সাংবাদিকতার শুরু থেকেই হলুদ সাংবাদিকতার কথা শুনে আসছিলাম। প্রথম শুনেছিলাম এক ঘুষখোর আমলার কাছ থেকে। অনেক আগে, লেখালেখি যখন শুরু করি, তার গোড়াতেই। এরপর বিভ্রান্ত, দালাল রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেকেই এই হলুদ বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন। একই সময়ে ওই সব জ্ঞানদাতার কাছ থেকে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি কালো আর হলুদের পার্থক্য। হলুদের চেয়ে তাদের কালোর দৌরাত্ম্য যে অনেক বেশি, তা টের পেয়েছি পেশাগত জীবনের পরতে পরতে।
আমার প্রান্তিক শহরে ঘুষখোর আমলাটি ঈদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। একদল সঙ্গী নিয়ে ছিল তখনকার বিচরণ। সবাইকে নিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম। চৌকস আমলাটি বুঝেছিলেন, তাঁর প্রতি বিদ্রূপ করতেই এমন করেছিলাম।
এখন আর বিদ্রূপ-তামাশায় ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ নেই। হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ে নয়, এখন পুরো মিডিয়াকেই হামলা করা হচ্ছে ফেক মিডিয়া বলে। বলা হচ্ছে, পুরো মিডিয়া ফেক হয়ে গেছে। আমাদের মিডিয়াকে আক্রমণ করেছেন স্বৈরাচার, অনাচারে জড়িত অনেক রাষ্ট্রনেতা। এসব সয়ে নিয়েই আমরা বড় হয়েছি। আমরা আমাদের কাজ করেছি। তাঁরা তাঁদের মতো বলেছেন।
সময়টা পাল্টে গেছে। মূল বক্তব্যের আগে আমেরিকার সংবাদপত্র নিয়ে চলতি কৌতুক বলে নেওয়া যাক। বলা হয়, আমেরিকায় যাঁরা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল পড়েন, তাঁরাই এ দেশ চালান। নিউইয়র্ক টাইমস তাঁরা পড়েন, যাঁরা মনে করেন তাঁরাই দেশটি চালাচ্ছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর পাঠকেরা মনে করেন, দেশটি তাঁদেরই চালানো উচিত। ইউএসএ টুডে যাঁরা পড়েন, তাঁরাও মনে করেন দেশটি চালনোর অধিকার তাঁদেরই। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস যাঁরা পড়েন, তাঁরা মনে করেন সময় পেলে দেশটি চালাতে তাঁরা কিছু মনে করবেন না। বোস্টন গ্লোব তাঁরাই পড়েন, যাঁদের মা-বাবারা দেশটি একসময় চালিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর পাঠকেরা নিশ্চিত নন, ঠিক কারা দেশ চালাচ্ছেন। নিউইয়র্ক পোস্ট-এর পাঠকেরা কারা দেশ চালাচ্ছে তা নিয়ে বিকারহীন। কেবল স্ক্যান্ডাল আছে, এমন সংবাদ হলেই তাঁদের চলে। সান ফ্রানসিসকো ক্রনিকাল-এর পাঠকদের ধারণাই নেই, দেশ নামে কিছু আছে বা থাকা উচিত কি না। মায়ামি হেরাল্ড-এর পাঠকেরা অন্য দেশ চালানো নিয়ে ব্যস্ত। শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার পাঠকেরা প্রধানত আমেরিকার মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের। তাঁরা মনে করেন, অন্য পত্রিকার পাঠকেরা আমেরিকার কোনো অংশই নয়।
এবার আসা যাক আসল প্রসঙ্গে। খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ৯০ শতাংশ সংবাদমাধ্যমই ফেক নিউজ দিয়ে ভরা থাকে। তিনি বলেছেন, ভুয়া নিউজের পদক পাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হওয়া দরকার।
ফেক নিউজ আর ফেক মিডিয়া শিরোনাম দেখেই যাঁরা আমেরিকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছেন, তাঁদের একটু থামতে হবে। এ সপ্তাহান্তে পোপ ফ্রান্সিস ফেক নিউজ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। ক্যাথলিক মিডিয়ার সঙ্গে ভ্যাটিকানে কথা বলছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। সাবধান করে দিয়েছেন ফেক নিউজ বা ভুয়া নিউজ সম্পর্কে। পোপ বলেছেন, সাংবাদিকেরা পুরোনো স্ক্যান্ডাল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। এ কারণে অনেকেই আহত হচ্ছেন। এসব না করে নরম ভাষায়, যাতে কেউ আহত না হয় তার দিকে লক্ষ রাখার জন্য পোপ স্বয়ং আহ্বান জানিয়েছেন।
পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের অনেক সংকট নিয়ে কথা বলেন। উদ্বাস্তু থেকে অভিবাসন সমস্যা নিয়ে তাঁর কথা সমীহ করা হয়। বিশ্বের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বড় অংশের প্রশ্নহীন আনুগত্য তাঁর প্রতি। তাই পোপ যখন বলেন, তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, সাংবাদিকেরা ফেক নিউজ দিয়ে কঠিন পাপ করছেন। এ পাপাচার থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পোপের বক্তব্যের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো বক্তব্য এখনো আসেনি।
আমরা অবশ্য এমন অপবাদের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যখন জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে তখন আমরা লিখেছি এদের উত্থান নিয়ে। বাংলা ভাইসহ জঙ্গিদের উত্থানের খবর উড়িয়ে দিয়ে তখনকার মন্ত্রী ও জামায়াত নেতারা বলেছিলেন, সব নাকি মিডিয়ার সৃষ্টি। ধর্মীয় নেতারা কেউ কেউ এর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন। তাই ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরের দায় কাঁধে নিয়ে কখনো রাষ্ট্রযন্ত্র, কখনো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে লড়তে হয়েছে সংবাদমাধ্যমকে। যদিও সংবাদমাধ্যমকে অভিযুক্ত করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের কেউ কেউ এখন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। কেউ কেউ আস্তাকুঁড়ে যাওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন।
কে কার কাছে থেকে, কবে শিক্ষা নিয়েছেন, এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে। আমাদের দেশের বর্তমান শাসকেরাও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে আমাদের অতীব জনপ্রিয়, জনবান্ধব নেতারা সংবাদপত্রের নামে বিষোদ্গার করেছেন। এসব মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হয়েছে। সাংবাদিকেরা তো কলম (বর্তমানে কী বোর্ড) ছাড়া আর কিছু দিয়ে লড়তে পারেন না। সংবাদ বিরুদ্ধে চলে যাবে বলে আমাদের অনুষ্ঠানে যেতে দেওয়া হয় না। গলাধাক্কা দিয়ে বের না করলেও বলা হয়, ওখানে আপনার, আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। এসব আমাদের কাছে নতুন নয়। এসব ঝুঁকি নিয়েই একটা প্রতিশ্রুতি থেকে আমরা সাংবাদিকতা করি। জল কেমনে ঘোলা হয়, এই ঘোলা জলের খবরটা তো আমরাই রাখি।
আমেরিকায় থাকি। এই দেশটির প্রতিষ্ঠালগ্নে সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে মতপ্রকাশের অবাধ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এখানে পত্রিকা প্রকাশের জন্য কোনো ডিক্লারেশন প্রয়োজন হয় না। এখানে সত্য বলার জন্য পারমিট নিতে হয় না। এই দেশের জনগণ অবাধ তথ্যপ্রবাহের পূজারি ছিল, আজও আছে।
মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে। সম্ভবত এ দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট সরাসরি সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে চলেছেন অবিরাম। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্ট শুধু সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম নয়; এগুলো সারা বিশ্বের মানুষের বিবেকের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে আমেরিকার যে অর্জন বা ব্যাপ্তি, তার মধ্যে এসব সংবাদমাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। অথচ এই দেশের প্রেসিডেন্ট খোদ আজ প্রকাশ্যে নাম ধরে বিশ্বের সাংবাদিকতার জন্য সমাদৃত এসব প্রতিষ্ঠানকে ফেক নিউজ বা ফেক মিডিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। আমাদের মতো সংবাদকর্মীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারীরা তাঁর অভিযোগকে অবলীলায় মেনে নিচ্ছেন।
যাঁরা সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের সম্পর্কে অভিযোগ করে সুখবোধ করেন, তাঁদের জানা দরকার, এ বছরে সংবাদ সংগ্রহ বা প্রকাশের জন্য সারা বিশ্বে ৬৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলে পড়ে কারাগারে আছেন ২৬২ জন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট নামক সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে তুরস্ক থেকে চীন, মিয়ানমারে সাংবাদিকেরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। সত্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে প্রতিদিন নিজেদের জীবন বিপন্ন করছেন অগুনতি সংবাদকর্মী।
দেশে দেশে স্বৈরাচার, অনাচারে জড়িত শাসকদের চক্ষুশূল হয়ে পেশায় টিকে থাকতে হয়েছে, হচ্ছে সংবাদকর্মীদের। সেখানে মুক্ত বিশ্বের নেতা হিসেবে আমেরিকাকে মনে করা হতো তথ্যের অবাধপ্রবাহের রক্ষাকবচ। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে উঠে আসে দেশে দেশে কতজন সাংবাদিক তাঁর পেশার কাজ করতে গিয়ে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন তার বিবরণ। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে আজও প্রতিবছর আইনপ্রণেতারা এ রিপোর্টটি দেখেন। ভিন্ন মত আর সত্য প্রকাশের জন্য নিবেদিত সংবাদকর্মী আর সংবাদমাধ্যমের কাছে বিষয়টি একটি বড় শক্তি হিসেবে কাজ করছিল।
এখন যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা ক্যাথলিক বিশ্বের প্রধান পোপ ফ্রান্সিস ফেক নিউজ বলে সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকে সমালোচনা করেন, তখন সংবাদকর্মীদের দাঁড়ানোর জায়গাটি দুর্বল হয়ে পড়ে। দেশে দেশ নিপীড়কেরা আরও আশকারা পেয়ে যায়।
সারা বিশ্বে, এমনকি খোদ আমেরিকায় সাংবাদিকদের জন্য এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সংবাদপত্রকর্মীরা কোথাও নিরাপদ নেই। শাসকেরা মনে করছেন চাপ দিয়ে-সমালোচনা করে সত্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধ করে দেবেন। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করে ফেলবেন। এমনটি হতে পারে না। সংবাদকর্মী সত্য উদ্ঘাটনের জন্য কৌশল স্থির করতে পারে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের পেশার দাবি মেটাতে পারে। আমরা সেসব সংবাদকর্মী, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করি। সমস্যা, আর সমালোচনা মোকাবিলা করেই আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাব। একজন সংবাদকর্মী তাঁর বিবেকের কাছেই কেবল দায়বদ্ধ, কোনো শাসক বা রক্তচক্ষুর কাছে নয়। আমাদের নিশ্বাসে আর বিশ্বাসে এ সত্য উচ্চারিত হয় বলেই, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিই। আমরা আমাদের পেশার পরিচিতি নিয়েই লড়ে যাব।
(সূত্রঃ প্রথম আলো ,ইব্রাহীম চৌধুরী )