সময়ের সাধন

সময়ের সাধন

বুঝলেন আপা চুরির অপবাদ দিছিলো।

চেয়ারম্যানের নজর ছিল আমগো পুষ্কুনির পাড়ের জমির উপ্রে।

হেগোলগে পারন যায়? এরা মাইনসের মাতাত কাডল ভাইঙ্গা খায়।

 

আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম, কথা প্রসঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলাম বিদেশ কেন গিয়েছেন। তবে এই প্রশ্ন আর কাউকে করা যাবেনা,  বেশিরভাগেরই বোধয় দেশ ছাড়ার তেমন সুখ স্মৃতি নেই।

 

দেশের সীমানা পেরিয়ে দীর্ঘ এগারো বছর পর মানিক ভূঁইয়া বাড়ি যাচ্ছে। চোর ছেচ্চর হলে এগারো বছর কেউ বিদেশে টিকতে পারার কথানা। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটাকে আবার একবার দেখলাম। বাসে ট্রেনে, চলতি পথে এমন সাধারণ সুতি শার্ট রেডিমেন্ট প্যান্ট পড়া কত লোক দেখি। কোনো বিশেষত্ব নেই, সকলেই এরা ছুটেছে জীবিকার তাগিদে।

তার পায়ে দেখছি বাটার স্যান্ডেল।

 

পায়ের দিকে তাকাতেই বললেন,  আপা ছুডু ভাইরেও নিয়া আসছি, আপনার ভাবি জামা কাপড়, স্যান্ডেল সব পাডাইসে। আমার আর কিনন লাগেনাই। কাজে যাওনের ড্রেস আসে, বাহিরের কাপড় তেমন লাগেনা।

 

উনি আবার কথা শুরু করলেন, আপা একটু খেয়াল কইরা লিখবেন, পাসপোর্ট  কিন্তু রিনিউ করা হইসে, অন্য পাতায় সিল আছে। ব্রুনাই থেকে উঠা লোকটি পড়াশোনা না জানলেও এগুলো শিখে গেছেন। বাহ্।

পড়াশোনার হয়তো সুযোগ পাননি, পেলে কে কি হতে পারতো তা বলা মুশকিল।

আমি একটু অন্যমনষ্ক হয়ে আছি। একা একা যাচ্ছি, লিখার কাজ ও কথা শেষ হলে কোন মুভি দেখবো তা সিলেক্ট করতে হবে, আমার নিজের কার্ড ফিলাপ করতে হবে।

 

সেদিন এমিরাটসের ফ্লাইট ধরে যাচ্ছি ঢাকা।

ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি ও মানিক সাহেব দুজন দু দেশ থেকে দুবাই এসে একই প্লেনে উঠলাম। আমার পিছনের সারির অন্য আইলে বসা লোকটি আমাকে তার এমবার্গেশন কার্ড লিখতে অনুরোধ করলেন। এরকম অভিজ্ঞতা এই নতুন নয়, অনেকেই করেন তাই অবাক হলামনা। লোকটির পাশের সহযাত্রীরা প্রায় সকলেই বিভিন্ন দেশে কাজ করেন। আমরা যাদের শ্রমিক মজদুর বলি, ওই তারা যারা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে।

ইনারা কেউই এমবার্গেশন কার্ড ফিলাপ করতে পারেননা, ইনাদের প্লেনে উঠার পর প্লেনের টয়লেট আর যাওয়ার উপযুক্ত থাকেনা। তারা নিজেরাও আমরা যারা নিজেদের আলাদা শ্রেণীর ভাবি তাদের পরিশ্রমের ফলশ্রুতির অহংকার দেখতে আসেননা। সামান্য এমবার্গেশন কার্ড ফিলাপ করে দিলেই খুশি হয়ে যান।

ওদের মন পুরো সময় দেশের মাটিতে নেমেই প্রিয়জনকে দেখার আকাঙ্খায় বিভোর থাকে। ঠিকমত খেতেও পারেনা। মেনু দেখে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলা আরম্ভ করেন,  মেনু বুঝতে প্রথমে একটু অসুবিধাই হয়। চিকেন আর রাইস পেলে একটু শান্তি মত খায়। অনেককে চিকেন হালাল কিনা না সে সন্দেহে চিকেন এক পাশে সরিয়ে  শুধু রাইস খেতে দেখেছি,  অথচ এই ফ্লাইটে হালাল চিকেনই দেয়া হবে সেই কথা তার জানা নেই।

 

মানিক সাহেব ঠান্ডা মেজাজের মানুষ মনে হলো। কিছু শুদ্ধ,  বেশিরভাগ আঞ্চলিক শব্দ মিলিয়ে কথা বলছেন। বলেই চলেছেন, একটাই ছেলে আফা আমার।

 

কেউ গল্প করলে একদম চুপ করেতো থাকা যায়না, জিজ্ঞেস করলাম ছেলে কত বড় হয়েছে?

উনি এবার অনেক্ষন হাসলেন, পরিতৃপ্তির হাসি।

ছেলেরে ছুডু রাইখা আসছিলাম, সেই ছেলে মেট্টিক পাশ করছে।

ছেলেটার জন্যই যাইতেছি। এতো ভালো লেখাপড়া করছে ছেলে।

 

বুঝলাম মেট্রিক পাশ করা ওদের জন্য বিরাট প্রাপ্তির বিষয়। ছেলেটিকে দেখতে ইচ্ছা করলো। বাবার অনুপস্থিতিতে এই স্কুল জীবন শেষ করেছে, মেট্রিক পাশ করেছে। ছেলেটাতো ভালোই মনে হচ্ছে, বাবার কষ্টের সম্মান রেখেছে।

 

আমার কিছু বলে লাগলোনা, উনি ওয়ালেট বের করে দেখালেন, সেখানে ছেলের ছোট বেলার আর এখনকার দুটো ছবি পাশাপাশি রাখা।

ছোট সেই ছেলেটা উনার চোখের আড়ালে কত বড়ইনা হয়ে গেলো।

উনি যখন এই ছবিগুলো দেখেন নিশ্চয়ই উনার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ে। সন্তানের মায়া, পরিবারের মায়া ছেড়ে এগারো বছর কিভাবে পার করলেন ঠিক বুঝিনা।

আমি একটু জিজ্ঞেস করলাম যে বুঝলাম চেয়ারম্যান ভালোনা। সে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, মান সম্মান নিয়ে টানাটানি করেছে কিন্তু এতদিন কেন যাননি দেশে?

উনি বোঝানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে বলা আরম্ভ করলেন, পথ্থম পথ্থম অনেক কষ্ট হইছে, বুঝবার পারিনাই থাহুম না চইলা যামু। চেয়ারমান যতদিন থাকবো ততদিন আমি যাইবার চাই নাই।

এরপর মালিক ছুডি দিবার চায়না। মালিকরে খুশি রাহন লাগে, ছুডু ভাইরে কাজে লাগাইছিনা?

এরা কাজের ঈমান্দারিরে ভালো পায়।

 

দেখেননা ব্রুনাইর স্বাধীনতা আসছে আমগো পরে, কিন্তুক হেরা আমগো আগে উন্নত হইয়া গেছে।

এহন ছেলে মেট্রিক পাশ করসে, আমি আর কুনুদিকে তাকাইনি, মালিকরে কইছি এইবার আমি জামুই।

 

আমার উনার আনন্দ দেখে ভালো লাগলো, বললাম ভালো করেছেন।

 

হ ঐ সময় বিদেশ যাইতে বাপের আমলের একটা ভিডা বেইচা দিতে হইছিলো। এইবার নতুন ঘরে উঠুম।

চেয়ারম্যানের আড়তে আমরা দুই ভাই কাজ করতাম।

একদিন খবর আইলো টাকা চুরি গেসে, আমি ছাড়া আর কেউ আছিলোনা। কিন্তু আমি জানি আমি চুরি করিনাই, কোন টাকাই চুরি যায় নাই।

চেয়ারম্যান কইলো হয় আমারে পুলিশে দিবো নইলে জমি লিখা দিতে হইবো।

মা, ভাই সবাই আমারে বাচাইতে জমি দিয়া দিলো, জ্যালের ভাততো আর খাওন যাইবোনা।

 

বড় ভাইয়ের আবার এক পাও ছোড। খুড়াইয়া চলে, হেরেতো বিদেশ পাডান যাইবোনা। আমিই চইল্লা আসছি।

মার কাছে বৌ আর ছেলেটারে রাইখা আইছিলাম।

এখন সবাইরে আলাদা আলাদা ঘর কইরা দিছি।

মার মরনের সময়ও যাইতে পারছিনা।

 

উনি কথা বলতে থাকলেন, কাজ আর অতীত ছাড়া বলার মত তেমন কিছু উনার জীবনে আছে বলে মনে হয়না।

দেশের জন্য যা কিছু করেছেন সবই এখনও চোখের আড়ালে।

 

আফা আমার মালিক কে জানেন?

আমি কি বলব বুঝতে পারলামনা, উনার মালিক ব্রুনাই এর কোন মানুষ, আমি কিভাবে চিনবো!

আমি দুদিকে মাথা নাড়লাম।

 

উনি হাসি মুখে বললেন, আমার মালিক একজন মহিলা।

 

আমি বুঝলাম, মহিলা মালিক হতে পারে এটা এখনও উনার জন্য বড় একটা চমক।

 

আফা আমার মালিকরে আমরা কেউ কুনুদিন দেহিনাই। বোরখা পরেন, নেকাব দেন। চোখ ছাড়া কিছু দেহা যায়না।

আমি ক্যান কেউই দেহেনাই তারে।

আমি যখন গেছি তখন কারবার ছোডই আসিল, এখন উনি মাশাল্লাহ অনেক বাড়াইছেন।

বিশজন আছি আমরা বিভিন্ন দ্যাশের।

 

ওহ তাই নাকি, ভালোতো।

আমি চিনিনা জানিনা সেই মহিলাকে সাধুবাদ জানালাম। আমার দেশের একজন দুজনকে তিনি উপকৃত করেছেন।

 

উনার কথা শুনতে শুনতে ঘাড় ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিলো।

আমি নিজের ব্যাগ খুললাম, পাসপোর্ট বের করে নিজের এমবার্গেশন কার্ড ফিলাপ করা আরম্ভ করলাম।

একটা মুভি চালালাম, খাবারের ট্রলি খাওয়া বিতরণ করছে, সিটের পিছন থেকে যে ট্রলি আসছে ঐটা আমাকে খাওয়া সার্ভ করবে, দেখতে গিয়ে উনাকে আবার চোখে পড়লো।

 

কথার কোন বিরতি চলেছে মনেই হলোনা, উনি বললেন ছেলেরে জিগাইলাম কি চাও বাবা, ছেলে কয় আমার কিছু লাগবোনা আব্বা আপনে আসেন। উনার দু আঙুলে সামান্য একটু পানি চোখ থেকে মুছে ফেলার অভ্যস্ত ভঙ্গিও দেখতে পেলাম। কোনো কথা বলার ছিলোনা।

কিন্তু চুপ করে থাকতে পারলামনা, জানা কথাই আবার বললাম।

এইতো আর কিছুক্ষন। ছেলে অনেক খুশি হবে।

 

উনি হাসলেন। খাবারের ট্রলি আসাতে উনাকে আর দেখা যাচ্ছেনা। যে যার মত খাওয়া খেয়ে এরপর বিশ্রামে ব্যস্ত হয়ে ছিলাম।

প্লেনে সময় যেন আটকে যায়, কিছুক্ষন মানুষ দেখাও একটা কাজ তখন। কত রকম মানুষ সহযাত্রী। সব যাত্রীইতো কত কাহিনী বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে।

পরিবার সহ অনেক কম লোক উঠেছে,  বেশিরভাগই একা।

পরিবার সহ থাকার মত চাকরি ওদের কে দিবে, ওদের এতো ভাবার কোন সুযোগ থাকেনা।

 

এদের সবার কাহিনীর মধ্যে এই একটাই মিল, ওরাও একা এবং ওদের পরিবারও ওদের ছাড়া।

 

মানিক ভূঁইয়ার স্ত্রীকে আমি চিনিনা, সয়ং মানিক ভূঁইয়ার সাথে কতটুকুই কথা হয়েছে,  কতক্ষনইবা! কতটুকুই জানতে পেরেছি।

কিন্তু মনে হয়েছে  উনার ছেলের না হয় মা ছিল, কিন্তু এই মহিলা কি করে এগারো বছর স্বামীর আত্মীয় সজনদের মাঝে স্বামী ছাড়া পার করলেন।

তখন সবার হাতে মোবাইল ছিলোনা, সবার বাড়ি ল্যান্ড ফোনও ছিলোনা।

তার স্বামীর সাথে কথা বলতে মন চাইলে কি করতেন, চিঠি লিখতে না পারলে অন্যকে দিয়ে কত কথাই আর লিখানো যায়।

কিছু খেতে বা কিনতে মন চাইলে এগারো বছর ধরে বুকে সেই ইচ্ছা চাপা দিয়ে রেখেছেন?

যখন সব কাজ শেষ হয়ে যেতো, ছেলেও ঘুমিয়ে পড়তো তিনিও নিশ্চয় স্বামীর মতোই চোখে চলে আসা পানি আঙুলে ফেলে দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

 

মানিকের নিজের পাল্লাটা কি কম ভারী! বাবা হয়ে সন্তান, স্বামী হয়ে স্ত্রী, ছেলে হয়ে মায়ের কাছ থেকে তাকেও দূরে থাকতে হয়েছে।

 

মানিকের মা উনাকে না দেখেই চলে গেছেন। অভাবের সংসারে এতো মায়া অবশিষ্ট থাকেনা তবে মানিকের এই  বিদেশ গমন উনাদের যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ দিয়েছে, বৃদ্ধা কি সব মায়েদের মত নিজের ছেলেটাকে শেষ সময়ে দেখতে চাননি?

না পেরেছেন ছেলেকে আনতে, না পেরেছেন ছেলের কাছে যেতে।

 

ছেলে মেয়ে বিদেশ থাকলে এ বেলায় বড়লোকদেরও সমাধান হয়না।

ছুটি পাওয়া, আসার জোগাড় চাইলেও হঠাৎ করা যায়না।

 

কত মানিক ভূঁইয়াদের কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বছর কে বছর যারা পরিবার ছেড়ে দূরে।

পরিবার থেকে দূরে থেকে পরিবারকে একটু খুশি দিতে  অসম্ভবকে সম্ভব করছে তারা।

 

আসলে প্রবাসীদের সকল সুবিধা,  স্বাছন্দের পৃথিবীর উর্ধ গগনে কিছু কালো মেঘ সবসময় উঁকি দেয়।

 

শারমিন সারা