বছরের শুরুতেই ঘুরে এলাম বাংলাদেশ। ৭ জানুয়ারী ১৯ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯, পাঁচ সপ্তাহ। সিডনী বাঙালি পাঠকদের সাথে শেয়ার করছিলাম সেই সফরের অল্প বিস্তর।
আজ বলি, উন্নয়নের বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের উন্নয়নের কিছু নিয়ে, আমার দেখার আলোকে অল্প বিস্তর!!!
২০০৯ এ দেশ ছেড়েছি আমি। এরপরের প্রায় ১০ বছরে সব মিলে ৩/৪ মাসের দেখা বাংলাদেশ! বলাই বাহুল্য, আমার দেখা বাংলাদেশের অনেক কিছুই আঁটকে আছে ২০০৯ এর স্মৃতিতে!!!
২০০০ সালে আমি আমার প্রথম চাকরী পাই। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সময়ে পার্ট টাইম দুই একটা জব করলেও ফুল টাইম এবং পড়ালেখা শেষ করার পর বেশ কিছু ইন্টারভিউতে যথারীতি ফেইল করে এরপর পাওয়া চাকরী আরকি।
সেই চাকরীর শুরুতে তিন মাসের মূল সেলারী ছিলো ৭,৫০০টাকা। টাকার অঙ্ক থেকে এখন ধারণা করেন এই ২০১৯ এ এসে ঢাকায় এই বেতন কাঠামোতে কে বা কারা জব করছেন!!!
না, ২০০৯ এ দেশ ছাড়ার আগে, সর্বশেষ অফিসে এই বেতনের দুই চার গুণ বেশী পেলেও এই সময়ে আমার চেনা অচেনা অনেক জুনিয়র সিনিয়র যে বেতন কাঠামোতে কাজ করেন তা রীতিমত ঈর্ষনীয়!!!
সরকারী, বেসরকারী, আধা সরকারী, সায়ত্বশাসিত, এনজিও এবং মাল্টি ন্যাশনাল পুরো বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকেই তাঁদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিয়েই কাজ করছেন, বাংলাদেশে! পাচ্ছেন নানান সুবিধা। মেডিক্যাল, বোনাস, উৎসব ভাতা, কার লোন, হোম লোন এবং বাংলাদেশে এখন অনেক অফিসে বিশেষ দিনগুলোতে পুরো অফিসও মেতে উঠে উৎসবে, নানা আয়োজনে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখ এবং আম কাঁঠাল লিচুর সময়ে শুনেছি কিছু অফিস তার কর্মচারীদের এক ডালা ফলমূল নাকি উপহারও দেয়!!!
মনের মত জব স্ট্যাটাস নিয়ে যারা এই পরবাসে আছেন, তাঁদের কথা আলাদা। যারা নেই তাঁদের বুকে অনেক দীর্ঘশ্বাস যে নিজেদের অজান্তেই জমা হয়ে যায় বাংলাদেশে ফেলে আসা জব নিয়ে সে আমি অনেকটাই সাহস করে বলেই দিতে পারি। আপনাদের অনেকেরই পরিবার পরিজন এবং কাছের অনেক বন্ধুরাই এখন যে কাজ করছেন এবং তাঁদের লাইফ স্টাইল দেখে শুনে অনেকটা জানা আছে আপনারও নিশ্চয়ই এই সময়ের জব রিয়েলিটি!!!
এবং যা না বললেই নয়, আমার বন্ধুদের প্রায় সবাই অনেক ভালো জব করছে, গাড়ী আছে প্রায় সবার… মধ্যম আয়ের দেশ বলে কথা। এক সময় যে আমরা ভাবতাম শুধু বড়লোকেদেরই গাড়ী বাংলাদেশে এখন আর এই বাস্তবতা নেই আসলে…
তবে, কিছু শুভংকরের ফাঁকি তো আছেই, বড় লোকেরা আরো বড় লোক হয়েছে, হচ্ছে। এটা আমার কথা না, নানান সমীক্ষায় উঠে আসছে। কিছু মানুষ অনেক ভালো চাকরী করছে, এটা যেমন সত্য লাখো লাখো বেকারও আছে পাশাপাশি। আমি আমারই কাছের এমন বেশ কিছু তরুণ তরুণীকে চিনি, যারা জব খুঁজছে হন্যে হয়ে পাচ্ছেনা। আবার এমন অনেকের কথা জানি, যারা জবের আশা না করে বিজনেস করছেন, অনেক রকম বিজনেস।
আমার আরো যেটা মনে হয়েছে, প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করা মানুষদের গত ৫/৭ বছরে বেতন বেড়েছে কয়েক গুণ এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের ঢাকায় বসবাসটা হয়ে গেছে বেশ কঠিন, যা নিম্ন আয়ের মানুষদেরও ওভাবে নয়…
আমার প্রাক্তন অফিস এসিস্ট্যান্ট, যে এখন বনানীতে কাজ করে একটা ফটোকপি, নোটারী পাবলিক আরো কী কী সার্ভিস যেন। যা বেতন পান তা দিয়ে দুই বাচ্চাকে স্কুলে পড়িয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা খুব কঠিন তাই বউ বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিয়েছে তাঁর পৈতৃক গ্রামের বাড়ীতে। সে একাই ঢাকার অদূরে শেয়ার করে আছে কোনভাবে এবং এর জন্যেই হয়তো, মাস শেষে কিছু টাকা পরিবারকে পাঠাতে পারে।
ঢাকায় গত ৫/৭ বছরেই হাতিরঝিলসহ বেশকিছু সুনির্মিত ফ্লাইওভার হয়েছে এবং আছে নির্মানাধীন আরো। মেট্রো রেল, আন্ডার পাসের মত আরো অনেক কিছুই আছে পরিকল্পনাধীন। তারপরও ঢাকাকে আমরা যতোই ভালোবাসি, এই সব উন্নয়ন দিয়ে ঢেকে দেইনা কেন, দিনে দিনে এটা হয়ে যাচ্ছে রীতিমত অভিশপ্ত শহর। কারণ একটাই জ্যাম!!!
এশিয়া তো বটেই, গোটা পৃথিবীর অন্যতম জ্যামের শহর হিসেবেই এই সময়ের ঢাকা পরিচিত।
২০১৬তে গেলাম ঢাকা, আছি গ্রীনরোডে। উত্তরাতে আছে আমার এই অস্ট্রেলিয়াতেই থাকা এক প্রবাসী জুনিয়র বন্ধু নাহিদ। দেখা করবো। প্ল্যান হলো, ও সকাল সকাল গাড়ী পাঠিয়ে দেবে, ওদের বাসার বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়েই গাড়ী আমাকে এসে পিক করে নিয়ে যাবে এবং সকালের নাস্তা করবো উত্তরা ওদের বাসায়, দুপুরে বনানীতে ওর শ্বশুর বাড়ীতে খাবো দুপুরের খাবার। বিকেলে একসাথে আসবো বইমেলাতে। সকাল নয়টার মাঝে রেডি হয়ে বসে আছি, ছোট বোনকে নিয়ে। গাড়ী অন দ্যা ওয়ে, ১০টা বাজে, খিদেয় পেট চু চু… ১১টা… বাধ্য হয়ে এক কাপ চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাই, ১২টা প্রায় বাজলো বলে… সেই সকালের নাস্তা খেতে শেষমেশ উত্তরা পোঁছাই প্রায় ২টায়, তড়িঘড়ি করে বনানী প্রায় ৪টায়, এবং সেইরকম দৌড়ের উপ্রে যেখানে বইমেলায় যাবোই কথা ৪/৫টার মাঝে পৌঁছাই প্রায় ৭টায়!!! এই হচ্ছে একদিনের দৃশ্য।
জ্যামের জন্যে আমার ধারণা ঢাকায় থাকা বিশেষ করে অনেক অফিস করা মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য রীতিমত হুমকির মুখে। দিনের পর দিন, মানুষের জীবন থেকে রাস্তায় বসে বসে চলে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা।
তার মাঝে, ভি আই পি চলাচলের জন্যে মানতে হয় বিশেষ নিষেধাজ্ঞা এবং মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত, অনেক সময় শুধু এক গাড়ী অন্য গাড়িতে ঘষা লাগিয়ে দেয়ার অপরাধেই দুই ড্রাইভার নেমে রাস্তার মাঝখানেই শুরু করে দেয় হাতাহাতি মারামারি। আপনি অসহায় হয়ে বসে বসে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারবেননা, এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার এই ট্যুরেই।
বৃষ্টি এলে, মানে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশী বৃষ্টি হলেও এই ঢাকা আর সেই ঢাকা থাকেনা। সেই পুরোনো স্যুয়ারেজ সিস্টেম, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অফিস আদালত ক্লিনিক এবং হাইরাইজ বিল্ডিং। কই যায় বর্জ্য, কই যায় এতো এতো ময়লা আবর্জনা।
ঢাকাকে ফাঁকা না করলে ভাবা যায়না সামনে আরো কী ভয়াবহ অবস্থা দেখতে হয়।
অনেক অনেক ভালো ফ্ল্যাট যেমন এই ঢাকাতেই হয়েছে, আছে খুবই ঝুঁকিপুর্ন অনেক অনেক বিল্ডিং আজও। পুরোনো ঢাকার ক্যামিক্যাল কারখানার জন্যে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার বিষয়গুলো তো আমাদের সবার জানাই।
প্রচুর বিল্ডিঙের কাজ হচ্ছে যেখানে নেই সেইফটি, না পথচারীর না ওয়ার্কারদের।
ঢাকায় রেস্টুরান্ট বিজনেজের রীতিমত বিপ্লব ঘটে গেছে বলা যায়। অনেক অনেক নুতন, মানে আমার কাছে। আপনি সেই পার্বত্য অঞ্চলের খাবার খাবেন, বিয়ে বাড়ীর খাবার, চীন, জাপান থাই তো আগেই ছিলো… আরো অনেক অনেক রকম খাবার দোকান। না সবগুলোতে যাওয়া হয়নি মানে সাধ্যই নেই আমার। তবে বলছি, অন্য রকম একটা মজার অভিজ্ঞতা।
কিছু বন্ধুর সাথে মিট করতে গেছি, সাথে আমাদের বাচ্চা কাচ্চারাও আছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার সব বন্ধুরা মিলেই আমাকে ট্রিট দিলো মানে বিল শেয়ার করতে দিলোনা… আমি ভাবলাম, এট লিস্ট কফিটা আমি খাওয়াই, আর বাচ্চারা যদি আরেক দফা ড্রিঙ্কস বা আইসক্রিম খায়… এই কফি আর ড্রিঙ্কসের যে বিল আমাকে ধরিয়ে দেয়া হলো সেই রেস্টুরেন্ট থেকে, বুকের বা পাশে রীতিমত ব্যাথা উঠে যাওয়ার অবস্থা। ভাগ্যিস ঐ পরিমাণ টাকা পার্সে ছিলো সেদিন।
তবে অনেকের কাছেই এই টাকা কোন বিষয়না। কফি যে আপনি, ৫০/১০০ টাকায় আর পাবেননা এটা আমার মনেই আসেনা, ঐ যে বলছিলাম, আমি আঁটকে আছি ২০০৯ এ! আহা কলা বাগানে সেভেন এলেভেন এ কফি খেতাম, কত হবে ২৫/৩০ টাকা এখন মনে হয় ওটা পৃথিবীর সেরা কফি ছিলো!!!
পুরো বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। ঢাকা এবং আমার নিজের শহর ময়মনসিংহ। টিভি বা মিডিয়ার মাধ্যমে যতোটা দেখি বুঝতে পারি ঢাকার বাইরের সব শহরই হয়েছে অনেক বেশী উন্নত। কিছু ঝকঝকে, তকতকে। বিশেষ করে চিটাগং, রাঙ্গামাটি, বান্দরবনের ওদিকে অনেক সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট এবং খাবার জায়গা হয়েছে। সিলেটে আছে বেশ কিছু ফাইফ স্টার মানের হোটেল মোটেল ভাবা যায়।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যেতে যেতেই চোখে পড়বে অনেক অনেক এমন হোটেল, মোটেল। তবে হে যে কথা না বললেই নয়, ঢাকা টু ময়মনসিংহ রোডটা ফাইনালি কমপ্লিট হয়েছে যা বছর ৪ আগেও অতটা সুন্দর ছিলোনা। তবে ঐ যে একটাই সমস্যা কোথাও পাবলিক টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই। কোন কোন পেট্রোল স্টেশনে যা আছে ব্যাবহার করার জো নেই, বাধ্য হয়ে কোন না কোন রেস্টুরান্টে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে আগে ভাগেই উত্তরা/টঙ্গী পার হওয়ার সময়েই যেতে হবে, না হলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন আমার মত। খুব বাজে অভিজ্ঞতা এই টয়লেট না পাওয়া নিয়েই হয়েছে।
ময়মনসিংহ থেকে ফিরছি, ১২০ কিমি ধরুন ৩/৪ ঘন্টা সেখানে উত্তরা থেকে গ্রীন রোডে পোঁছাতে লাগবে আরো এমন ৩/৪ ঘন্টা… এই গোটা সময়টা আপনি যদি পানি না খেতে পারেন এবং টয়লেটে যাওয়ার কথা চিন্তাও না করতে পারেন, একবার ভেবে দেখেন কী ভয়াবহ শারীরিক এবং মানসিক চাপ এটা। আমি প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিলাম এমন পরিস্থিতিতে।
আমার পক্ষে সবকিছুতে আরো বেশী ইনভল্ভ হয়ে দেখা সম্ভব হয়ে উঠেনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন। ইনফ্যাক্ট আমি তো সেই বিশেষজ্ঞও নই। তাই আমার সাধারণ চোখে সাধারণভাবেই তুলে ধরলাম আজ এইটুকুন… তারপরও আরো যা আছে বলার ফিরছি বেঁচে থাকলে সামনের পর্ব নিয়ে, এবং ঐ পর্ব দিয়েই শেষ করবো এই ট্যুরের সাতকাহন, আশা করছি।
ভালোবাসার বাংলাদেশ ভালো থাকুক!!!
আজ যারা পড়লেন, সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা, ধর্ম যার যার, উৎসবের আনন্দ হোক সবার!!!
লেখিকার অন্যান্য লেখা গুলির জন্য ক্লিক করুন :
প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯ – পর্ব ২
প্রবাসীর বাংলাদেশ ২০১৯ – পর্ব ১
সামাজিক কোন আড্ডায় আপনি কী বলেন…!!!
পরবাসী জীবন, কিছু একান্ত অনুভব!!!