খানা-খাদ্যের স্মৃতিকথা

খানা-খাদ্যের স্মৃতিকথা

পূরবী পারমিতা বোস:আমরা ভেতো বাঙালি।প্রবাস জীবন আমাদের ভাতের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।দুইবেলা ভাত খাই আমরা।আমার তো সকালের খাবারেও ভাত খেতে ইচ্ছে করে।সেই মেয়েবেলার মত।স্কুল কলেজে যাবার আগে পেট ভরে ভাত খেয়ে যাওয়া।
আমাদের বাসার নিয়ম ছিল তিনবেলা ভাত।সকালে চায়ের সাথে বিস্কুট খেয়ে নিত সবাই ।তারপর সকালের মূল খাবারের জন্য রান্না হতো গরম ভাত সাথে একটা বা দুটো পদ।কখনো আলু ভর্তা,বেগুন ভর্তা,পাতলা ডাল,আলু ভাজা ,ডিম ভাজা, মিক্সড সবজি,ছোট মাছের ঝোল।শীতের দিনে নতুন সবজীর তরকারি।মানে হলো যখন যা জুটতো তাই।কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই কোনো আড়ম্বর নেই।স্নান করে ভেজা চুলে পেট ভরে ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যেতাম ।
ডে শিফট স্কুল।টিফিন ঘন্টায় পেতাম হাফ বাটার বন্ড,সিঙাড়া,পুরি , কলা কোনোদিন একটা লুচি সাথে হালুয়া।তাই নিয়ে কত আগ্রহ করে খেতাম ।নিজেদের বন্ধু ক্লাশ ক্যাপ্টেন হলে তো কথাই নেই।মাঝে মাঝে শিবুদা বা সূর্য্যি মাসির চোখ এড়িয়ে কয়েকটা মাথা বেশি গোনা হতো।আর তা ভাগাভাগি করে খেতাম বান্ধবীরা।আহা কি সহজ সরল মধুময় দিন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল ঘরে ফিরে আবার এক থালা ভাত খেতে হতো।এটা বাধ্যতামূলক।মোটামুটি তিন চারটা আইটেম। সেও খুব সাদামাটা।ভাত ,বিভিন্ন শাক সবজি ,ডাল ,মাছের ঝোল।
মাংস হতো মাসে দুই তিন দিন।আর যেদিন মাংস রান্না হতো সেদিন বেশ উৎসব উৎসব মনে হতো ।কি দারুন সুঘ্রান বের হতো।ছুটির দিন গুলোতেই বেশি হতো মাংস।রান্নার সময় ভাগ্য ভালো হলে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেই কাসার বাটিতে ঝোল সহ একটুকরা মাংস লবন চাখবার জন্য পাওয়া যেত।কি তার স্বাদ!ঝোলের শেষটুকু চেটে পুটে খেয়ে নিতাম আমরা।তরকারির জন্য আলু সেদ্ধ করা হলো তার দুটো লবন দিয়ে খেতাম।মটরশুটি বাছা হচ্ছে কয়েকটা খেয়ে নিতাম।শীতের নতুন টমোটো এলো তার একটা ধুয়ে লবন দিয়ে খেলাম।আহা এইগুলোই ছিল আমাদের মজাদার স্ন্যাক্স !

আর সত্যিকারে স্ন্যাক্স বলতে ছিল চিড়া-মুড়ি,নাড়ু-মোয়া,চানাচুর-বিস্কুট,বুট-বাদাম,নানা রকম দেশী মৌসুমী ফল্,ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা কটকটি ,নানারকম আচার ,হাওয়াই মিঠাই আর কাঠি আইসক্রিম।চার আনা আটআনা পেলে মোড়ের টং দোকানের সুপার বিস্কুট ,নাবিস্কো লজেন্স ,কালোকালো হজমি আর ঝাল লবনের বাদাম ভাজা ।একটু বড় হয়ে পেয়েছি রিং চিপস।পাঁচ আঙুলে আংটির মত পরে একটু একটু করে বন্ধুদের দেখিয়ে খেতাম আমরা সেই চিপস।আহা!কোথায় সেই দিন!

খেলাধূলা শেষে সন্ধ্যেতে ঘরে ফিরে সেই চা মুড়ি বা চা বিস্কুট।কখনো বা চিড়া ভাজা ,তেলেভাজা,শীত হলে পিঠা পুলি,পূজা হলে নাড়ু মোয়া।আর আবার সেই ভাত তরকারি সবজি মাছের ঝোল।কখনো কখোনো ডিমের পাতলা ঝোল হতো ,ঝাল ঝাল,সাথে আলু গোল গোল।অর্ধেকটা ডিম দুপুরে অর্ধেক রাতে।২/৪ টাকা হালি ডিম ও অর্ধেক খেতে হতো কেনো,কে জানে? তবে গরম ভাতের সাথে সেই ঝাল ঝাল ঝোল অমৃত স্বাদ।ডিমের কুসুমটা আলাদা থালার পাশে যত্ন করে রেখে দিতাম খাওয়া শেষে সবচেয়ে স্বাদের অংশটুকু আয়েশ করে খাবো বলে।আহারে দিন !কি সুন্দর দিন!

আর এখন থরে থরে খাবার ।কত রকম খাবার ।হাত বাড়ালেই খাবার।বাচ্চাদের খাওয়াতে হয় ঘ্যানঘ্যান করে।খাবার খায় হয় পড়তে পড়তে না হয় হাতে মোবাইল ,নয়তো টিভিতে চোখ।ঘি খাচ্ছে না কি খাচ্ছে কিছুই পায় না টের।এমনকি কোনো কোনো খাবারের নাম পর্যন্ত জানে না ।পিঠা পুলির ধার ধারে না।মা মাসীর হাতের রান্না নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই।ভালো খাবার মানেই রেস্টুরান্টের খাবার।খাবার মানেই ম্যাক , কেএফসি,নান্দুস অপর্তো, ডোমিনাস হাংরী জ্যাকস।খাবার নয় যেন দোকান গুলোর নামই খাবার।আর এইসব পিৎজা বার্গার সান্ডুইচ হটডগ এসে কত অল্প সময়ে দখল করে নিয়েছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলোর স্হান।হারিয়ে গেছে পরিবারের হৈচৈ করে খাওয়ার আনন্দময় পরিবেশ।আহা দিন ! অতীতের সোনালী দিন।
ছবি গুলো গতকালকের তোলা