বাংলাদেশ জন্মের নেপথ্যে রয়েছে—জাস্টিস। জাস্টিস অর্থাত্ ন্যায়বিচার না থাকলে বাংলাদেশ হতো না। আবার ইনফরমেশন না হলে ন্যায়বিচার হতো না। জাস্টিস আর ইনফরমেশন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যথাযথ তথ্য ছাড়া জাস্টিস হয় না। এবং জাস্টিস ছাড়াও ইনফরমেশন হয় না। জাস্টিসের ধারণা আমরা পাই খ্রিস্টের জন্মের চার শ’ বছর আগে সক্রেটিসের কাছে। জাস্টিসের ধারণাটা তিনি তুলে ধরলেন। আবার নিজের জীবনটাও তিনি দান করলেন জাস্টিসের জন্য।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানিদের ভয়টা ছিল মূলত তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার। কারণ ভাষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আর তথ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কায়েম করা যাবে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ। এই কারণে পাকিস্তানিরা ভয় পেত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে।
সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের সময় আমি রেসকোর্স ময়দানে ছিলাম। আমার ছাত্রছাত্রীরা বলছিল—ইউডিআই অর্থাত্ ইউনিলেটারল ডিক্লারেশেন অব ইন্ডিপেনডেন্স। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে তখনই স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। কারণ, তাহলে তখনই রক্তের নদী বয়ে যেত। তিনি তার ভাষণে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বললেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা সরকার গঠন করতে দেয়নি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন ডি ফ্যাক্টো সরকার প্রধান। তিনি যা বলতেন বাঙালি সরকারি কর্মচারীরা সেটাই শিরোধার্য করতেন, সেটাকেই ‘আদেশ’ হিসেবে মেনে নিতেন। আসলে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু যে ন্যায়বিচারের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, সেটা ছাড়া কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। ন্যায়বিচারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ন্যায়বিচার কীভাবে হয়? তথ্যের মাধ্যমে হয়। অর্থাত্ সঠিক তথ্য ছাড়া ন্যায়বিচার হয় না। সেই কারণে ২০০৯ সালে এসে বাংলাদেশে আমরা যে তথ্য অধিকার আইন করতে পারলাম, এটা একটা বিরাট অর্জন। তবে মনে রাখতে হবে, আইন তো অনেক হয়, কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকায় দেখলাম, নারায়ণগঞ্জে কিছুদিন আগে নির্বাচিত এক নারী নেত্রী বলেছেন, তিনি যদি কাজ না করতে পারেন তবে তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু পদত্যাগ করার আগে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে জানিয়ে যাবেন, কেন তিনি কাজ করতে পারছেন না। তার ব্যর্থতার কারণ জানিয়ে তিনি পদত্যাগ করবেন। একজন নেতার জন্য এটা একটা দারুণ পদক্ষেপ।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। আমাকে তিনি ‘আমেরিকান প্রফেসর’ বলে ডাকতেন। ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম আমার ভগ্নিপতি এনায়েতুল্লাহ খানের ব্যাপারে। এনায়েতুল্লাহ খান ছিলেন হলি ডে পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক। বাকশালকে এনায়েতুল্লাহ খান সমালোচনা করে লিখেছিলেন ওয়ান পার্টি সিস্টেম বলে। কথাটা এমন ছিল যে, বাকশাল অ্যাজ ওয়ান পার্টি সিস্টেম ইজ লাইক ডিক্টেটরশিপ। বাকশাল নিয়ে আরো নানা ধরনের সমালোচনা ছিল বলে বঙ্গবন্ধু এনায়েতুল্লাহ খানকে গ্রেফতার করে সিলেটের কারাগারে পাঠিয়ে দেন। আমার বাবা ফরিদপুরের খানবাহাদুর আবদুর রহমান খানকে বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন, আমাকেও সেই কারণে অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি। ভগ্নিপতি গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে যাই। আমার ভগ্নিপতির প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাদের ফরিদপুরের আবদুর রহমান খান তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে বরিশালের মুসলিম লীগের আবদুর জব্বার খানের ছেলের বিয়ে দিলেন কেন? তারপর তিনি বললেন, তোর ভগ্নিপতি উল্টোপাল্টা কেন লেখে?
আমি বললাম, ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধু আপনার জার্নালিস্ট যারা আছেন, মনে করবেন তারা আপনার জুতা পরেই ঘোরাফেরা করছেন। আপনি তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাবেন না। অ্যারিস্টটল বলেছেন, Only the wearer knows where the shoe pinches. তখন আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রকৃত ইনফরমেশনের কথাটা তুলে ধরলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপর বললেন যে এইভাবে তো কেউ তাঁকে বলে নাই। তিনি এনায়েতুল্লাহ খানের মুক্তির ব্যবস্থা করলেন।
আসলে বঙ্গবন্ধুকে যদি কেউ যথাযথ তথ্য দিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারতেন, তিনি তত্ক্ষণাত্ ঠিক ঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। বাকশালের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা আমি সাময়িকভাবে করেছি, যখনই বুঝব এর দরকার নাই, তখনই এটা আর থাকবে না। তুই তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, তুই তো জানিস—এমার্জেন্সি হলো ওয়ানপার্টি সিস্টেম। তার মানে এটা চিরকালীন নয়। এটা সাময়িকভাবে আছে। তোরা মনে করিস না এটা হিটলার বা মুসোলিনির মতো ঘাপলা। এটা সাময়িকভাবে করা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্বাচনটা হবে বহুদলীয়।
বঙ্গবন্ধুর এই কথা এখন পর্যন্ত কেউ লেখেনি। এটাও একটা বড় ইনফরমেশন। এই তথ্য দিয়ে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৭৩ সালে পাঁচটি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশে এনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করিয়েছিলাম। পাকিস্তানি আমলে বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন তখন প্রচুর পড়তেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ দুর্বলতা। তিনি প্রাণখুলে কথা বললেন আমার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। আমেরিকান শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে বলল, ‘ড. খান, হি ইজ এ গ্রেট লিডার। ইউ হ্যাভ ব্রট আস টু এ গ্রেট লিডার।’
শেক্সপিয়রের মতো বলতে হয়—দিজ ওয়াজ এ ম্যান হোয়েন কাম্স অ্যানাদার। এমন মানুষ বাংলায় আর আসবে না।
লেখক :ড. জিল্লুর রহমান খান , যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্যাল সায়েন্স এসোসিয়েশন আর.সি-৩৭-এর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন, ইউএসএ’র প্রেসিডেন্ট। (সূত্রঃ ইত্তেফাক)