অনলাইন ডেস্ক: ২৭ অক্টোবর ২০১৫
বাবা তার নাম রেখেছেন বৈদিক ঋষির নামে। কিন্তু ইদানীং স্কুলে কিছু সহপাঠী তাকে দেখলেই ‘মুসলমান আসছে, পাকিস্তানি আসছে’ বলে তাকে খেপায়। এ বারের পুজোতেও সে অন্য বারের মতো আনন্দ করেছে। অন্য বারের মতোই? ঠিক তো?
টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে সলমন খানের নতুন বাণিজ্য-সফল ছবি। ছেলের পাশে বসে দেখছেন বাবা। একটি দৃশ্যে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কিছু উত্তেজিত মানুষ ঢুকে পড়ে পাকিস্তান দূতাবাসে, শুরু হয় ভাঙচুর। এই দৃশ্য দেখামাত্র দশ বছরের ছেলে সোফা থেকে চিৎকার করে উঠল, ‘মার! মার! পাকিস্তানিগুলোকে মার।’ বাবা, মুসলিম ভদ্রলোক পেশায় অধ্যাপক; সন্তানের নাম রেখেছেন বৈদিক ঋষির নামে। ছেলের আচরণে যারপরনাই বিস্মিত তিনি প্রশ্ন করে জানতে পারলেন, ছেলের স্কুলে যখন এই ছবি দেখানো হয়েছিল তখন দৃশ্যটি পর্দায় আসামাত্র অনেক ছাত্র এই ভাবে তেড়ে উঠে পাকিস্তানিদের মারতে গিয়েছিল। ভদ্রলোক ছেলেকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে রাজনৈতিক ব্যাপারে কিছু সমস্যা থাকলেও পাকিস্তান আর পাঁচটা দেশের মতোই আর একটি দেশ, সেখানকার মানুষ আমাদের শত্রু নয়। কিন্তু মনে একটা খটকা থেকে গেল।
দিন দুয়েক বাদেই সে খটকা দূর হল। কথায় কথায় ছেলে জানাল, স্কুলে ইদানীং তার বেশ কিছু বন্ধু তাকে পাকিস্তানি বলে খেপায়। তাকে দেখলেই ‘মুসলমান আসছে, পাকিস্তানি আসছে’ বলে চেঁচাতে থাকে। স্তম্ভিত তিনি ভাবতে বসেন, খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত কলকাতার অন্যতম সেরা স্কুল, প্রায় সব ছাত্রই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসে, সেখানে, স্কুল কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে, কী ভাবে শিশুমনে প্রবেশ করে এই কলুষ? কেন কেবলমাত্র নিজের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য সেখানে বিদ্বেষের মুখোমুখি হয় দশ বছরের বালক? তাঁর মনের অতল থেকে উঠে আসে টুকরো টুকরো ছবি, কৈশোরকালের। আশির দশক। ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। পাকিস্তানের একটা করে উইকেট পড়ছে আর তিনি প্রাণপণ উল্লাসে মেতে উঠছেন। সেই উল্লাস যত না ক্রিকেটপ্রেমের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রমাণ করার জন্য, যে, আমি তোমাদেরই লোক। তার পর কেটেছে অনেকগুলো বছর। তিনি হিন্দু পাড়াতে বাড়ি ভাড়া পাননি; অন্য রাজ্যে দাঙ্গা যখন তুমুল, তাঁর বাড়ির সামনে ভিড় করে ভয় দেখিয়েছে চেনা প্রতিবেশী; বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে সবার সঙ্গে থাকতে চাইলেও তাঁকে যেতে হয়েছে মুসলমান ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট হস্টেলে; মুসলমান পরিচয় পেয়ে সহকর্মী অধ্যাপক একসঙ্গে খেতে চাননি। কিন্তু সে সব তো অতীত। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষ মঙ্গল অভিযান করেছে; দেশ পোলিয়োমুক্ত ঘোষিত; দেশবাসীকে বুলেট ট্রেন চাপার স্বপ্ন দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী; মহিলা পাইলট যুদ্ধবিমান চালাবার অধিকার পেয়েছেন।
সত্যি কি অতীত? না কি ভারতবর্ষের মুসলমানদের ব্রাত্য হয়ে থাকার এই সব গল্প কোনও দিনই অতীত হবে না! তাই দশ বছরের ছেলেকেও নেমে পড়তে হবে প্রমাণ করতে— আমি তোমাদেরই লোক। যে অপরিচয় এবং বিদ্বেষের অন্ধকার তার পিতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে এই দেশের মূল স্রোত থেকে, তা যেন আজ আরও নিকষ, আরও দুর্ভেদ্য। গোমাংস ভক্ষণের কাল্পনিক অপরাধে তাই মৃত্যু ঘটে নিরীহ মানুষের; যুক্তিবাদী হত্যার কোনও কিনারা হয় না; মুসলিম গায়কের অনুষ্ঠান বাতিল হয়; মুখে কালি লেপে দেওয়া হয় গ্রন্থ প্রকাশে উদ্যোগী কলমচির; রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিক্ষা ক্রমেই হয়ে ওঠে গৈরিক; নীরব থাকেন অথবা বক্রোক্তি করেন রাষ্ট্রপ্রধান। দেশ, সমাজ এবং পরিবার, সব পরিসরকেই ক্রমে গ্রাস করে অসহিষ্ণুতা— পরধর্ম, পর-সংস্কৃতি, পরমত সব কিছুর প্রতি তীব্র অসহিষ্ণুতা। রাষ্ট্রযন্ত্র অসহিষ্ণুতার এই সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়ার ফলে পরিস্থিতি হয় আরও উদ্বেগজনক। আরএসএস-এর মতো প্রতিষ্ঠান যে সরকারি প্রশ্রয়ে বা মদতেই ভারতবর্ষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে সর্বতোভাবে হিন্দুত্বের নীতি রূপায়ণের চেষ্টা চালাচ্ছে, সেই আশঙ্কা তীব্রতর হয়। আশার আলো হয়ে এগিয়ে আসেন কিছু লেখক, শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবী। সরকারি পুরস্কার ফেরত দিয়ে তাঁরা এই বিপদের বৃহত্তর প্রেক্ষিতের প্রতি দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু অদ্ভুত এই আঁধারবেলায় তাঁদের প্রতিবাদের মধ্যে অনায়াসে রাজনৈতিক অভিসন্ধি চিহ্নিত করে রাষ্ট্রযন্ত্র স্বয়ং। এই রকম একটা সময়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র যে নিজের সহপাঠীকে ধর্মের পরিচয়ে চিহ্নিত করে তাকে ব্রাত্য করতে শিখবে এতে বোধহয় বিস্ময়ের কিছু নেই। সেও তো এই সময়েরই ফসল।
এমত অবস্থায় এই মানুষটি কী শিক্ষা দেবেন সন্তানকে? এই অন্ধকার সময়ে দেশের আরও অনেক মুসলমানের মতোই তিনিও কিছুটা যেন দিশেহারা। তিনি কি ধর্মীয় পরিচয়কে আঁকড়ে ধরে নিজ সম্প্রদায়ের সীমার মধ্যে এক ধরনের গেটো-আবদ্ধ জীবন যাপন করার উপদেশ দেবেন? ধর্মীয় পরিচয়ের সঙ্কীর্ণ কানাগলিতে তো বহু দিন ধরেই আটকে থেকেছে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উন্নয়নের প্রশ্নটি। সেই নিয়ে রাজনীতি করেছে ডান, বাম, সব দল। উগ্র হিন্দু মৌলবাদী রাজনীতির চটজলদি প্রতিষেধক হিসাবে যে সব রাজনৈতিক শক্তি ডানা মেলছে বিভিন্ন রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে সেগুলি তো এই গেটো-আবদ্ধ উন্নয়নবিমুখ সমাজদর্শন দ্বারাই পরিপুষ্ট। ঘৃণার রাজনীতি ব্যবহারে তারাও পাল্লা দিতে চায় হিন্দু মৌলবাদের সঙ্গে। তাদের পথই বেঁচে থাকার, টিকে থাকার একমাত্র উপায় মেনে নেবেন? না কি এতদিন যা করে এসেছেন তিনি, তা-ই করবেন— বহুত্ববাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যে ভারতবর্ষ সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার পথ দেখায়, সেই পথের কথা শোনাবেন। যে পথের দিগ্নির্দেশ এবং সবিস্তার বিবরণ আমাদের দেশের সংবিধান।
পার হয়ে গেল দুর্গাপূজা। সমস্ত বাঙালির এই মহোৎসবে অন্যান্য বারের মতো এ বারেও আনন্দে মেতেছে এই শিশু। এই আনন্দযজ্ঞে যখন সে শামিল হয়েছে, তার কানে কি গুঞ্জরিত হয়েছে অন্য কোন স্বর, যা তাকে জানিয়েছে যে, সে আসলে এই বিপুল উৎসবের আয়োজনে ব্রাত্য, ‘অনুপ্রবেশকারী’? তার পিতা তাকে হয়তো এর পর আরও স্পষ্ট ও সবল উচ্চারণে শোনাবেন শাশ্বত ভারতবর্ষের গল্প, যা কোল পেতে আশ্রয় দিয়েছে সকলকে, যেখানে সব মত, সব ভাষা, সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব জাতি সমান আদরের। কিন্তু অহৈতুকী বিদ্বেষের তিক্ত স্বাদ পাওয়া বালক কি শাশ্বত ভারতবর্ষের এই গল্প সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে?
(কোনও ঘটনা বা চরিত্র কাল্পনিক নয়)
(সুত্রঃ তাজুদ্দিন আহ্মেদ,আনন্দবাজার )