টিএসসি থেকে বেরিয়েই সায়মা দেখে চারিদিক থেকে হুলুস্থুল আর চিৎকার চেঁচামিচির শব্দ। রাস্তা পার হয়ে আর্টস ফ্যাকাল্টিতে যেতে হবে ভেবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জটলার পাশ দিয়ে যাবার সময় শুনতে পায় কে একজন বলে ওঠে,
পানি, পানি আছে?
সায়মা তাড়াতাড়ি হাতব্যাগে রাখা পানির বোতলটা দিতে যাবে ঠিক তখনি কেউ একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে তার হাতে একটা সোনালী ফ্রেমের চশমা ধরিয়ে দেয়। সে চশমাটা ব্যাগে রেখে তারপর পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্যে সে দেখতে পায় গোলাকৃতি মুখের ঝাঁকড়া চুলের এক যুবকের সারা মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। প্রায় সাথে সাথে কয়েকটি ফায়ার ব্রিগেড আর একটি এম্বুলেন্স এসে ছেলেটিকে দ্রুত তুলে নিয়ে চলে যায়। পুলিশ আর ডিবির লোকজন জায়গাটা ঘিরে ফেলে।
সায়মা রাস্তা পার হয়ে কিছুদূর যেতেই হঠাৎ তার মাথা ব্যথা শুরু হয় আর পেট গুলিয়ে বমি বমি ভাব হতে থাকে। সে ক্লাসে না গিয়ে দ্রুত রুমে ফিরে আসে। একটা মাথা ধরার ট্যাবলেট খেয়ে রুমের পর্দা টেনে শুয়ে পড়ে। তন্দ্রা ঘুমের ঘোরে সে দেখতে পায় হাসপাতালের বেডে ছেলেটার মাথার কাছে সে বসে আছে আর অল্প বয়সী একটা মেয়ে অঝোরে কাঁদছে। পড়ন্ত বিকালে মোবাইল ফোনের রিঙের শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গে। হাত ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতে গিয়ে সোনালী ফ্রেমের চশমাটা বেরিয়ে আসে। সায়মা চশমাটার কথা ভুলেই গেছিল। ফ্রেম আর কাঁচের উপর তখনও লেপটে থাকা রক্ত। সে কি ভেবে টিসু পেপার আর ডেটল পানি দিয়ে চশমাটা মুছে আবার ব্যাগে রেখে দিলো।
সকালে পত্রিকার পাতায় দুর্ঘটনার খবরটা দেখে আবার তার চশমার কথা মনে পড়ে। কিন্তু কিভাবে চশমাটা ফেরত পাঠাবে তা বুঝে উঠতে পারে না। পরের কিছুদিন টিউটোরিয়ালের চাপে চশমা ফেরত পাঠাবার কথা প্রায় ভুলেই যায়। হঠাৎ সায়মার মনে পড়ল পত্রিকায় লেখা ছিল যে সাব্বির নামের ঐ ছেলেটি ল্যাব–এইডে ভর্তি হয়েছিল। তাড়াতাড়ি সে ল্যাব–এইডে ফোন করলে তাকে বলা হোল, সাব্বিরকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক অনুরোধের পরে অবশেষে ওর বাসার ঠিকানা পায়।
পরদিন সকালে একটা ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে সাব্বিরদের বাসার ঠিকানায় হাজির হয়। লিফট দিয়ে উপরে উঠে দরজা নক করতেই একজন বৃদ্ধা লাঠিতে ভর করে দরজা খুলে দেয়। সাব্বিরের কথা বলতেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ও সাব্বিরের ফুফু। সাব্বিরের জন্ম কানাডাতে এবং এইবারই সে প্রথম বাবা-মায়ের সাথে ঢাকা এসেছিল বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে। ঘটনার দিন পাত্রী দেখে ফেরার পথে টিএসসির সামনে ওদের গাড়িটিকে পেছন থেকে একটি মাইক্রোবাস ধাক্কা দিলে সাব্বির মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায়। ল্যাব–এইডের ডাক্তাররা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কানাডা ফিরে যেতে পরামর্শ দেয়। আজ ভোরের ফ্লাইটে ওরা সবাই টরেন্টো রওনা হয়ে গেছে। সায়মা হাত ব্যাগ থেকে সোনালী ফ্রেমের চশমাটা বের করে টেবিলের উপর রাখে। হঠাৎ করে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। বাসা থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা লিফটের দরজা বন্ধ হতেই চোখ ছাপিয়ে হু হু করে কান্না আসে। এই কান্না সে কাউকে দেখাতে চায় না।
নাইম আবদুল্লাহ
লেখক, সাংবাদিক