ফজলুল বারী:একজন বাপ্পী মারা গেছেন। সমস্যা বলা হয়েছে নিউমোনিয়া আর শ্বাসকষ্ট। চারদিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এরপর বৃহস্পতিবার মারা গেছেন বাপ্পী। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী। তিনি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবং সহকারী এটর্নি জেনারেল ছিলেন। পরপর দু’বার সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন জাতীয় সংসদের। সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছিলেন খুব। নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার মঙ্গল কামনা করতেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকে কান্নায় ভেসে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিড। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। জাতীয় সংসদের দক্ষিন প্লাজায় তাঁর নামাজে জানাজার পর রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত থেকে বিদায় জানিয়েছেন তাঁর প্রিয় বাপ্পীকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে ক্ষোভ জানিয়ে লিখেছেন বাপ্পীর কফিনের পাশে আওয়ামী লীগের এত নেতা এসেছেন, এদের কেউ কী লাইফ সাপোর্টে থাকতে বাপ্পীর খোঁজ নিতে হাসপাতালে গেছেন?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে বাপ্পী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে মিছিলের লড়াকু মুখ। গত বিএনপি আমলে যুব মহিলা লীগের যে সব নেত্রীকে প্রায় রাস্তায় মারধর করতো বিএনপির পুলিশ, বাপ্পী তাদের একজন। ১/১১’র পর আওয়ামী লীগের যে সব আইনজীবী নেতা গ্রেফতার হওয়া শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়ান, বাপ্পী তাদের অন্যতম। এরজন্য পর তাঁর স্থান হয়েছিল এটর্নি জেনারেলের অফিসে এবং পরে সংসদে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালেও তিনি প্রসিকিউরের দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় সংসদে তাকে পরপর দু’দফায় এমপি করা হয়। চলতি জাতীয় সংসদেও তাঁকে এমপি করা হবে এমনটি ধারনা করা হচ্ছিল। কিন্তু তা না করাতে তিনি এক ধরনের বিষন্নতায় ভুগছিলেন। এবার আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তরুনদের মূল্যায়ন করা হবে এমন ধারনা থেকে অনেক মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হচ্ছিলো বাপ্পীর মূল্যায়ন হবে। কিন্তু তা হয়নি।
বাপ্পীর সঙ্গে যোগাযোগ মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমার লেখালেখিকে কেন্দ্র করে অনেকের সঙ্গে প্রায় মনোমালিন্য হয়। বাপ্পীর সঙ্গেও হয়েছিল। সিডনিতে তাঁর ঘনিষ্ঠরা আমারও ঘনিষ্ঠ। সেই সূত্রে গত কয়েক মাস আগে আবার যোগাযোগ। একাধিকবার কথাও হয়েছে। গত কয়েকমাস ধরে তাঁর কার্যক্রমে বিষন্নতার ছায়া দেখতাম। এরজন্য বোধ হয় ভূটানে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। ফেসবুকে তাঁর যে সর্বশেষ আইডি এটি তাঁর আসল আইডি নয়। আসল আইডি চলে যাবার পর তিনি এ নিয়ে আপিল করেন। এটা নিয়েও তাঁর মন খারাপ থাকতো। আমার আসল আইডি আমি আপিল করে গত নভেম্বরে ফেরত পাই। তখন তিনি হাহাকার করে বলেছেন, আপনারটাতো পেলেন। আমারটা পেলামনা।‘ আমি ফেরত পাওয়া আইনডি চব্বিশ ঘন্টা না যেতেই আবার হারিয়ে ফেলি। নতুন আইডি করার পর সেখানেও তিনি বন্ধু হয়েছিলেন বাপ্পী। কিন্তু সেই আইডিটাও খোয়া গেলে তাঁর সঙ্গে আবার বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়। এরজন্য তাঁর অসুস্থতার খবর দেরিতে পাই। সোশ্যাল মিডিয়াও আজ মানুষকে মানসিকভাবেও মেরে ফেলছে।
মাত্র উনপঞ্চাশ বছরের জীবনে এভাবে কেনো চলে যাবেন ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী? এই প্রশ্নটা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর হাজারও অনুরাগীর। এত বন্ধু-অনুরাগীর সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন-কথা বলতেন! তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর এত অনুরাগীর লেখা পড়ে পড়ে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম। এমন ভালোবাসা কয়জনের ভাগ্যে জোটে?
সত্য মিথ্যা জানিনা, খবরটি শুনে আমার মন থেকে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া এসেছে তাহলো, তাকে হত্যা করা হয়েছে! কেউ হাতে মারেনি। হত্যা করা হয়েছে মানসিকভাবে। একজন কাজের মানুষ, হঠাৎ যদি তাকে আপনি নো হয়্যার করে দেন, তাঁর মন ভালো থাকে কী করে? একজনের মন যদি ভালো না থাকে তাহলে কারো শরীর ভালো থাকে কী করে? অবসাদ এক কঠিন অসুখের নাম। এসবের সৃষ্টি, এর রাহুগ্রাস থেকে একজন কাজের মানুষকে রক্ষার কথা ভাবা হয় কিনা জানিনা। ভাবতে হবে। আমরা সবাই মিলে যদি তাকে সমর্থন দিতে পারতাম, বিষন্নতা তাঁকে এভাবে কাবু করতে পারতোনা। বাপ্পীর মৃত্যুর পর তাঁকে যে সব সম্মান দেয়া হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বাপ্পীর গুরুত্ব ছিল। বাপ্পীর প্রতি ভালোবাসার ঘাটতি ছিলোনা। এটা কেনো জানতে বুঝতে হবে বাপ্পীর মৃত্যুর পর? ওপারে ভালো থাকবেন বাপ্পী বোন আমার।