বাক্সের ভিতর টুকটুকে লাল একটা টুপি, একজোড়া মোজা , একটা সোনার নাকফুল আর একজোড়া সোনার কানের রিং ।আর আছে সাদা একটা খাম।
এক ঘর গিজগজ মানুষের মধ্যে তা হাতে নিয়ে ঠায় বসে আছে নিশাত চৌধুরী। নিষ্পলক চোখে পাথর কাঠিন্য। দু একজন তাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছে… কিন্তু তার ভাবলেশহীন মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই আদৌ কথাগুলো তার কান পেরিয়ে মগজে ঢুকছে কিনা! এই ঘরভরা মানুষের কাতারে সাংবাদিক আছে, পুলিশ আছে, উৎসুক প্রতিবেশীরা আছে। আছে আত্মীয় স্বজন। কেউ একজন এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন নিশাতের দিকে । কয়েক চুমুক পানি খেয়ে দম নিলেন নিশাত । এরপর বললেন, বলেন কি জানতে চান ? অনেকগুলো কণ্ঠ হৈ চৈ উঠলো একসাথে । কেউ একজন একটু চেঁচিয়ে বললেন – আরে বাবা, একজন একজন করে বলেন না !
সাংবাদিকরাও কম যান না, অল্পবয়স্ক মতো একজন বললেন, দাদা এলফাবেটিক্যালি শুরু করি তাইলে কি বলেন ? “এ” দিয়ে কার কার নাম, হাত তোলেন ! মৃদু হাসির রোল উঠলো চারদিকে !
নারীকণ্ঠ থেকে বেশ দৃঢ় গলায় একটা প্রশ্ন আসলো, আসলে এই প্রশ্নটা বোধয় সব প্রশ্নের সমন্বয় – ম্যাডাম, এই পরিস্থিতিতে আপনি আমাদের সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছেন, আপনাকে ধন্যবাদ । আপনি আমাদেরকে সেটুকুই বলেন যেটুকু আপনি স্বেচ্ছায় বলতে চান !
নিশাত ভাবছেন, আসলে কথা শুরু করবেন কোথা থেকে?
১৯৯৭ সালের জানুয়ারী মাসের কনকনে সকালে শ্রীমঙ্গলের বাংলোতে রেশমী তার পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে কানতে কানতে বলেছিলো, মা আমার এখন কি হবে ? আমার তো সব শেষ !
– হয়েছে কি? এই রেশমী, উঠে দাঁড়া …
– মা লক্ষণ নাই .. লক্ষণ আর নাই ..বলতে বলতে মূর্ছা গেলো রেশমী !
চাকর বাকর মারফত জানলেন নিশাত, লক্ষণ এর লাশ পাওয়া গেছে মন্দিরের পাশে, লোকে বলছে সাপে কেটেছে । পায়ে সাপের কামড়ের ক্ষত, শরীর নীল। লক্ষণ নিশাতদের গরুর রাখাল । পাশাপাশি বাগানের টুকটাক কাজও করে । বাংলো থেকে ১০ মিনিটের হাঁটাপথে ছোট্ট একটা ঘরে থাকে এই দম্পতি। রেশমী জাতে উঁচু । লক্ষণের সাথে ওর এই প্রেমের বিয়ে তাই মানেনি ওর পরিবার । ওর প্রভাবশালী ভাইয়েরা হুমকি দিয়েছিলো দেখে নেবে ।বছর খানেক আগে রেশমীকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো লক্ষণ । একেবারে সোজা নিশাতের সামনে এনে বলেছিলো প্রণাম কর রেশমি । মা থাকতে তোর কোনো ভয় নাই । আমি থাকি বা না থাকি, মা তোকে রক্ষা করবেন!
সেই থেকে রেশমিও নিশাতকে মা ডাকতো, টুকটাক কাজের ছুতোয় প্রতিদিন আসতো বাংলোতে । একদিন জানালো তার সন্তান হবে ! মেয়েটার মায়ায় ভালোবাসায় নিশাত এতটাই মুঘ্ধ ছিলেন যে প্রায় প্রতিদিন ই রেশমীকে ভালো মন্দ খেতে দিতেন । মাঝে মাঝে ওর শরীর খারাপ থাকলে নিজের কাছেই রেখে দিতেন বাংলোতে ।
দিনক্ষণের হিসেব অনুযায়ী জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহেই রেশমির ডেলিভারীর কথা ছিলো ।তাই নিজ হাতে লাল টুকটুকে একটা টুপি আর মোজা বুনে রেখেছিলেন নিশাত। এমন সময় এমন একটা বিপদ ! ঠিক বুঝতে পারছিলেন না কি করণীয় । তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে পাঠালেন মালীকে ।
এর মধ্যে বয়স্ক দারোয়ান সুরুজ জানালো লক্ষণের নাকি মাঝে মাঝে নেশা করার তাল উঠতো । এ নিয়ে রেশমীর কম আপত্তি ছিলো না । লক্ষণ কথা দিয়েছিলো বাবু হবার পরে ওসব আর ছোঁবে না । গতকাল রাতে সম্ভবত লুকিয়ে লুকিয়ে পুরোনো মন্দিরটার ঐদিকে নেশা করতেই গিয়েছিলো । হয়তো নেশার ঘোরে বেহুঁশ হয়েও থাকতে পারে !
রেশমীর নাড়ী পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন ওকে দ্রুত হাসপাতাল নেয়া দরকার । অবস্থা বেশী সুবিধার না । থেকে থেকে খিঁচুনি দিচ্ছে ও ।
ক্যামন ক্যামন করে যেনো সবকিছু জোগাড় হলো । নিশাত উর্দ্ধশ্বাসে ছুটলেন এম্বুলেন্স এর পেছন পেছন । নিজের গাড়িতে । সদর হাসপাতালে পৌঁছানো মাত্রই জানানো হলো এক্ষুনি অপারেশন করে বাচ্চা বের করতে হবে ।বাঁধলো আরেক বিপদ ! নানান প্রশ্ন । রোগী আপনার কে হয় ? রোগীর স্বামী আত্মীয় স্বজন কৈ ? কনসেন্ট ফর্মে কে সই করবে !
নিশাত দেখলেন স্ট্রেচারে শোয়ানো রেশমীর জিভ ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে আধখোলা চোখে শুধু বলছে আম্মা, আপনি আমার সবকিছুর জিম্মাদার । আমার এই কানের দুল আর নাকফুল আমার বাবু কে দিবেন আম্মা ! আমার বাবুকে আপনি দেখবেন আম্মা ….
নিশাত ধমকে উঠলেন, এই রেশমি, তোর কিছুই হবে না । শান্ত হ ।
রেশমীকে বললেও নিজেই শান্ত থাকতে পারছিলেন না নিশাত । কি থেকে যে কি হয়ে গেলো ! এ কি পরীক্ষার মধ্যে পড়লো রেশমি ? বয়স খুব বেশী হলে ১৭ বছর । এর মধ্যেই এই অবস্থা ? তাছাড়া নিশাতের স্বামী আনোয়ার চৌধুরীরও বদলি হয়ে যাবার কথা মাস কয়েক পরে । এরপর এই পদে কে আসবেন, রেশমীকে এই কঠিন বাস্তবের সাথে লড়াই করতে কে সাহায্য করবে এসব ভাবতে ভাবতেই একজন নার্স দেবশিশুর মতো একটা বাচ্চাকে তোয়ালে মুড়ে নিশাতের হাতে দিলেন । নিশাত এই প্রথম সদ্যজাত কোনো বাচ্চা কোলে নিলো ! আহা ! কি স্বর্গীয় একটা গন্ধ শরীরে । বাচ্চাটা থেকে থেকে ট্যা ট্যা করে কান্না করছে । আহারে ! খিদা লেগেছে বুঝি ! দীর্ঘ ১৫ বছরের বিবাহিত জীবন নিশাতের । নিজের কোলে এমন একটা সন্তানই তো চেয়েছিলো ও ! চিকিৎসা শাস্ত্রে আনএক্সপ্লেইন্ড ইনফার্টিলিটি বলে একটা টার্ম আছে । আনোয়ার নিশাত দম্পতি এর শিকার । দৃশ্যত কারো কোনো সমস্যা না থাকলেও সন্তান হয়নি তাদের । ব্যাপারটা একরকম মেনে নিয়েই তাদের জীবন কাটছিলো । খুব যে খারাপ কাটছিলো তাও না । আনোয়ার চৌধুরীকে ব্যাপারটা নিয়ে কখনোই খুব বেশী বিচলিত মনে হয়না । টুকটাক কষ্ট যা, তা নিশাতের ই !
-আপনি কি নিশাত চৌধুরী ?
– জ্বী, ডাক্তারের কথায় চমকে ওঠে নিশাত ।
– পেশেন্ট আপনার কে হয় ?
– আমার দূর আত্মীয়, ক্যানো বলেন তো ?
– আমরা ওনাকে বাঁচাতে পারিনি । এক্লাম্পশিয়া থেকে অর্গান ফেইলিউর কোনোমতে বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেছে তবে ওর ও কিছু পরীক্ষা করানো দরকার …….
(—–চলবে —–)