ফজলুল বারী:পদ্মা সেতুর উদ্বোধন পর্ব থেকে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের বিরোধিতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বিষয়টি বলেছেন। একটি ব্যাংকের এমডি পদের জন্যে সরকারকে জব্দ করতে চেয়েছেন দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট!
ডক্টর ইউনুস অভিযোগ অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। এসব বিবৃতি দেবার জন্য তাঁর নিজের একটি প্রতিষ্ঠান আছে ইউনুস সেন্টার। বিবৃতিটি সেখান থেকে মিডিয়ায় এসেছে। মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে বিবৃতি প্রচার করেছে। কারন এরসঙ্গে গ্রামীণ ফোনের বিজ্ঞাপন জড়িত।
ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস বিবৃতি দেবার আরেক কারন এটি তার বিদেশের ভাবমূর্তির জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। এখন তার পদ্মা সেতুর বিরোধিতার যত রিপোর্ট বিদেশে হবে, রিপোর্টের লেজে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বলে তার বিবৃতির বক্তব্যেরও উল্লেখ থাকবে।
বিদেশে অনেক চেনাজানা আছে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের। ডক্টর কামাল হোসেন তেমন আরেকজন ব্যক্তি। বাংলাদেশের যত শ্রমিক বিদেশে থাকেন তারা কাজ করে টাকা পাঠান দেশে। বিদেশে তারা নানাভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
কিন্তু ডক্টর কামাল বা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস তেমন কিছু করেছেন কোন দিন, তা কী কেউ জানেন অথবা শুনেছেন কখনো? অথচ তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তারা দেশের জন্যে কতকিছু করতে পারতেন। কিন্তু এরা যা কিছু করেন-করেছেন, এর সবই নিজের জন্যে। নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের জন্যে।
দেশের জন্যে নয়। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস নিজের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে দেশের ক্ষতি করেছেন, পদ্মা সেতুর কাজ আটকে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি দেখতে পারেননা তা সবাই জানেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন পদ্মা সেতু না হলে শেখ হাসিনা সাইজ হবেন।
শেখ হাসিনাকে সাইজ করার চিন্তায় তিনি যে দেশকে সাইজ করার চেষ্টা করেছিলেন তা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। গ্রামীণ ফোন থেকেই ক্রোধের উৎপত্তি।অথচ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা গ্রামীণ ফোনের লাইসেন্স দিয়েছেন।
এর আগে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দলের নেতা মোরশেদ খানকে মনোপলি ব্যবসা করতে দিতে সিটিসেল ছাড়া আর কোন মোবাইল ফোন কোম্পানিকে লাইসেন্স দেননি। শেখ হাসিনা ডক্টর ইউনুস তথা গ্রামীন ফোনকে লাইসেন্স দিয়ে সেই মনোপলি ব্যবসা ভেঙ্গে দেন। সিটিসেলে ইনকামিং চার্জ ছিল।
এরমানে আপনি কারো ফোন রিসিভ করলে এরজন্যেও একটি চার্জ দিতে হতো। গ্রামীণ ফোন বাজারে এসেও ইনকামিং চার্জ আরোপ করে। মোহাম্মদ নাসিম তখন টেলিফোন মন্ত্রী। সিটিসেল-গ্রামীণ ফোনের ইনকামিং চার্জের বিরোধিতা করতে ক্ষিপ্ত হন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস!
তিনি বেশিকিছু মার্কিন সিনেটর-কংগ্রেসম্যানকে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লেখান! এসব চিঠিতে লেখা হয় ‘ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস আমাদের বন্ধু। তাকে যেন সরকার দেখে রাখে’! কিন্তু শেখ হাসিনা এসব শোনেননি। বিদেশি চাপ-খবরদারিকে একটু কম পাত্তা দেন জাতির জনকের কন্যা।
তিনি ইনকামিং চার্জ বাতিলের বিষয়ে অটল থাকেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের তিক্ততা তখন থেকে। এরপর ১/১১’র সময় এর শোধ নিতে চান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস! তার মনে হলো শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দেবার এখনই সময়।
এতে কামিয়াব হলে তিনি হয়তো ক্ষমতায় আসবেন! দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন! দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে কে না চায়। কতজনের সুখ মনে মনে! কিন্তু ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস হাঁটা দিয়েছিলেন ভুল পথে। সামরিক শাসকদের গোলাম হবার পথে। যে মানুষটি নোবেল পুরস্কার পাবার পথ আনন্দে ভেসেছে দেশ।
সেই মানুষ তার রাজনৈতিক স্বপ্ন পূরনে সামরিক শক্তিকে ভর করতে চেয়েছেন! তিনি হতে চেয়েছেন কিংস পার্টির নেতা! সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া উর্দি পরা অবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠনের প্রথম দায়িত্ব দেন নীলফামারীর মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে।
সাবেক ভাসানী ন্যাপ নেতা যাদু মিয়া হঠাৎ মারা গেলে অথবা তাকে মেরে ফেলা হলে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন দলের চেয়ারম্যান, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী মহাসচিব হন।
জেনারেল মঈন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসকে রাজনৈতিক দল গঠনের দায়িত্ব দেন। এভাবে দেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তিত্ব সামরিক শাসকের গোলাম হবার কাজে হাঁটা শুরু করেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের রাজনৈতিক অভিলাষ কিন্তু এটাই প্রথম নয়।
এর আগে তিনি ডক্টর কামাল হোসেনের গনফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘পথের বাধা সরাতে হবে’ শিরোনামের একটি লিখিত বক্তব্য দেন। গণফোরামের ভবিষ্যত না দেখে তিনি আর এতে জড়াননি। জেনারেল মঈনের সঙ্গেও ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের সম্পর্ক বেশদিন টেকেনি।
কারন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস দলের চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। জেনারেল মঈনকে কিংস পার্টির চেয়ারম্যান করা হচ্ছেনা দেখে সেখানেই তাকে থামিয়ে দেয়ায় দুই নেত্রীকে মাইনাস করে তার দেশের রাজনৈতিক অধীশ্বর হবার স্বপ্ন পূরন হয়নি।
এই সুযোগে ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে জেনারেল মঈনের সখ্য বলে নেই। জেনারেল মঈনের সামরিক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্ট হতে চেয়েছিলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এরজন্যে তিনি সেনা সদর দফতরে জেনারেল মঈনের অফিসে গিয়ে ইন্টারভ্যুও দেন।
কিন্তু জেনারেল মঈনের শাসন বেশিদিন না টেকায় দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের আর উপদেষ্টা হবার স্বপ্ন পূরন হয়নি! তার বড়বড় কথাও চালু আছে। এরা জ্ঞানী লোক। কিন্তু ক্ষমতা দেখলে এদেরও হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। কারন তারাও যে বাংলাদেশের মানুষ। দেবতা নন। দেবতার মতো ভাব করে কথা বলেন!
১/১১’র পর ক্ষমতায় না আসায় খালেদা জিয়া তাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়ন করে ডক্টর ইউনুসের কিংস পার্টির নেতা হবার চেষ্টার কথা ভুলে যান। কিন্তু শেখ হাসিনা ভোলেননি। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ডক্টর ইউনুসকে সরিয়ে দিলে তিনি আদালত পর্যন্ত যান।
নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সুপ্রিমকোর্ট সব আদালতে তিনি হেরেছেন। কারন সরকারি ব্যাংক সংক্রান্ত আইনেই আছে এমডির বয়স ষাট বছরে বেশি হবেনা। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের বয়স সত্তুরের বেশি। এরপর তিনি হিলারী ক্লিনটন, চেরী ব্লেয়ার সহ অনেককে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন করান।
হিলারী ক্লিনটন ফোন করেছেন দেখলে অন্য কেউ চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিতেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ঠান্ডা মাথায় তাকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং আইন বোঝান। তখন থেকে শেখ হাসিনাকে যা যা ভয় দেখানো হয়েছিল তাই করা হয়।
কল্পিত দুর্নীতির কথা বলে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশে যেহেতু দুর্নীতি হয় তাই তখন অনেকে মনে করেছিলেন দুর্নীতি হতেই পারে। কিন্তু শেখ হাসিনা দৃঢ় কন্ঠে বলতে থাকেন দুর্নীতি হয়নি। যা পরে কানাডার আদালতেও প্রমানীত হয়েছে দুর্নীতি হয়নি।
শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মান শেষে তা উদ্বোধনও করেছেন। কোন একটি সেতু উদ্বোধন উপলক্ষেও বিভিন্ন দেশের অভিনন্দন আসে এটা আগে কখনও দেখা যায়নি। এতে বোঝা হয় এটি বাংলাদেশের জন্যে স্পেশাল কিছু। দেশের মানুষের কাছে এরনাম হয়ে গেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
অতঃপর আত্মপক্ষ সমর্থনের বিবৃতিতে ডক্টর ইউনুস নিজেকে ফেরেস্তা প্রমানে বলতে চেয়েছে কিরা কেটে বলছি, আমি কিস্যু করিনি পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে চাঁদা দেইনি! কিন্তু ইউনুসের বক্তব্য যে অসার-অসত্য এর প্রমান আছে মার্কিন নথিতে। উইকিলিকসও তা ফাঁস করেছে।
এরজন্যে আগেই লিখেছি ইউনুসের বিবৃতি দেবার কারন মিডিয়া রিপোর্টের লেজের দিকে যেন তার বক্তব্য থাকে। পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের চিহ্নিত করতে বলেছে হাইকোর্ট। এতে কার লাভ? এসবকে কে আমল-পাত্তা দেয়?
হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, পঞ্চম-সপ্তম সংশোধনীও বাতিল করেছে। যা কার্যকর করলে বিএনপি নামের কোন দলও থাকেনা। কর্নেল তাহেরের বিচারকেও অবৈধ উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোন ফলোআপ পদক্ষেপ নিয়েছে কী?
পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়টি নিয়েও কোর্টের ভিতরে বাইরে রাজনীতি হবে। কাজের কাজ কিছুই হবেনা। জনাব নোবেল লরিয়েট সাহেব, পদ্মা সেতু নিয়ে জাতির বিবেকের কাছে আপনি কিন্তু অনেক আগেই হেরে বসে আছেন। বুঝতে পারেন?