শুধু পাঁচ পুলিশ শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে!

শুধু পাঁচ পুলিশ শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে!

ফজলুল বারী:একত্রিশ বছর পর চট্টগ্রাম গণহত্যার রায় বেরুলো! সাধারন কোন ঘটনা ছিলোনা সেই গণহত্যা। সেদিন চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দলের নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে সেদিন  শেখ হাসিনার জীবনরক্ষা করলেও ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত, বহু আহত হন সেই ঘটনায়। ঘটনাটি পরে দেশের রাজনীতিতে চট্টগ্রাম গণহত্যা শিরোনামে নাম পায়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই ঘটনার চার বছর পর ১৯৯২ সালের চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা সহ ৪৬ জন আসামী করে মামলাটি দায়ের করা হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলাটির বিচার শেষ হতে ৩১ বছর সময় লাগলো! প্রধান আসামী মির্জা রকিবুল হুদাও এরমাঝে মারা গেছেন। অতএব প্রদত্ত রায় এক ধরনের হাস্যরসের সৃষ্টিও করতে পারে। কী হাল বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার? পাঁচ পুলিশ শেখ হাসিনাকে হত্যা করে কী করতে চেয়েছিল?

চট্টগ্রামের ঘটনাটি আমাদের একদল তরুন মিডিয়া কর্মীর জীবনের অংশ হয়ে আছে। আমাদের তখন সাপ্তাহিক বিচিন্তা নামের তুমুল তারুন্যের একটি পত্রিকা ছিল। মিনার মাহমুদ সম্পাদিত সেই পত্রিকায় চট্টগ্রাম থেকে কাজ করতেন শহীদুল ইসলাম বাচ্চু। চট্টগ্রামের ঘটনার তথ্য নিয়ে বাচ্চু চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর রিপোর্ট প্রচ্ছদ করে ছাপা হয় বিচিন্তা। শিল্পী মাসুক হেলালের আঁকা প্রচ্ছদের শিরোনাম হয়, ‘গণঅভ্যুত্থান দিবসে চট্টগ্রামের গণহত্যা এবং নিরোর বাঁশি’। সেই সংখ্যা কাঁপিয়ে দেয় স্বৈরাচার এরশাদের মসনদ। কারন সরেজমিন সেই রিপোর্টে গণহত্যার আয়োজক নির্দেশক হিসাবে স্বৈরাচার  এরশাদকেই চিহ্নিত করা হয়। এর ফলাফল আসে দ্রুত। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাজার থেকে তুলে নেয় পত্রিকার সব কপি। নিষিদ্ধ করা হয় বিচিন্তা। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে সম্পাদক মিনার মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। আমরা ঢাকার-দেশের নতুন একদল সাংবাদিক বেকার হয়ে গেলাম। পাঠক হারায় চমৎকার একটা পত্রিকা। তেমন পত্রিকা বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি বেরোয়নি।

সেই থেকে আমরা সেই গণহত্যার বিচারের অপেক্ষায়। এরশাদের বিচারের অপেক্ষায়। কিন্তু বিএনপি আমলে মামলা হলেও এতে এরশাদকে আসামী করা হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলেও নয়। কারন আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের ক্ষমতার শরীক ছিলেন এরশাদ। আর বিএনপি বিভিন্ন সময়ে এরশাদকে জোটে টানার চেষ্টা করে। চারদলীয় জোট বিএনপি প্রথম এরশাদকে সঙ্গে নিয়েই গঠন করেছিল। সাবেক সেই স্বৈরাচার এরশাদও এরমাঝে মারা গেছেন। তার দলের কংকালের মালিকানা নিয়ে টানাটানি করছেন তার স্ত্রী এবং ভাই। বাংলাদেশের মৃত ব্যক্তিরা বিচার থেকে রেহাই পায়। মরণোত্তর বিচারের ব্যবস্থা না থাকায় এরশাদের মতো স্বৈরাচার চট্টগ্রাম গণহত্যার মতো হত্যাকান্ডের বিচারের বাইরে থেকে গেলো। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের মামলার বিচারের নতুন দীর্ঘসূত্রতার নতুন দৃষ্টান্তের তালিকায় এই মামলাটির নাম ঢুকলো। ২০ জানুয়ারি ২০০১ সালে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা মামলা রায়ও হলো ১৮ বছর পরে। দুই মামলার দেরির কারন হিসাবেও দায়ী করা হয় বিএনপিকে। বিএনপি আমলেই সরকারি যোগসাজশে পালিয়ে আমেরিকা চলে যায় চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলার প্রধান আসামী মির্জা রকিবুল হুদা। আমেরিকায় পলাতক অবস্থায় সেখানেই তার মৃত্যু হয়। আওয়ামী লীগের যে সব নেতাকর্মী ওই ঘটনায় নিহত-আহত হন তাদের পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকান্ডের বিচারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তাদের অনেকেও এরমাঝে মারা গেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বিদেশে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা দুই বোন। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর থেকে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এরমাঝে প্রথম বড় ঘটনা ছিল চট্টগ্রামের গণহত্যা। কিন্তু মামলা ডিপ ফ্রিজে নেবার কাজে পটু বরাবরই বিএনপি। এ দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই এই মামলাটি ডিপফ্রিজে ঢুকিয়েছে। বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের বিচার পর্যন্ত কোনদিন করতে চায়নি। এরশাদ থেকে ক্ষতিপূরনের বাড়ি-নগদ টাকা পেয়ে খালেদা জিয়া মঞ্জুর হত্যা মামলাটি এড়িয়ে চলেন। এরশাদকে চাপে রাখতে আওয়ামী লীগ মাঝেমধ্যে মঞ্জুর হত্যা মামলাটি নড়াচড়া করতো। পরে সেটিও থামিয়ে দেয়া হয়।

সিপিবির জনসভায় বোমা হামলাকে বিএনপি বলতো এটি সিপিবির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল! জনসভার মাইক্রোফোন বিস্ফোরিত হয়ে ঘটনা ঘটেছে এমনও বলা হয়েছে! শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি চালিয়ে ২৪ জনকে মেরে ফেলা হয়। আর মামলাটি বিএনপি তখন এমনভাবে সাজায় যে এটা নেহায়েত পুলিশের কাজ! বাংলাদেশের আমজনতার কাছে কেনো বেআইনি ক্রসফায়ার জনপ্রিয় তা চট্টগ্রাম গণহত্যা আর সিপিবির জনসভায় বোমা হামলার বিচার ঘটনা দুটোর নজির ধরে বিচার বিভাগ পর্যালোচনা করতে পারে। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই যশোরে জনকন্ঠ অফিসে ঢুকে সাংবাদিক শামছুর রহমানকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনারও যে আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি তা বিচার বিভাগ, দেশের সাংবাদিক-রাজনৈতিক মহল সবাই তা ভুলেই বসে আছে! যেমন সাগর-রুনির হত্যা রহস্য উদঘাটনের ৪৮ ঘন্টা এখনও ফুরোয়নি! নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রসর হলেও বিচার ব্যবস্থায় বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।

ফজলুল বারী
fazlulbari2014@gmail.com