ব্যবসায় জড়িতরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়ুন

ব্যবসায় জড়িতরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়ুন

ফজলুল বারী: কোচিং বানিজ্য নিয়ে শুক্রবার এক টেলিভিশনে লম্বা আলোচনা হচ্ছিলো। গাড়ি চালাতে চালাতে শুনতে গিয়ে বিদেশের কোচিং নিয়ে ভুলভাল তথ্য শুনে মেজাজ খারাপ হয়। এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ওই অনুষ্ঠানের সংযোগ নিতে ফোনে যুক্ত হবার চেষ্টা করি। আমাদের এখানে গাড়ি চালিয়ে এভাবে ফোনে যুক্ত হয়ে চেষ্টা করা যায়না। এর জরিমানা ৩৪৪ ডলার এবং খোয়া যাবে ৫ পয়েন্ট। কিন্তু ওই টিভির নাম্বারে অনেক চেষ্টায় সংযোগ পাওয়া গেলেও ওই অনুষ্ঠানে সংযোগ চাইলে কিছু না বলে কলসংযোগটি কেটে দেয়া হয়। এরজন্যে এ লেখাটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত আসে।
আমি অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা জানি। ওই টিভি অনুষ্ঠানে কুমিল্লার এক মা বলছিলেন তাঁর ক্লাস ফোরের বাচ্চাকে স্কুলে বাধ্যতামূলক কোচিং করাতে হয়। এরজন্যে বাচ্চাকে স্কুলে নিয়ে পৌঁছতে হয় সকাল সাতটায়। স্কুল শেষে আবার কোচিং এর পর সন্ধ্যা ৭ টার পর বাচ্চাকে বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর বাচ্চাটি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ওই বাচ্চা আর তার মায়ের কষ্টের কাহিনী শুনে মন ছুঁয়ে যায়। এমন জুলুম অস্ট্রেলিয়ায় অবিশ্বাস্য। অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্কুলে অনেক মা-বাবা সকাল ৭ টায় তাদের বাচ্চাকে দিয়ে যান। এগুলো অবশ্য সরকারি স্কুলের ফ্রি আর্লি চাইল্ড কেয়ার। মা-বাবা কাজে যাবার পথে বাচ্চাকে দিয়ে যান স্কুলে। ওই বাচ্চাদের রিসিভ করার জন্যে এত ভোরেও এক-দু’জন শিক্ষক থাকেন। তারা মূলত ওই সময়ে তাদের দেখভাল করেন। তখনই তাদের নিয়ে স্কুলের ক্লাসে ঢোকেননা। স্কুলের ক্লাস শুরু হবার আগে এসেম্বলি হয়। এরপর শিক্ষকদের সঙ্গে লাইনে হেঁটে বাচ্চারা যায় ক্লাসে।
অস্ট্রেলিয়ার এই ক্লাসগুলোয় আবার প্রতিটি সেকশনে সর্বোচ্চ ২০-২৫ জন করে ছাত্রছাত্র থাকে। অটিস্টিক বাচ্চারাও একই স্কুলে পড়ে। অভিভাবকের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে তাদের হাত ধরে ক্লাসে গিয়ে ঢোকেন। নিজের কাছে বসান। এদের তাদের আলাদা যত্ম নিতে হয়। ক্লাস শেষেও এই অটিস্টিক বাচ্চাদের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন শিক্ষক। অভিভাবকদের হাতে বুঝিয়ে দেবার পর তাদের মুক্তি। অস্ট্রেলিয়ার স্কুলগুলোর মানবিক এ দিকগুলো দেখে মন ভরে যাবে। এখানে স্কুলে বাচ্চাদের টিফিন দেয়া হয়না। যেহেতু খেলার ফাঁকে ফাঁকে এদেশে পড়ানো হয়, এরজন্যে ছোট-বড়-মাজারি এমন কয়েক ভাগে টিফিন দিতে হয়। বিস্তর খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকায় স্কুল এদেশের বাচ্চারা খুব এনজয় করে। এরজন্যে সহজে কোন বাচ্চা স্কুল মিস করতে চায় না।
স্কুলে যে হোম ওয়ার্ক দেয়া হয় সেটি সোম-মঙ্গলবার দেয়া হলেও ফিরিয়ে নেয়া হয় শুক্রবার। যাতে শনি-রবিবার ছুটির দিনে বাচ্চার ওপর কোন চাপ না থাকে। এদেশে কোন মা ইংরেজিতে দূর্বল থাকলে স্কুলের উদ্যোগে সেই মায়ের ইংরেজি ভাষা চর্চার ব্যবস্থা করা হয়। স্কুল মনে করে মা ইংরেজিতে ভালো হলে বাচ্চার হোম ওয়ার্কে সহায়তা করতে পারবেন। অবশ্য কোন বাচ্চা হোমওয়ার্কে দূর্বল দেখা গেলে স্কুলেই তাকে সহায়তার ব্যবস্থা আছে। মোট কথা বাচ্চারা যা পড়ার তা মূলত স্কুলেই পড়ে ফেলে। আলাদা প্রাইভেট বা কোচিং এর প্রয়োজন পড়েনা। বাচ্চাদের আলাদা প্রাইভেট পড়ানো হবে বা কোচিং করানো হবে তা স্কুলও চায় না। কোচিং সেন্টার এখানেও আছে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরা কোন কোচিং সেন্টারে তাদের স্কুলের কোন ছাত্রছাত্রীকে গিয়ে পড়াতে পারেননা। এমনকি কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তত্ত্বের কারনে স্কুলের কোন শিক্ষক কোন ছাত্রছাত্রীর বাড়িতেও বেড়াতে বা কোন অনুষ্ঠানে যেতে পারেননা।
সোম থেকে শুক্র পর্যন্ত যেহেতু দিনের বড় অংশ বাচ্চারা স্কুলে থাকে সে কারনে বাচ্চাদের নানা শারীরিক সমস্যা, কিসে তার আগ্রহ-কিসে অনাগ্রহ এসব শিক্ষকরা ভালো বুঝতে পারেন। স্কুলের নিয়মিত অভিভাবক বৈঠক অথবা জরুরি বৈঠকে ডেকে অভিভাবককে তা জানানো হয়। যেমন এক শ্রেনী শিক্ষক লক্ষ্য করলেন তাঁর ক্লাসের একটি বাচ্চার ভিশনে সমস্যা রয়েছে বলে তাঁর মনে হচ্ছে। তখন অভিভাবককে ডেকে বাচ্চাটিকে দ্রুত চোখের ডাক্তার দেখাতে বলা হয়। চোখের ডাক্তার বাচ্চার চোখ পরীক্ষা করে বিশেষ একটি সমস্যা চিহ্নিত করেন। তাহলো জন্ম থেকে বাচ্চাটির চোখের মনি রাগবি বলের আকৃতির। সাধারনত এটি ফুটবল আকৃতির হয়। এরপর ডাক্তার বাচ্চাটির চোখের মনির আকৃতি পরিবর্তনের জন্যে একটি চশমা ব্যবহার করতে দেন। এমন বাচ্চা পড়াশুনার বাইরে কোন খেলা বা সঙ্গীতে আগ্রহী সেটিও শিক্ষকরা স্কুলেই চিহ্নিত করতে পারেন। সেই বাচ্চার প্রতিভার বিকাশে তখন থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি স্কুলের সঙ্গে খেলার মাঠ, জিমনেশিয়াম, মিলনায়তন এসব বাধ্যতামূলক। স্কুলগুলো সে ভাবেই নির্মান করা হয়।
তবে অস্ট্রেলিয়াও কোচিং সেন্টার আছে। বিশেষ কিছু বেসরকারি স্কুলে এদেশে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ভর্তির সুযোগ পেতে অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাদের ওইসব কোন কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়ান। ক্লাস থ্রি-ফাইভ-সেভেন-নাইন এই শ্রেনীগুলোর ছাত্রছাত্রীদের রাজ্য ভিত্তিক প্রতিযোগিতার নেপলেন নামের এক পরীক্ষায় বসতে হয়। নেপলেন পরীক্ষার আগেও অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের কোচিং এ পড়াতে নিয়ে যান। তবে এসব বাধ্যতামূলক নয়। মজার ব্যাপার এসব কোচিং এ আগ্রহী অভিভাবকদের প্রায় সবাই এশীয়। হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের বাচ্চাদের কোনভাবে বাড়তি চাপ দিতে চাননা। এদেশে প্রতি দশ সপ্তাহ ক্লাস থেকে দুই সপ্তাহের বিরতি থাকে। এসব স্কুল হলিডের দিনগুলোতে অস্ট্রেলিয়ান অভিভাবকরা বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যান। আর এশীয় অভিভাবকদের বেশিরভাগ ওই সময়ে কাজ বেশি করেন। এরজন্যে অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও বাংলাদেশ সহ এশীয় বংশোদ্ভূত বাচ্চাদের বেশিরভাগ এশীয় অঞ্চলের জীবনই কাটাচ্ছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় হাইস্কুল পর্যন্ত সরকারি স্কুলের পড়াশুনা ফ্রি। স্কুল এখানে টুয়েলভ ক্লাস পর্যন্ত। স্কুলে এখানে কোন বই নেই। বই যা আছে এর সবই থাকে স্কুলে। বছরের শুরুতে নির্দিষ্ট কিছু খাতা কিনতে বলা হয়। ক্লাসে পড়ার প্রয়োজনে দেয়া হয় কিছু ফটোকপি। বাকি পড়াশুনা অনলাইনে, প্রজেক্টরের মাধ্যমে এবং লাইব্রেরিতে। আর প্রতিদিন নানান খেলাতো আছেই। বাংলাদেশের পড়াশুনা বাচ্চাদের কাছে আকর্ষনীয় করতে চাইলে সবার আগে চলতি বইয়ের বোঝা কমাতে হবে। দুনিয়ায় এখন সব পদক্ষেপ হিসাব করে মাপা। প্রয়োজনের এক লাইন কম কেউ পড়ায় না। এক লাইন বেশি কেউ পড়ায় না। মোট কথা পড়াশুনাটাকে উপভোগ্য করতে হবে। সেটিই হয় আসল শিক্ষা। বাংলাদেশের চলতি শিক্ষা ব্যবস্থার বড় দূর্বলতা মান সম্মত শিক্ষকের সংকট। শিক্ষকদের প্রশিক্ষন আরও বাড়াতে হবে। শিক্ষক হওয়াটা যে অনেক সংগ্রামের, এটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে তাদের মনের মধ্যে।
শিক্ষকতায় বেতন কত তা জেনেই সংশ্লিষ্টরা এ পেশায় আসেন। যার এতে পোষাবে তিনি আসবেন। না পোষালে আসবেননা। কেউ কাউকে হাতেপায়ে ধরেনি যে তিনি শিক্ষকতায় না এলে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে যাবে। শিক্ষকতা একটি মহান ব্রত। এই ব্রতের সম্মান যিনি রাখতে অক্ষম তাদের এখান থেকে বের করে দিতে হবে। অসৎ শিক্ষক দিয়ে ভালো ছাত্র ভালো মানুষ তৈরি সম্ভব নয়। ছাত্র যদি পড়াশুনায় দূর্বল হয় বেশি শ্রম দিয়ে তাকে এগিয়ে দেবার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের।
এরজন্য তাকে বেতন দেয়া হয়। বেতন গুনবেন আর প্রাইভেট বা কোচিং আয়ের বিনিময়ে পড়াবেন, এমন মানসিকতার লোকজনের শিক্ষকতায় থাকার দরকার নেই। শিক্ষকতাকে ব্যবসা হিসাবে নিতে চাইলে তাদের আগে জনগনের ট্যাক্সের টাকার চাকরি ছাড়তে হবে। শিক্ষক নামধারী চামার যারা ছাত্র এবং অভিভাবকদের জিম্মি করেন, এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে এলাকায় এলাকায় অভিভাবকদেরও মূল ভূমিকা নিতে হবে। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে সেখানে নিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েদের। নতুন প্রজন্মের মেধাবীরা অনেক বেশি সৎ আন্তরিক অথবা তুলনামূলক কম দুর্নীতিগ্রস্ত।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com