ফজলুল বারী: ঢাকার নিউমার্কেট লাগোয়া রাস্তার অবস্থা মঙ্গলবার সারাদিন টিভিতে দেখছিলাম। এমন ঘটনা বিদেশ থেকে আমরা যখন দেখি তখন, দেশটার অবস্থা নিয়ে খুব আক্ষেপ কষ্ট হয়। পৃথিবীর মানুষ কোথায় চলে যাচ্ছে প্রতিদিন। আর আমাদের দেশের মানুষজন কোথায় আটকে আছে! কী সব নিয়ে ব্যস্ত সবাই!
ঢাকা এমনিতে অসহনীয় যানজটের শহর। গাড়ি চলেনা নড়েনা। দূষিত ঢাকার বাতাস। নিঃশ্বাসের সঙ্গে নিত্য ক্যান্সারের জীবানু ঢুকছে সবার ফুসফুসে! এই সময়ে রাস্তার সংঘর্ষ বা যে কোন ঘটনা যানজটে আটকা থাকা মানুষকে বিপর্যস্ত করে। যানজটে আটকা থাকা মানুষ বিড়বিড় করে অভিশাপ দেয়!
এই অভিশাপ কাদেরকে দেয়, এটা সেই জানে! হায় আমাদের নতুন প্রজন্ম! প্রিয় প্রজন্ম! কী ইমেজ তাদের নিয়ে দেশবাসীর মনের ভিতর বাস করে! সারাদিন বিভিন্ন মিডিয়ায় বলা হয়েছে ছাত্রদের ফাওয়া খাওয়া, খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যাওয়া নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত!
এমন কি রাতের বেলা টিভিতে এক ছাত্রলীগ নেতাও প্রায় একই রকম বক্তব্য দিচ্ছিলেন! নিউমার্কেট সহ আশেপাশের মার্কেটগুলোর মালিক-কর্মচারীরা গ্রাহকের সঙ্গে কি রকম জবরদস্তিমূলক ব্যবহার করে এর ফিরিস্তিও দিচ্ছিলেন। ১০০ টাকার শার্টের দাম হাঁকে ১০০০ টাকা!
এরপর কাষ্টমারকে একটা দাম বলতেই হবে! কাষ্টমার একটি দাম বললে সেই দাম দিয়ে সেই শার্ট বা পণ্যটি তাকে নিতেই হবে! এখনও এমন মুল্লুক আমাদের দেশ! কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে এই ঘটনার উৎপত্তির ঘটনা ভিন্ন। সেই ছাত্রলীগ নেতার মধ্যেও তথ্য ঘাটতি।
ইফতারি বিক্রির চেয়ার বিছানো নিয়ে ঝগড়া হয়ছে দুই দোকানের দুই কর্মচারীর। প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে এক পক্ষ ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্রকে ডেকে আনে! তারা জব্দ করতে গিয়ে উল্টো নিজেরা অপর পক্ষের হাতে জব্দ অথবা আক্রান্ত হয়! খবর পেয়ে তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে আরেকদল।
সেখান থেকে সংঘর্ষের বিস্তার ঘটে! একজন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হন অনেকে। স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত দুই ছাত্রের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে সংঘর্ষে মারমুখো ভৃমিকা ছিল দোকান কর্মচারীদের।
তাদের হাতে সাংবাদিকরাও আক্রান্ত হয়েছেন। আর পুলিশ টার্গেট করেছে ছাত্রদের! কারন ছাত্ররাতো পুলিশকে চাঁদা দেয়না। দেশের মানুষের মধ্যে এমনিতে পুলিশের ভাবমূর্তি ভালো নয়। বিভিন্ন সুযোগে তা হয় উৎকট প্রকাশিত। এই সুযোগে প্রকাশ হচ্ছে পুলিশের সহী চাঁদা কাহিনী।
নিউমার্কেট সহ আশেপাশের সব মার্কেট-ফুটপাতের দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা পায় পুলিশ! তারা ঈমানদার। রোজা রেখে রোজার দিনে চাঁদা খেয়ে বেঈমানি করতে জানেনা। তাই চাঁদার টাকার কৃতজ্ঞতা জানাতে তারা দোকানি-ব্যবসায়ী তাদের ফাইটারদের পক্ষ নিয়েছে ঈমানদারের ভূমিকায়!
পুলিশের রমনা জোনের এডিসি হারুন, নিউমার্কেট থানার ওসি কাইউমের মারমুখো ছবি বেরিয়েছে! এমন ভাবমূর্তির পুলিশ নিয়ে চলছে দেশ! পুলিশ বাহিনীর মাথার ওপর লজ্জাজনক বিদেশি নিষেধাজ্ঞা! এরপরও কারও হুশ হচ্ছেনা! মুক্তিযুদ্ধের সূচনার রাজারবাগের প্রতিরোধ যুদ্ধের পুলিশ, অসংখ্য শহীদ পুলিশের গৌরব, করোনা মহামারী মোকাবেলার পুলিশের ছন্দ কোথায় হারিয়ে গেলো!
শুধু ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরের ফুটপাথের হকার নয়, মহাসড়কের পুলিশকেও এখন ট্রাক-যানবাহনপিছু মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হয়! উন্নয়নের মহাসড়ক বানান শেখ হাসিনা। আর পুলিশ খায় চাঁদা! মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে পুলিশ মানীর মান নষ্টম করেনা! এরজন্যে মাসিক চাঁদার কার্ড চালু করেছে!
পৃথিবী এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। রোজার মাসে আল আকসা মসজিদে হামলা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। জন্ম থেকে জ্বলছে ফিলিস্তিনের প্রজন্ম। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম ইহুদি দখলদারের বিরুদ্ধে জন্মভূমি রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
আর এই সময়ে বাংলাদেশের ঢাকার মিরপুর রোডে ভিন্ন এক রণক্ষেত্র! সারাদিন ফেসবুকে অনেক ছেলেমেয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষনা করে পুলিশের বিরুদ্ধে পোষ্ট দিচ্ছিলেন। ছাত্ররা ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই তরুন কাল।
ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ফিরিস্তি দিয়েছেন, বিএনপির কোন নেতা নিউমার্কেটে কতোটা দোকানের মালিক! যে দোকান থেকে ঘটনার সূত্রপাত সে দোকানের মালিক নিউমার্কেট থানা বিএনপির সভাপতি এডভোকেট মকবুল হোসেন! কি সাহস! এবার দেখাবো মজা! বুঝবে কত ধানে কত চাল!
ক্ষমতার ১৩ বছরে দাঁড়িয়ে একই হিসাব! দোকান মালিক কী আওয়ামী লীগার হলে সব বিশুদ্ধ চলে! এমন পরিস্থিতিতে এমন ফিরিস্তির কিন্তু আরেক হাহাকার আছে। দোকানগুলো আমাদের হতে হবে। আমাদের দিয়ে তোমাদের দোকানদারী করতে হবে! ঈদের বাজার। একটা সমঝোতায়তো আসতেই হবে।
ছাত্ররা পড়াশুনা করতে ঢাকা কলেজে গেছে। কারও পক্ষে ভাড়া খাটতে কেন যাবে! ছাত্র কেনো আরেকজনের ডাকে এমন সার্ভিস দিতে যাবে? এটা কী তাদের কাজ? যৌবনের কি নিদারুন অপচয়! যারা কাজ করে পড়ে, টিউশনির টাকায় কষ্ট করে পড়ে, তারা এর সময় পায়না। বদনামটা সবার হয়ে যায়।
২০১৬ সালে আমি দেশে গিয়েছিলাম। ফেসবুকে পরিচিত একদল প্রিয় প্রজন্ম সর্বক্ষন আমার সঙ্গে। নিউমার্কেটের পাশের এক মার্কেটে তাদের একজনের জন্যে কাপড় কিনতে গিয়েছি। আমি অবাক দেখি সঙ্গী একজন ঢাকা কলেজের একজনকে ফোনে ডেকে নিয়ে এসেছে!
তাকে দেখে দোকানি বলছিল, উনাকে নিয়ে এসেছেন! আমার কেনা দামটা শুধু দেন। লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম। কারন আমি যেখানে আছি এখানে এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পণ্যের গায়ে দাম লেখা। বিকিকিনি চলে সেভাবেই। ডাকাডাকির সংস্কৃতির সঙ্গে বিস্ফোরন জড়িত।
এখন যে ঘটনা ঘটেছে এটাও বহুমুখী বিস্ফোরন। ডাকাডাকিতে যারা ভাড়ায় যায় তাদের বিরুদ্ধে দোকান কর্মচারীদের বিস্ফোরন। দোকান কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিস্ফোরন। ঈদের বাজারের এই সময়ে এর মাশুল দিচ্ছে দোকান মালিক-ক্রেতা সবাই।
আশা ছিল মনে মনে ঈদসংখ্যা ব্যবসা করবে জনে জনে। এই ঈদের বাজারের ব্যবসা একদিনও বন্ধ থাকবেনা! এখন এই ঘটনায় তাদের খরচ বাড়লো! এর ফাকতাল থেকেও যারা কামাই করে তারা যার যার ঈদ কামাই করে নেবে। পুলিশ স্যার, অমুক ভাই অমুক ভাই সবাইর কামাই চলবে।
মাঝখান দিয়ে বেঘোরে যার প্রান গেলো, রণক্ষেত্রকে ঘিরে যারা এরমাঝে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের কান্না কেউ শুনবেনা। চাঁদা চলবে। মিরপুর রোডে পক্ষ নেয়া পুলিশের শ্রমের মূল্য চাঁদায় পরিশোধ করতে হবে ব্যবসায়ীদের। ছাত্র নামধারী যারা চাঁদা খায় তাদের ঈদ বোনাস দিতে হবে বাড়িয়ে।
দোকানিদের অবশ্য লোকসান নেই! এইসব চাঁদার ষোল আনা তারা ক্রেতার ঘাড় মটকে আদায় করবে! বাংলাদেশের মানুষের মনে উৎসব নেই। ঈদ উৎসবের কেনাকাটায় তাদের অনেকের হুঁশ কাজ করেনা। ভিড়ের ঈদের বাজারে কোন দরদাম চলেনা। সিয়াম সাধনার মন্ত্রও বেহিসেবী ঈদের বাজারে ব্যর্থ হয়!