত করে গড়ে তুলছ।  ওদের জন্মের পর আমি তোমাকে প্রস্তাব দিলাম যে ওদের নাম প্রিয়ম  ও প্রিয়ন্তি রাখলে কেমন হয়। তুমি রাখলে তো নাই উল্টো আমাকে বললে- ওসব প্যানপ্যানানি ছাড়ো । আমি ছাড়লাম। তুমি ওদের নাম রাখলে- পিটার এবং মার্টিনা। তুমি ওদের ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করালে, পছন্দ না হলেও আমি কিছু বলিনি।

কিন্তু তুমি দেশে থেকে ওদের বিদেশী কালচারে বড় করতে লাগলে- এ নিয়ে তোমার সাথে আমার বহুবার বহু বাকবিতন্ডা হয়ে গেছে। আমার কথা সামান্যতম আমলেও তুমি নাওনি। সংসারের আর সব বিষয়ের মত এখানেও তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটল রইলে। সব কিছুতেই তোমার পৌরুষ, ক্ষমতা আর টাকার বড়াই।

ওরা বড় হচ্ছে এক জগা খিচুড়ি কালচারে। তোমার মত ওরাও মায়ের গ্রাম্যপণায় হাসে। তুমি ওদেরকে শিখিয়েছ মা গাইয়া, মা মান্ধাতা আমলের রুচির মানুষ, আধুনিকতা বোঝেনা। ওরা পুরোপুরি এখন এক অদ্ভুত লাইফ স্টাইলে বড় হচ্ছে। খাওয়া, পোষাক, শিক্ষা, আদব কায়দা, চলাফেরা, সবকিছু । মাকে তারা থোড়াই কেয়ার করে।

আমি কাজ করি যে কলেজে, তুমি সেখানে বড় এমাউন্টের ডোনেশন দাও, আবার আমাকে সব সময় বল যে তোমার ডোনেশনের জন্যই নাকি আমি সেখানে পড়াতে পারি। তাহলে আমি যে এত বড় ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী নিয়েছি, তার কি কোনই দাম নেই! আমার পারদর্শিতার কি কোন মুল্য নেই!

তুমি তোমার বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত থাক, ভাল । এর বাইরে তুমি আর কি কি করে বেড়াও তাও আমি জানি। সেসব আমি… হাত তুলে মঞ্জুর বলে

– আর আমি কি করে বেড়াই? তুমি কি কি জান ?

-তুমি খুব ভালভাবেই জান, আমি কি জানি। সেসব আমি উচ্চারণ করতে চাইনা।

-না, কথা যখন তুলেছ তোমাকে বলতে হবে, তুমি কি কি জান। ভেতরে ভিত একটু টললেও কণ্ঠস্বর ঝাঁঝালোই রাখে মঞ্জুর।

– দেখ আমি খুব বেশি কথা তোমায় বলতে চাচ্ছিলাম না, আমার হাতে সময়ও  নাই।  ঠিক আছে যখন শুনতেই চাইছ অতি সংক্ষেপে বলি- তুমি রাজশাহীতে কাজে যাও সেখানে তোমার যে অঙ্কশায়িনী আছে তার নাম- পিয়া। টঙ্গিতে আছে- পলি।  দাড়িওয়ালা হাঁদারাম ইঞ্জিনিয়ারের বউ তো আছেই, এছাড়াও একদম লেটেস্ট হচ্ছে- সোমা।

মঞ্জুর মূক, একটা কথাও বলে না। মনে মনে ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায়। চুপচাপ স্বভাবের উদাসীন এই নারী যে বুদ্ধি রাখে এটা জানত মঞ্জুর, এবং সেজন্যই আরো পায়ের তলায় তাকে  দাবিয়ে রাখত, কিন্তু হারামিটা এতটা বুদ্ধি রাখে জানত না। আরো যে কি কি জানে, কে জানে…  স্বেচ্ছাচারী,  ক্ষমতাবান প্রচন্ড দাম্ভিক মঞ্জুরের যেন স্বর ফোটে না, কোনওক্রমে ঢোক গিলে কিছু বলতে যায়, তার আগেই রুমা আবার বলে উঠে-       –

-এসব বিষয় জানার ইচ্ছে বা রুচি কোনটাই আমার নেই, যা বলতে চাচ্ছি তা শোন,  আমার হাতে তিনটি কাগজ আছে, এগুলি আমি তোমাকে এক এক করে  দিচ্ছি,

তুমি যে তোমার প্রপার্টির বেশ কিছু আমার নামে করেছ, ট্যাক্স ফাঁকি দিতে, বা  অন্য যে কারনেই হোক যা কিছু করেছ, এই যে সাদা কাগজে আমার সই করা থাকল তুমি ওসব নিজের মত ঠিকঠাক করে নিয়ো। আবার মনে করনা সাদা কাগজের সই দিয়ে তুমি আমায় কোন বিপদে ফেলবে। খুব ভাল ভাবে জেনে রাখ তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না।

এই হচ্ছে কলেজের রেজিগনেশন লেটার এটা তুমি ওদেরকে দিয়ে দিও।

আর এই তিন নম্বর কাগজটি হচ্ছে- একটি প্যাথলজির টেস্টের রিপোর্ট। মঞ্জুর জিজ্ঞেশ করে-

-কিসের টেস্ট ?

-হ্যাঁ বলছি, আজ পাঁচ বছর আট মাস একুশ দিন হয় তুমি সম্পুর্ণ বিনা কারণে, অযৌক্তিক ভাবে আলাদা রুমে ঘুমাও । আমাদের রুমে আমি একাই ঘুমাই, তোমার রুমে তুমি, বাচ্চারা তাদের রুমে। এই দীর্ঘ বছর মাস দিন আমি একটি রাতও দরজা লক করিনি, প্রতীক্ষায় ছিলাম তুমি ভুল বুঝতে পারবে, বউয়ের কাছে ফিরবে। তুমি ফেরনি। তুমি বিয়ের পর থেকে প্রতিটি ব্যাপারেই বলেছ- আমার ভিক্টোরিয়ান মানসিকতা এই সেঞ্চুরিতে বেমানান । সেই ভিক্টোরিয়ান মানসিকতা থেকেই তোমায় জিজ্ঞেশ করি-

-বিধবা না হয়েও কেন আমি বৈধব্যের জীবন কাটিয়েই যাব বলতে পারো?

একটু থেমে মঞ্জুরের চোখে চোখ রেখে আরো শান্ত গলায় প্রতিটি শব্দে জোড় দিয়ে রুমা উচ্চারণ করে  –

-তুমি বলতে পারো আমি কি নিয়ে জীবন কাটাই? কিভাবে প্রতিটি রাতে মরে গিয়ে প্রতিটি দিন বাঁচি ? এই কাগজটি প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছ?  হ্যাঁ ওটা আমার টেস্টের রিপোর্ট। পজেটিভ। তোমার ফ্যামিলি ডঃ হয়তো কিছুক্ষণ পরেই তোমাকে কংগ্রাটস করবে। কংগ্রাচুলেশন গ্রহন করবা কিনা সেটা  তোমার ব্যাপার তুমি জান- বিদ্রূপ ছুড়ে মারে রুমা। হঠাত প্রতিটি মুহুর্তকে যেন অনন্ত মনে হয় মঞ্জুরের, সময় যে এত প্রলম্বিত হতে পারে, মঞ্জুরের ধারনাই ছিল না। জীবনের প্রথম মঞ্জুরের মনে হয়- সে যেন হেরে যাচ্ছে। প্রচন্ড পরাজয়ের এক শক্ত লৌহ জাল ওকে আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। আঙুরলতার মতো লতানো এক তুচ্ছ নারী লৌহজাল হয়ে যাবার ক্ষমতা রাখে !

-আমার জমিনে এবার স্বেচ্ছায় বীজ বপন করেছি  ফসল তুলব একা আমি, নিজের গোলায়। এবারের ফসল শুধুই আমার। যৌথ তো হলনা, এবার একা একবার চেস্টা করে দেখিনা জীবনটা কেমন হয়। কিছুটা থেমে গিয়ে আবার বলে-

-আর কিছুক্ষণ পরেই আমার ট্রেন। আমার নিত্য ব্যবহার্যের সামান্য কিছু জিনিস আর আমার সনদ গুলো ছাড়া আমি আর কিছু নেইনি, ইয়াসিন মিয়া আমাকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

বলেই সে চুপ করে যায়। রুমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে যেন পুরো জায়গাটায় নিস্তব্ধ এক শীত নেমে আসে।  কথা শেষ করে কাগজ গুলি কাঁচের টেবিলের উপর রেখে পৃথিবী সদৃশ্য সুন্দর ক্রিস্টালের পেপারওয়েট তুলে চাপা দিতে গেলে সেটি রুমার হাত থেকে  পিছলে মেঝেতে পরে দু টুকরো হয়ে  দুদিকে চলে যায়। রুমা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে, তার ঠোঁটের কোনায় একটু বিষাদময় হাসি ফুটে উঠে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।

সে খুব সাবলীল ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে ঘরে ঢুকে এই প্রথম দরজা লক করে দেয়- পিনপতন নিস্তব্ধ জায়গাটিতে কেবল ধাতব এক ভোঁতা শব্দ হয়-

“ক্লিক” ।

কাজী লাবণ্য