ফজলুল বারী: ডক্টর কামাল হোসেন স্যারকে এখন কেউ বিরক্ত করবেননা। কারন তিনি এখন দলের ঐক্য রক্ষার কাজে ব্যস্ত আছেন! বুধবার তাঁর দল গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। ডক্টর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আ স ম আব্দুর রব-মান্না গং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। ছোট দলের বড় নেতারা সেখানে বিএনপিকে নিয়ে এসে আশা করেছিলেন হৈচৈ করার মতো কিছু করে ফেলবেন। কাদের সিদ্দিকীও সেখানে এসেছিলেন। কিন্তু জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদের ঐক্য সফল হয়নি। রাজনৈতিক ঐক্যের জন্যে সবার আগে নীতিগত ঐক্য জরুরি। মনে একটা মুখে একটা নিয়ে জাতীয় ঐক্য হয়না।
ডক্টর কামাল হোসেনের শারীরিক সমস্যাও বড় একটি সমস্যা। বয়সের ভারে তিনি ন্বুজ। নিজে থেকে দাঁড়াতে পারেননা। তাঁকে ধরাধরি করে দাঁড় করাতে হয়। ধরাধরি করে দাঁড় করানোর নেতৃত্বে যে কিছু দাঁড়ায়না এর সর্বশেষ প্রমান ডক্টর কামালের নেতৃত্বের কথিত জাতীয় ঐক্য! সাংবাদিকদের ‘খামোশ’ বলা ডক্টর কামাল আসলে নিজেই খামোশ হয়ে বসে আছেন। মাঝে শেখ হাসিনাকে লাথি মেরে ক্ষমতা থেকে তাড়াবার কথা বলেছিলেন। ওবায়দুল কাদের এর জবার দেবার পর তিনিও আবার খামোশ! আর মুখে কোন ভাষা নেই। কথা নেই।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সংবিধান রচনা কমিটির প্রধান পরিচয় নিয়ে এখনও রাজনীতির মাঠে নামকাওয়াস্তে টিকে আছেন ডক্টর কামাল হোসেন। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বের জাতীয় ঐক্য আদতে কিছুই হয়নি। বিএনপি নেতাদের পাশে বসিয়ে তিনি যখন বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করেন তখন তারা উসখুশ করেন। কারন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঔরসে জন্ম বিএনপির। তারা তাকে শেখ মুজিব বলে, কখনো বঙ্গবন্ধু বলেনা। বঙ্গবন্ধু উচ্চারন শুনলে তাদের পিত্তি জ্বলে।
এরপরও নিজেদের না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থার কারনে বিএনপি এখনও মাঝে মধ্যে ডক্টর কামালের মতিঝিলের আইন অফিসে হাজিরা দিতে যায়। অথবা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী সেখানে তাদেরকে সেখানে যেতে বাধ্য করেন। সেখানে যাতায়াতের জন্যে বিএনপি অবশ্য তাদের ডক্টর মঈন খান নামের একজন নিরীহ নেতাকে নিয়োজিত রেখেছে। সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল আর ইশরাক তাঁর দোয়া নিতে গিয়েছিলেন। ডক্টর কামাল দাঁড়িয়ে তাদের দোয়াও করতে পারেননি। বসে বসে তাদের একটি ছবি দিয়েছেন।
ডক্টর কামাল হোসেন একজন নামকরা আইনজীবী। এক সময় শুধু দেশে না বিদেশেও তাঁর ভালো প্র্যাকটিশ ছিল। তাঁর শারীরিক অবস্থার কারনে আইন ব্যবসাটি এখন মূলত দেখেন তাঁর মেয়ে সারা হোসেন। তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন একজন পাকিস্তানি নারী। এখন অবশ্য খুব ভালো বাংলা বলেন।
সফল আইনজীবী হলেই যে সবাই রাজনীতিক হিসাবে সফল হয়না এর উৎকৃষ্ট এক নজির ডক্টর কামাল । তিনি কখনো ভোটের জেতার মতো রাজনীতিক ছিলেননা।
বঙ্গবন্ধুই তাকে উপনির্বাচনে এমপি করে সংসদে আনেন। কিন্তু তিনি একজন ভীরু রাজনীতিক হিসাবে জনপ্রিয়। ভয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেননি। যে যখন তাকে ধমক দিতে পেরেছে তাতেই তিনি কাবু হয়েছেন। দেশে তিনি মার্কিন লবির রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় সুবিধা করতে না পারে শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনতে তিনি অন্যতম মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। ডক্টর কামাল ভেবেছিলেন শেখ হাসিনা রাজনীতি বুঝবেননা। তাঁকে সামনে রেখে পিছনে থেকে তিনি বাজিমাৎ করবেন। কিন্তু এই মিশন ব্যর্থ হবার পর তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। তাঁর আওয়ামী লীগ ছাড়ার আরেক কারন তিনি জানতেন আওয়ামী লীগ মার্কিন লবির কোন দল নয়।
তিন দশক আগে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সষ্টিটিউটে ডক্টর কামালের নতুন দল গণফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। সাইফুদ্দিন আহমদ মানিকের নেতৃ্ত্বে সিপিবির একাংশ, পঙ্কজ ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে ন্যাপের একাংশ এবং আওয়ামী লীগের উচ্ছিস্ট মোস্তফা মোহসিন মন্টু তাঁর নতুন দলে যোগ দেন। ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুস মূল প্রবন্ধ পড়েন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। সেই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘পথের বাধা সরাতে হবে’।
কিন্তু কার্যত কোনদিন পথের বাধা কাটেনি ডক্টর কামাল হোসেনের রাজনৈতিক মিশনের। প্রথম দিকে ঢাকার বস্তির লোকজন এনে গনফোরামের জনসভা করা হতো। প্রথম দিন থেকে ডক্টর কামালের ইচ্ছাই এ দলের নীতি-আদর্শ-সংবিধান। তিনি প্রায় থাকতেন বিদেশে। কেউ ধমক দিলে চলে যেতেন বিদেশে। আর বিদেশ বেশি যাবেননা দেশে থাকবেন এ কথা বলেও দলের কাজে গতি আনার চেষ্টা করে সবাই ব্যর্থ হন। এরমাঝে সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক মারা যান। গনফোরাম ছেড়ে যান পঙ্কজ ভট্টাচার্য। দিনে দিনে আরও ক্ষুদ্রাকার হয় গণফোরাম। গত নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের অচল মাল আবু সাইয়ীদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এস এম কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়াকে দলে যোগ দিইয়ে ভাবা হয়েছিল এবার বুঝি হবে। কিন্তু এবারও ফলাফল বড় একটি ঘোড়ার ডিম হয়েছে।
গণফোরামের মনোনয়ন নিয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও মোকাব্বির খান বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে এমপি হন। এমপি হয়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ আর গণফোরামের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। লন্ডন প্রবাসী মোকব্বির খানের সাড়াশব্দ কম। রেজা কিবরিয়াকে দলের সাধারন সম্পাদক করা নিয়ে গণফোরামে যে সংকটের সৃষ্টি হয় তা এখনও চলছে। গত কিছুদিন ধরে এ দলের অমুক অমুককে শুধু বহিষ্কার করেছেন। সর্বশেষ দলের কেন্দ্রীয় কমিটিই বাতিল করে দিয়েছেন ডক্টর কামাল হোসেন! এখন শুধু এ দলের আহবায়ক কমিটির দু’জন নেতা বহাল আছেন! আহবায়ক ডক্টর কামাল এবং সদস্য সচিব রেজা কিবরিয়া!এখন নাকি তারা ঠিক করবেন গণফোরামে কে থাকবেন অথবা কে থাকবেননা।
অতএব এখন কেউ ডক্টর কামালকে বিরক্ত করবেননা। তিনি এখন দলের ঐক্য রক্ষায় ব্যস্ত! অথবা তাঁর ঐক্য প্রচেষ্টা আরেকটি ঘোড়ার ডিম হবে। ডক্টর কামালের রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যর্থতা আবার প্রমান করে ছোটদলের বড় নেতারা টবিলটকে ভালো। রাজনৈতিক সংগঠনে নয়। নেতা যত নামে বড় হোক গণবিচ্ছিন্ন নেতাদের দিয়ে রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য হয়না। জাতীয় ঐক্যের জন্যে দরকার গণসম্পৃক্ত নেতা। জনগনের সঙ্গে যারা থাকেন তারাই গণসম্পৃক্ত হন।